সিকান্দার আবু জাফর বিরচিত 'সিরাজউদ্দৌলা' নাটকের পটভূমি আলোচনা কর

সিকান্দার আবু জাফর বিরচিত 'সিরাজউদ্দৌলা' নাটকের পটভূমি আলোচনা কর ।
সিকান্দার আবু জাফর বিরচিত 'সিরাজউদ্দৌলা' নাটকের পটভূমি আলোচনা কর ।

সিকান্দার আবু জাফর বিরচিত 'সিরাজউদ্দৌলা' নাটকের পটভূমি আলোচনা কর ।


উত্তর: ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলাদেশে আধিপত্য বিস্তার বিশ্বের ইতিহাসে জঘন্য কলঙ্কিত ঘটনা। সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক নীতির জন্য ইংল্যান্ড বিশ্বের বুকে 'বেনিয়া' নামে খ্যাত। ইউরোপীয় রেনেসাঁর ফলে অনবদ্য প্রাণশক্তি সঞ্চার করে ইউরোপের বিভিন্ন জাতি ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। ব্যবসা সূত্রে প্রবেশ করে পরে শাসনক্ষমতা দখল করে।

 ২১৮ জন ইংরেজ বণিক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠন করে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে। তারা ব্রিটেনের রাণী এলিজাবেথের কাছ থেকে ১৫ বছরের সনদ নিয়ে ভারতে বাণিজ্য করতে আসে।কোম্পানির মূল লক্ষ্য ভারতবর্ষের শাসনক্ষমতা- বাণিজ্য তাদের উপলক্ষ মাত্র। তাই ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে মুঘলদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণের অনুমতি লাভ করে এবং শান্তির নীতি পরিত্যাগ করে তারা যুদ্ধের নীতি গ্রহণ করে। 

বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে তারা মুঘল সৈন্যকে ক্ষেপিয়ে তুলে। তাদের ঔদ্ধত্য আচরণে এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার কারণে আওরঙ্গজেব বোম্বাই আক্রমণের নির্দেশ দেয়। কোম্পানি পরাজিত হয় এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে (এটা তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য)। কোম্পানি ক্ষ

408

বাণিজ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রসার বেড়ে যায়। ফলে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ১৬৯৮ সালে আইন প্রণয়ন করে আরেকটি কোম্পানি গঠন করে ভারতবর্ষে পাঠিয়ে দেয়। স্যার উইলিয়াম নরিসের নতুন কোম্পানি খুব সংগত কারণেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। বেনিয়ার জাত ইংরেজ বুঝতে পারে যে, এ ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তাদের নিজেদেরই ক্ষতি। তাই দুটি কোম্পানি ভেঙে তারা একটি কোম্পানিতে পরিণত হয়, নাম CH"The joint company of merchants of England trading to the East Inds". এ সংযুক্ত কোম্পানি অবাধে বাণিজ্য চালিয়ে যায় এবং ১৭০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নামে এক সুরক্ষিত দুর্গ কলকাতায় নির্মাণ করে।

বাংলার সুবাদার তখন আজিমুশশান। এ সময় তাদের তুলনায় কোম্পানি অনেক বেশি বাণিজ্যিক সুবিধা ভোগ করে। কলকাতা হতে কোম্পানি স্থানীয় সরকারের ওপর নানামুখী চাপ সৃষ্টি করে, কখনও শক্তি প্রয়োগ করে আবার ঘুষ ও দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্পূর্ণ নিজেদের দখলে আনতে সক্ষম হয়। 

কোম্পানির এসব আচরণে বাংলার দেওয়ান মুর্শিদকুলী খাঁ ক্ষেপে যান এবং কোম্পানির সাথে তার সংঘাত শুরু হয়।

ইতোমধ্যে আওরঙ্গজেব ও তার পুত্র বাহাদুর শাহ উভয়েরই মৃত্যু হয়েছে। ফলে ১৭১৩ সালে সিংহাসনে বসেন ফররুখ শিয়ার। ১৭১৫ সালে ফররুখ শিয়ার খুব অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে অস্ত্র চিকিৎসা করে সুস্থ করলেন ইংরেজ ডাক্তার হ্যামিলটন। সম্রাট খুশি হয়ে হ্যামিলটনের অনুরোধে ইংরেজকে এদেশে অবাধ বাণিজ্যের ফরমান দিলেন। ফরমানের মূল কথা হল-

اد

Q

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বার্ষিক মাত্র তিন হাজার টাকা রাজস্ব দানের পরিবর্তে ১) সারাদেশে বিনা শুল্কে বাণিজ্য করবে।

কলকাতার আশপাশের আরও ৩৮টি গ্রামের জমিদারির সনদ কোম্পানি পাবে। কোম্পানির কোনও জাহাজকে কোনও রকম অজুহাতে শুল্ক চৌকিতে আটক করা যাবে না। 8 কোম্পানির মালামাল চুরি হলে সরকার তা ফেরত দেয়ার চেষ্টা করবে।

Q

কোম্পানি মুর্শিদাবাদের টাকশালে নিজস্ব টাকা তৈরি করবে

এ দেশীয় কর্মচারীদের বিচার করার অধিকার কোম্পানির থাকবে

বাংলায় ইংরেজদের অবাধ বাণিজ্য ও দুর্গ নির্মাণের ঘোর বিরোধিতা করেন নবাব আলিবর্দী খাঁ। আলিবর্দী খাঁর আমলে ইংরেজদের অবাধ বাণিজ্যের বিষয় বাধাগ্রস্ত হয়। ফররুখ শিয়ারের দেয়া সুযোগ আলিবর্দী খাঁ কেড়ে নেন। সন্ধিচুক্তির মাধ্যমে ইংরেজের ক্ষমতা খর্ব করা হয়, তবে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ বঞ্চিত হয় না।

নবাব আলিবর্দী খাঁ ইংরেজ ও ফরাসিদের এ দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ দিলেও দুর্গ নির্মাণের কোন অধিকার দেন নি। কিন্তু খাঁ সাহেবের মৃত্যুর পর মাঠ ফাঁকা মনে করে ইংরেজ ও ফরাসিরা চন্দননগরে দুর্গ নির্মাণ শুরু করে। নতুন নবাব সিরাজ তাদের নিষেধ করেন। ফরাসিরা সে নিষেধ মানলেও ইংরেজ তা মানে নি এবং নবাবের দূতকে অপমান

করে।

ইংরেজ নবাবের সাথে কোন সৌজন্যমূলক আচরণ করে নি, তাকে উপঢৌকনও পাঠায় নি। ইংরেজ যে অর্থনৈতিক সুবিধা পায় তা সিরাজের বিরুদ্ধেই ব্যয় করে। সিরাজ বাধ্য হয়ে সৈন্য সামন্ত নিয়ে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ আক্রমণ করে। ইংরেজ পরাস্ত হয়। প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র দেখে সিরাজ অবাক । তারা জবাব দেয় যে, দেশীয় শত্রু ফরাসিদের কাছ থেকে আত্মরক্ষার জন্য এসব অস্ত্র। 

ইংরেজ ক্ষমা চায় এবং সিরাজ তাদের ক্ষমা করেন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ইংরেজ সুযোগের সন্ধানে থাকে এবং সিরাজের বিপক্ষীয়দের খুঁজে ফেরে। পূর্ণিয়ার শওকত জঙ (ঘসেটির পালিত পুত্র) নবাবের বিরুদ্ধে। ঘসেটি ও শওকত জঙ ষড়যন্ত্রের সাথী। ওদিকে জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, রাজবল্লভ নবাব আলিবর্দীর আমল থেকেই স্বেচ্ছাচারে লিপ্ত, কিন্তু আলিবর্দী এদের অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। সিরাজও সে পথ ধরায় এরাও সিরাজের বিরুদ্ধে ইংরেজদের ষড়যন্ত্রের সাথী।

ইতোমধ্যে সিরাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করায় কৃষ্ণদাস রাজ্যচ্যুত হয় কিন্তু ইংরেজ তাকে আশ্রয় দেয়। ইংরেজের কাছে নবাব কৃষ্ণদাসকে ফেরত চান কিন্তু ইংরেজ তাকে দেয় না। সিরাজ ইংরেজদের ওপর ক্ষুব্ধ হন।

। বাংলা নাটক-১ সিরাজউদ্দৌলা

৭০৫ মাদ্রাজ থেকে রবার্ট ক্লাইভ এবং নৌসেনাপতি ওয়াটসন কলকাতা পরাজয়ের খবরে কলকাতা আসেন। নবাব তাদের দমনের জন্য সৈন্য পাঠান। কিন্তু নবাব দেখেন চারদিকে ষড়যন্ত্র, এ সময় যুদ্ধ বাঞ্ছনীয় নয়, ইংরেজরাও দেখে যে, ইউরোপ থেকে আরও অস্ত্রশস্ত্র আনা প্রয়োজন, তাই উভয়ের নিজ নিজ সুবিধার কারণে যুদ্ধ না হয়ে সন্ধি হয়, এ সন্ধিকে আলীনগর সন্ধি বলে।

সন্ধির অবসরে ইংরেজ ইউরোপ থেকে গোপনে অস্ত্র আমদানি করে। ইংরেজ চিকিৎসক হলওয়েল সিরাজের শাসনকে কলঙ্কিত করতে বীভৎস কাহিনী রাজ্যে রটায়। সে বলে যে, ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ দখলের পর সিরাজ ১৪৬ জন ইংরেজকে বন্দী করে কৃপ সদৃশ ছোট একটি কক্ষে রেখে দেয়, যাতে ১২৩ জন শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেছে।

এভাবে সত্য, মিথ্যা দিয়ে ইংরেজ সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে। ইতোমধ্যে সিরাজ মীরজাফর, উমিচাঁদ, জগৎশেঠ, রাজবল্লভ সবাইকে নিয়ে এক মিটিংয়ে তাদের সামনে দেশপ্রেমের দোহাই তুলে ইংরেজের হাত হতে বাংলাকে রক্ষা করার আবেদন জানান। সবাই ধর্মগ্রন্থ স্পর্শ করে দেশমাতৃকার স্বাধীনতা রক্ষায় সিরাজের পক্ষে

থাকার প্রতিজ্ঞা করে।

ইংরেজদের পক্ষে ষড়যন্ত্র পরিপক্। অস্ত্রশস্ত্রও এসে গেছে। ক্লাইভ তখন সন্ধিভঙ্গের মিথ্যা অভিযোগে সিরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।

ভাগ্যের নির্মম পরিহাস - উদার, সরল, মহৎপ্রাণ সিরাজ মীরজাফরের প্রার্থনা অনুযায়ী এ যুদ্ধের সেনাপতিত্বের দায়ভার দেয় মীরজাফরের ওপর।

পলাশী ২৩ জুন ১৭৫৭। ইংরেজ সৈন্য সংখ্যা তিন হাজার। সিরাজের পক্ষে পঞ্চাশ হাজার। যুদ্ধ শুরু হল। সিরাজের পক্ষে মীর মর্দান, ফরাসি বীর সাঁফ্রে, মোহনলালরা প্রাণপণ লড়ল। কিন্তু বিরাট সৈন্যবাহিনী সেনাপতি জাফর আলী ধার নির্দেশে নিষ্প্রাণ মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকল। পলাশীতে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় ঘটল।

 সিরাজ আবার সৈন্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে গোপনে পাটনায় যাত্রা করলে পথে ধৃত হলেন। নিক্ষিপ্ত হলেন কারাগারে। সেখানে মীরজাফরের পুত্র মীরনের আদেশে মোহাম্মদী বেগের হাতে নবাব নিহত হন।

বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা স্বাধীনতা হারায়, ইংরেজ কোম্পানির ক্ষমতা ও মর্যাদা বেড়ে যায়। ইংরেজ হয়ে ওঠে এদেশের শাসনকর্তা ত্রাণকর্তা, যদিও তারা মীরজাফরকে ক্ষমতায় বসায় কিন্তু সে ইংরেজের হাতের পুতুল মাত্র, মূল ক্ষমতা ক্লাইভ কুক্ষিগত করে।

সিকান্দার আবু জাফর উপযুক্ত ঐতিহাসিক পটভূমিতে রচনা করেন "সিরাজউদ্দৌলা'

নাটক ।তিপূরণ বাবদ দেড় লক্ষ টাকা এবং অধিকৃত এলাকা সম্রাটকে ফেরত দিয়ে শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করে ।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ