বাংলাদেশে সমাজকর্ম শিক্ষার সমস্যা ও সমাধানের উপায় আলোচনা কর

বাংলাদেশে সমাজকর্ম শিক্ষার সমস্যা ও সমাধানের উপায় আলোচনা কর

প্রশ্ন ২.৪১ | বাংলাদেশে সমাজকর্ম শিক্ষার সমস্যা ও সমাধানের উপায় আলোচনা কর।

অথবা, বাংলাদেশে সমাজকর্ম শিক্ষার সমস্যা দূরীকরণের পদক্ষেপসমূহ আলোচনা কর।

উত্তর ভূমিকা : দানশীলতা দিয়ে সমাজকর্মের সূচনা ঘটলেও কালের পরিক্রমায় সমাজকর্ম আজ একটি স্বীকৃত পেশা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষিতে প্রয়োজন পূরণের নিরিখে সমাজকর্ম তার সম্পূর্ণ পেশাগত অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। ফলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ সমাজকর্মী দ্বারা পরিবর্তিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় সমাজকর্ম শিক্ষা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে সমাজকর্ম শিক্ষার বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, যা উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সমাধান সম্ভব।

বাংলাদেশে সমাজকর্ম শিক্ষার সমস্যা ও সমাধানের উপায় আলোচনা কর
বাংলাদেশে সমাজকর্ম শিক্ষার সমস্যা ও সমাধানের উপায় আলোচনা কর

বাংলাদেশে সমাজকর্ম শিক্ষাক্ষেত্রে সমস্যা : নিম্নে বাংলাদেশে সমাজকর্ম শিক্ষা অর্জন করার ক্ষেত্রে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তা আলোচনা করা হলো-

১. দেশি বইয়ের স্বল্পতা : আমাদের দেশে সমাজকর্ম বিষয়ে দেশি বইয়ের অভাব রয়েছে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সমস্যা খুবই তীব্র। অন্যদিকে, যেসব দেশি বই পাওয়া যায় তা পাশ্চাত্য ও ধ্যানধারণায় লেখা হয়েছে। ফলে বইয়ের উদাহরণ সমাজব্যবস্থার বিবরণ ঐ চিন্তাধারাতেই লেখা। তাই দেশি ধ্যানধারণানির্ভর বইয়ের অভাবে সমাজকর্ম অধ্যয়ন হচ্ছে না। 

২. ত্রুটিপূর্ণ পাঠ্যসূচি : আমাদের দেশে সমাজকর্ম বিষয়ের পাঠ্যসূচি প্রথমদিকে পাশ্চাত্য সমাজকর্মভিত্তিক প্রণীত হতো। পরবর্তীতে দেশীয় প্রেক্ষিতে প্রণীত হলেও তার পরিপূর্ণ রূপ দেওয়া যায়নি। ফলে জ্ঞানের সাথে বাস্তবের সামঞ্জস্যহীনতা দেখা দেয় । 

৩. নাম বিভ্রাট : বাংলাদেশে সমাজকর্ম ও সমাজকল্যাণ উভয় নামে স্নাতক কোর্স চালু আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যা সমাজকল্যাণ তা রাজশাহী ও শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্ম নামে পরিচিত । এতে ছাত্রছাত্রীরা বিষয়ের নামের বিভ্রান্তিতে ভোগে । 

৪. ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ সমস্যা : সমাজকর্ম বিষয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে তাত্ত্বিক জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ নিতে হয়। কিন্তু এদেশে এর ব্যাপক ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়। এজেন্সির স্বল্পতা, শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের অনাগ্রহ, যাতায়াত সমস্যা, আর্থিক অসচ্ছলতা, পরিকল্পনা ও কর্মসূচির অভাব প্রভৃতি এর মূল কারণ ।

৫. শিক্ষকের অভাব : বাংলাদেশে যেসব কলেজ ও বিশ্ববিদ্যায়গুলোতে সমাজকর্ম শিক্ষা চালু আছে সেসব কলেজ বা বিশ্বাবিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা খুবই কম। ফলে ক্লাস বিঘ্নিত হচ্ছে, লেখাপড়ার মানের অবনতি ঘটছে এবং কাঙ্ক্ষিত ফলাফলে ব্যর্থ হচ্ছে।

৬. পেশাগত সংগঠনের অভাব : বাংলাদেশে সমাজকর্মীদের উল্লেখযোগ্য পেশাগত সংগঠন নেই। ফলে সংগঠনের অভাবে সমাজকর্ম শিক্ষার মানের উন্নয়ন ঘটাতে পারছে না। এছাড়া সমাজকর্মের শিক্ষকদের কোনো সংগঠন নেই ।

৭. সনাতনী দৃষ্টিভঙ্গি : বাংলাদেশে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্ম শিক্ষা চালু থাকলেও এ বিষয়ে এদেশের ছাত্রছাত্রীদের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে সনাতনী। ফলে বৈজ্ঞানিক বা পেশাদার সমাজকর্ম প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হচ্ছে না। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সমাজকর্ম শিক্ষার বিকাশে।

৮. শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাব : বাংলাদেশে সমাজকর্ম বিষয়ে যেসব শিক্ষক রয়েছেন তাদের উচ্চতর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। কিছু শিক্ষক বিদেশ হতে উচ্চতর ডিগ্রি বা প্রশিক্ষণ নিয়ে আসলেও এর সংখ্যা খুবই কম। ফলে পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সমাজকর্ম শিক্ষা পরিবর্তন হচ্ছে না।

৯. স্বীকৃতির অভাব : বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমাজকর্মকে একটি স্বীকৃত পেশা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অথচ বাংলাদেশে সমাজকর্ম স্বীকৃত পেশা হিসেবে মর্যাদা অর্জন করতে পারেনি। ফলে সমাজকর্ম শিক্ষার আগ্রহ হারাচ্ছে। সুতরাং বলা যায়, সমাজকর্মকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিষয় হিসেবে পাঠ্য করা হলেও নানা সমস্যার ভিতর দিয়ে এ বিষয়ে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করছে।

বাংলাদেশে সমাজকর্ম শিক্ষার সমস্যা সমাধানের উপায় : বাংলাদেশে উচ্চ মাধ্যমিক, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সমাজকর্ম শিক্ষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের উপায়সমূহ নিম্নে তুলে ধরা হলো-

১. দেশি বইয়ের পর্যাপ্ততা নিশ্চিতকরণ : সমাজকর্মের যারা পণ্ডিত রয়েছেন তারা দেশীয় প্রেক্ষাপট বিবেচনায় দেশীয় বই লেখা এবং সাশ্রয়ী মূল্যে যেন শিক্ষার্থীরা পেতে পারে তা নিশ্চিত করা । 

২. ত্রুটিপূর্ণ পাঠ্যসূচি দূর করা : সমাজকর্ম বিষয়ের পাঠ্যসূচি, পাশ্চাত্য ধ্যানধারণার পরিবর্তে দেশি রূপ দেওয়া এবং সব কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে একই পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করা।

৩. সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি নির্বাচন : সকল পর্যায়ে অর্থাৎ কলেজ ও বিশ্বাবিদ্যালয়ে সমাজকর্ম বিষয়ে ভর্তি, পাঠদান, শিক্ষকদের যোগ্যতা প্রভৃতি বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি নির্ধারণ করতে হবে। এর ফলে যোগ্য ছাত্রছাত্রী ভর্তি হবে এবং পেশাদার সমাজকর্মী তৈরি হবে।

৪. উচ্চতর শিক্ষা অর্জন : সমাজকর্ম বিষয়ে যারা পাঠদান করবে তারা উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ ও ডিগ্রি অর্জন করবেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক এসব সুযোগ উচ্চশিক্ষা অর্জনে সহায়ক হবে।

৫. পেশাগত সংগঠন সৃষ্টি : সমাজকর্ম শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ ও পেশাদারিত্ব অর্জনে সমাজকর্ম বিষয়ের শিক্ষকদের পেশাগত সংগঠন সৃষ্টি করতে হবে। তবে এ ব্যাপারে সরকারকেও সহায়তা করতে হবে। ফলে সমাজকর্ম শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে।

৬. নাম বিভ্রাট দূর করা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্ম/সমাজকল্যাণ বিষয়ের যে নাম বিভ্রাট রয়েছে তা দূর করতে হবে।

৭. ব্যবহারিক প্রশিক্ষণে গুরুত্বারোপ : তাত্ত্বিক জ্ঞানের পাশাপাশি ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের যে ব্যবস্থা চালু আছে তা শিক্ষক, শিক্ষার্থীকে ব্যাপক গুরুত্ব দিয়ে সম্পাদন করতে হবে এবং ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের গুণগত মান বাড়াতে হবে ।

৮. শিক্ষক বৃদ্ধি : কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্মের পর্যাপ্ত শিক্ষকের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য গবেষণা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

৯. কর্মক্ষেত্র সম্প্রসারণ : বাংলাদেশে যেসব সমাজসেবামূলক কাজের ক্ষেত্র রয়েছে সেগুলোকে শুধু সমাজকর্মীদের বিবেচনায় আনতে হবে। বিশেষত সমাজসেবা অধিদপ্তর শুধু সমাজকর্মীদের জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে।

উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলাদেশে সমাজকর্ম শিক্ষার বিকাশে ব্যাপক সমস্যা পরিলক্ষিত হয়। তবে এসব সমস্যা সমাধানে যদি উপরিউক্ত সুপারিশসমূহ বিবেচনা করা হয় তবে এদেশে দক্ষ সমাজকর্মী তৈরি হবে এবং দেশের উন্নয়নে নিজেদের নিয়োজিত করার সুযোগ পাবে। তাই সমাজকর্মকে আরও গতিশীল ও পেশাগত স্বীকৃতি লাভে উক্ত সুপারিশসমূহ বাস্তবায়ন অনস্বীকার্য ।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ