বাংলাদেশে বর্তমানে প্রচলিত সমাজকল্যাণ কার্যক্রমগুলো আলোচনা কর

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রচলিত সমাজকল্যাণ কার্যক্রমগুলো আলোচনা কর

প্রশ্ন ২.৪০ | বাংলাদেশে বর্তমানে প্রচলিত সমাজকল্যাণ কার্যক্রমগুলো আলোচনা কর ।

অথবা, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রচলিত সমাজকল্যাণ কর্মসূচি কী কী? বর্ণনা কর।

উত্তর ভূমিকা : বাংলাদেশে শিল্পায়ন ও শহরায়নের প্রেক্ষিতে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দানশীলতাভিত্তিক সমাজকল্যাণ কার্যক্রম অপর্যাপ্ত বিবেচিত হয়। যৌথ পরিবার ভাঙন, দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বেকারত্ব, সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও নিরাপাত্তাহীনতার মতো সমস্যা ব্যাপক রূপলাভ করে। ফলে এসব সমস্যা সমাধানে বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজকল্যাণের উদ্ভব ঘটে। বর্তমানে বাংলাদেশে বিজ্ঞানভিত্তিক উন্নয়নমুখী সমাজকল্যাণ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। যা মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, অপরাধ সংশোধন, প্রতিবন্ধী কল্যাণ, মাতৃকল্যাণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখছে ।

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রচলিত সমাজকল্যাণ কার্যক্রমগুলো আলোচনা কর
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রচলিত সমাজকল্যাণ কার্যক্রমগুলো আলোচনা কর

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রচলিত সমাজকল্যাণ কার্যক্রমসমূহ : নিম্নে বাংলাদেশে বর্তমানে প্রচলিত সমাজকল্যাণ কার্যক্রমগুলো আলোচনা করা হলো-

১. শিক্ষা কার্যক্রম : শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। আর তাই বাংলাদেশ সরকার শিক্ষার ওপর ব্যাপক জোর দিয়ে থাকেন। বর্তমান বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে ব্যাপক বাজেট রাখা হয়। যার মাধ্যমে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নয়ন এবং উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সুযোগ সুবিধা সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। শিক্ষার আগ্রহ বাড়ানোর জন্য বৃত্তি, উপবৃত্তি, বেতন মওকুফ ও বিদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে স্কলারশিপ প্রদান করা হয় ।

২. স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম : বর্তমানে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। জনগণের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে। মাতৃ মৃত্যু ও শিশু মৃত্যুর হার কমেছে। পুষ্টিমাত্র' বৃদ্ধি পেয়েছে এবং উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু হয়েছে। বাংলাদেশের জনগণের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও পরিবার কল্যাণ নিশ্চিত কল্পে এবং স্বাস্থ্য খাতকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করার জন্য স্বাস্থ্য পুষ্টি ও জনসংখ্যা কার্যক্রমে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও এক্ষেত্রে অবদান রাখছে।

৩. শহর সমাজসেবা কার্যক্রম : শহর সমাজসেবা শহরবাসী এবং সরকারের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় পরিচালিত এমন একটি কার্যক্রম যার মাধ্যমে শহরবাসীর আর্থসামাজিক উন্নয়ন, পারস্পরিক সৌন্দর্য ও সহযোগিতার সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে শহরবাসীকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। শহর সমাজসেবায় যেসব কর্মসূচি রয়েছে তা হলো পরিবারিক ঋণদান কর্মসূচি, পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র, কুটিরশিল্প ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র, চিত্তবিনোদন কেন্দ্ৰ প্ৰভৃতি । 

৪. গ্রামীণ সমাজসেবা কার্যক্রম : সাধারণত গ্রামীণ সমাজসেবা বলতে গ্রামীণ জনগণের উন্নয়নে গৃহীত বহুমুখী কর্মসূচিকে বুঝায় । বাংলাদেশে ১৯৪৭ সাল থেকে সরকারিভাবে গ্রামীণ সমাজসেবা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এ কার্যক্রমের মাধ্যমে যেসব কর্মসূচি গৃহীত হয় তা হলো বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, অর্থনৈতিক কার্যক্রম, মাতৃকেন্দ্র স্থাপন, বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রম, প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা সম্পর্কে উদ্বুদ্ধকরণ ও সহায়তা প্রদান, লক্ষ্যভুক্ত জনগোষ্ঠীর নিজস্ব তহবিল সৃষ্টির জন্য সঞ্চয় আদায় প্রভৃতি ।

৫. শিশুকল্যাণ : শিশুরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ নাগরিক ও জাতির কর্ণধার। শিশুর সুষ্ঠু পরিচর্যার ওপর নির্ভর করে শিশুর ভবিষ্যৎ। তাই শিশুর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, বুদ্ধিভিত্তিক ও আবেগীয় বিকাশের জন্য সার্বিক কল্যাণমূলক প্রয়াস চালানো হয়। বাংলাদেশে শিশু কল্যাণে যেসব কার্যক্রম পরিচালিত হয় তা হলো সরকারি শিশু সদন, দিবাকালীন শিশু যত্ন কেন্দ্র, দুস্থ শিশুদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র, সরকারি অন্ধ, মুক ও বধির বিদ্যালয়, সমন্বিত অন্ধ শিক্ষা কার্যক্রম, জাতীয় কিশোর অপরাধ সংশোধনী প্রতিষ্ঠান, এতিম ও দুস্থ শিশুদের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, জাতীয় বিশেষ শিক্ষা কেন্দ্র প্রভৃতি। এগুলোর মাধ্যমে শিশুর বৃদ্ধি, বিকাশ, রক্ষণাবেক্ষণ ও সর্বাঙ্গীণ কল্যাণসাধন প্রচেষ্টা চালানো হয় ।

৬. যুব কল্যাণ : যুবসমাজ জাতীয় অমূল্য সম্পদ। বাংলাদেশে যুব সম্পদকে কাজে লাগানোর জন্য বিভিন্ন সমাজ কল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। যার মাধ্যমে যুবকদের কর্মসংস্থানসহ সার্বিক কল্যাণসাধন করা হয়। এ কার্যক্রমগুলোর মধ্যে রয়েছে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর যার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয় যুব প্রশিক্ষণ ও আত্মকর্মসংস্থান প্রকল্প, বেকার যুবকদের কারিগরি প্রশিক্ষণ, যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন, পরিবারভিত্তিক কর্মসংস্থান কর্মসূচি, জাতীয় যুব উৎসব, এডভোকেসি কার্যক্রম প্রভৃতি

৭. সংশোধনমূলক কার্যক্রম : বাংলাদেশে প্রচলিত সমাজকল্যাণ কার্যক্রমের মধ্যে অন্যতম মানবিক ও বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা হলো সংশোধনমূলক কার্যক্রম। এ কার্যক্রমের মাধ্যমে অপরাধীদের অপরাধপ্রবণতা থেকে মুক্ত করে স্বাভাবিক সামাজিক জীবনে পুনর্বাসন করা হয়। এ কার্যক্রমগুলো হলো প্রবেশন প্যারোল, আফটার কেয়ার, রিমান্ড হোম, বোরস্টাল স্কুল, কিশোর আদালত, ট্রেনিং স্কুল ইত্যাদি। 

৮. চিকিৎসা সমাজকর্ম : বাংলাদেশে চিকিৎসা সমাজকর্ম সমাজ- কল্যাণের একটি নতুন ধারা। এটি রোগীদের জন্য এমন এক ধরনের ব্যক্তিকেন্দ্রিক সেবা যা একজন চিকিৎসা সমাজকর্মীর সহায়তায় রোগীকে চিকিৎসা প্রদান করা হয়। সমাজকর্মী রোগীকে পর্যবেক্ষণ করে তার রোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারণ, আবেগ, আর্থসামাজিক অবস্থা এবং অন্যান্য বিষয়গুলো জেনে সেগুলো সম্পর্কে চিকিৎসককে অবহিত করেন । ফলে রোগী সহজেই আরোগ্য লাভে সক্ষম হয় ।

৯. প্রতিবন্ধী প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কর্মসূচি : প্রতিবন্ধীদের স্বাভাবিক জীবন সক্ষম করে তুলতে ১৯৬২ সাল থেকে বাংলাদেশে এ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে, যা বর্তমানে সমাজসেবা অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছে। এ কার্যক্রমগুলোর মধ্যে রয়েছে অন্ধ বিদ্যালয়, মুক ও বধির বিদ্যালয়, দৈহিক প্রতিবন্ধী শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র, সমন্বিত অন্ধ শিক্ষা, পঙ্গুত্ব প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ, চাকরি পুনর্বাসন কেন্দ্র, জাতীয় বিশেষ শিক্ষা কেন্দ্র প্রভৃতি ।

১০. শ্রম কল্যাণ কার্যক্রম : বাংলাদেশে শ্রমিকদের যথেষ্ট মূল্যায়ন কখনও করা হয় না । অথচ দেশের শিল্পকারখানার উৎপাদন তাদের ওপর নির্ভরশীল। তবে শ্রমিকদের কল্যাণে অর্থাৎ শ্রমিকদের জন্য শ্রমনীতি, শ্রম আইন, বাসস্থান, চিকিৎসা, বিশ্রাম, বিনোদনসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা প্রদানে শ্রমকল্যাণ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এ শ্রমকল্যাণ কার্যক্রমের সাথে সংশ্লিষ্ট রয়েছে শ্রমকল্যাণ অধিদপ্তর এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন দপ্তর।

১১. পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি : বাংলাদেশে বর্তমানে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত করা হয়েছে। জনসংখ্যা রোধকল্পে জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং সীমিত পরিবার গঠনে বর্তমানে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম চলমান রয়েছে ব্যাপকহারে।

১২. সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি : মানুষের স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তা বিধানে বাংলাদেশে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু রয়েছে। এ কর্মসূচির আওতায় রয়েছে অবসর ভাতা, যৌথ বিমা, ভবিষ্যৎ তহবিল, মাতৃত্ব সুবিধা, শ্রমিক ক্ষতিপূরণ, কল্যাণ তহবিল, বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, বিধবা ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা সম্মানি ভাতা, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি প্রভৃতি।

উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলাদেশে সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম সরকারি ও বেসরকারি উভয়ভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এতে দুস্থ, দরিদ্র, অসহায়, প্রতিবন্ধী ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর সার্বিক অবস্থার উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে। তবে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে এগুলো পর্যাপ্ত নয়। তাই এদেশে সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রমের পরিধি আরও বৃদ্ধি করা জরুরি।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ