দীনবন্ধু মিত্রের নীল দর্পণ' নাটকের নামকরণের সাফল্য বিচার কর

দীনবন্ধু মিত্রের নীল দর্পণ' নাটকের নামকরণের সাফল্য বিচার কর 

দীনবন্ধু মিত্রের নীল দর্পণ' নাটকের নামকরণের সাফল্য বিচার কর
দীনবন্ধু মিত্রের নীল দর্পণ' নাটকের নামকরণের সাফল্য বিচার কর 

 উত্তর :যে কোন শিল্পকর্মের নামকরণ দর্পণের মত। নামকরণের ভিতর তার অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যগুলো প্রতিভাত হয়। শিল্পীকে তাই নামকরণের বিষয়ে প্রযত্নবান থাকতে হয়। নাটক শিল্পকর্মের সমৃদ্ধ ও জনপ্রিয় শাখা। 

সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মত- কাহিনীর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য, স্থান-কাল বা বিষয়বস্তু, নায়ক-নায়িকা বা কেন্দ্রীয় চরিত্র, মূল প্রতিপাদ্য বিষয় প্রভৃতির যে কোন একটি দিককে অবলম্বন করে নাটকের নামকরণ করা হয় ।দীনবন্ধু মিত্র (১৮৩০-১৮৭৩) বাংলা নাট্য সাহিত্যের প্রথম মাটির কাছাকাছির শিল্পী।

সমকালীন শিল্পীদের মধ্যে তিনি ছিলেন যেমন মানবদরদি, তেমনি স্পষ্টবাদী। সত্য প্রকাশে অকুতোভয়। তাঁর শ্রেষ্ঠ নাটক 'নীল দর্পণ' (১৮৬০)। এ নাটক বাংলাদেশের নীলচাষ, নীলকরদের অত্যাচার এবং অংশত নীল আন্দোলনের দর্পণ। শুধু সাহিত্যকর্ম হিসেবেই নয়, প্রজাপীড়নও নীল আন্দোলনের ভাষ্যরূপে এ নাটকের একটি বিশিষ্ট ভূমিকা রয়েছে।

 এ নাটকের কাহিনীতে বাংলার কৃষকদের উপর নীলকরদের অত্যাচারের চালচিত্র চিত্রিত হয়েছে। নাটকের নাম থেকে বোঝা যায় এ নাটক নীলকরদেরই প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশে নীলচাষকে ঘিরে নীলকরদের অত্যাচারের ইতিহাস দীর্ঘসময়ের, কিন্তু প্রথমবারের মত দীনবন্ধুর এ নাটকে নীলকরের অত্যাচারের মর্মন্তুদ দৃশ্য উঠে এসেছে। দীনবন্ধু মিত্র নিজেই নাটকের ভূমিকায় লিখেছেন- “নীলকর-নিকর করে, নীল দর্পণ অর্পণ করিলাম। 

এক্ষণে তাহারা নিজ নিজ মুখ সন্দর্শন পূর্বক তাঁহাদিগের ললাটে বিরাজমান স্বার্থপরতা কলঙ্কতিলক বিমোচন করিয়া তৎপরিবর্তে পরোপকার শ্বেত চন্দন ধারণ করুণ তাহা হইলেই আমার পরিশ্রমের সাফল্য, নিরাশ্রয় প্রজাদের মঙ্গল।।।।।।। তোমরা যেসাতিশয় অত্যাচার দ্বারা বিপুল অর্থলাভ করিতেছ, তাহা পরিহার কর ঃ তাহা হইলে অনাথ প্রজারা সপরিবারে অনায়াসে কালাতিপাত করিতে পারিবে।”নীল প্রধান রপ্তানি দ্রব্য বলে বিবেচিত হওয়ায় এবং নীল ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় সারা বাংলায় নীলকুঠি স্থাপিত হয়।

 বাংলার জমি নীলচাষের বিশেষ উপযোগী বলে কৃষকদেরকে নীলের দাদনে বাধ্য করা হতো। নীলকরদের জবরদস্তিতে নীলচাষ করতে কৃষকরা বাধ্য হলেও তারা উচিত মূল্যের এক শতাংশও পেত না। নীলচাষে অসম্মত কৃষকদের গরুবাছুর ধরে আটকানো হতো, তাদেরকে ধরে এনে চাবুক মারত, তাদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিত, তাদের যুবতী কন্যা- সুন্দরী স্ত্রী ধরে এনে ভোগ করত। সমগ্র নীলচাষ ব্যবস্থার ভিত্তি ছিল ভূমিদাসত্ব ও বেগার শ্রম।'নীল দর্পণ' নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রের বাস্তব অভিজ্ঞতার ফসল। ডাকবিভাগের কাজের জন্য দীনবন্ধুকে বাংলার বিভিন্ন স্থানে বিশেষত নদীয়া ও যশোর জেলার বিভিন্ন স্থানে গতায়ত করতে হয়। 

এ সময় কৃষকদের ওপর নীলকরদের অবর্ণনীয় অত্যাচার তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন । অত্যাচারিত কৃষকদের দুঃসহ জীবন ধারা তাঁর শিল্পীমনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। নিজের দেখা বাস্তব কাহিনীকে তিনি তুলে আনেন তাঁর 'নীল দর্পণ' নাটকে ।গোলকবসু স্বরপুর গ্রামের সম্পন্ন গৃহস্থ। তার বড় ছেলে নবীন মাধব বিষয়কর্ম দেখাশোনা করে। স্বরপুর গ্রামে নীলকরের ব্যাপক দৌরাত্ম্য আরম্ভ হয়েছে। যারা স্বেচ্ছায় নীলকরদের কাছ থেকে দাদন নিচ্ছে না, তাদেরকে ইতর ভদ্র নির্বিশেষে কুঠিতে ধরে নিয়ে নীলকরেরা যথেষ্ট মারপিট করছে। গোলকবসু পঞ্চাশ বিঘা জমিতে নীলচাষ করে দু'টি পয়সাও পায় নি। অথচ নীলকরের নির্দেশ ষাট বিঘায় এবারও নীলচাষ করতে হবে। এতে তাকে সপরিবারে নিরন্ন থাকতে হবে। সাহেব তাদের কোন কথাই শুনছে না।গোলকবসুর প্রতিবেশী সাধুচরণের কন্যা প্রথম অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় পিত্রালয়ে এসেছে। রোগ সাহেব সাধুচরণ ও রাইচরণকে নীলের কারণে ধরতে এসে ক্ষেত্রমণিকে দেখে তার লোভ হয়।

 শেষে জোর করে তাকে তুলে নিয়ে তার সম্ভ্রম নষ্ট করে এবং শেষে সে মারা যায়। দরিদ্র প্রজাদেরকে নীলকরদের হাত হতে রক্ষা করতে নবীন মাধব সচেষ্ট, নবীনমাধবের ওপর আক্রোশবশত গোলকবসুর নামে ফৌজদারি মোকদ্দমা জুড়ে দিয়ে তাকে হাজতে দেয় । ক্ষোভে দুঃখে গোলকবসু আত্মহত্যা করে। নীলকরেরা গোলকবসুর পুকুর পাড় পর্যন্ত নীলচাষ সম্প্রসারিত করে। নবীন মাধব বাধা দিতে গেলে তাকে অপমানকর কথা বলায় সে নীলকর সাহেবের বুকে সজোরে আঘাত করে। নবীন মাধবকে মেরে আধমরা করা হয়। অতঃপর নবীন মাধবও মারা যায়। পুত্রশোকে মা উন্মাদিনী হয়। উন্মাদ অবস্থায় পুত্রবধূকে হত্যা করে এবং সম্বিত ফিরে পেয়ে অনুশোচনায় নিজেও আত্মহত্যা করে। নাটকটিতে অবস্থা সম্পন্ন কৃষক ও দরিদ্র কৃষক সবাই নীলকরের শিকার। নাটকটির চরিত্রগুলোর যে দুর্বিষহ যন্ত্রণা, দীর্ঘশ্বাস- সবই নীলকরদের অত্যাচারকে ঘিরেই। 

গোলকবসুর সোনার সংসার পুড়ে ছারখার, সাধুচরণের ছোট সংসারে কন্যা-জায়াকে নিয়ে যে সুখ তা চিরতরে উবে গেল। এমনি করে বাংলার শত সহস্র কৃষকের সংসার জীবন অন্তসারশূন্য হয়ে দাঁড়িয়েছে নীলকরদের কারণে। নাটকটির প্রত্যেকটি চরিত্র প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নীলচাষের শিকার। যে ভ্রষ্টা পদী ময়রানী, যার কারণে ক্ষেত্রমণির জীবন নাশ হলো- সেও নীলকরদের শিকার।বাংলার ইতিহাসে নীলকর শাসক-শোষক ও অত্যাচারী রূপে আবির্ভূত হয়েছে। তাদের ক্ষমতা অত্যাচারে বাংলার মাটি হয়েছে কম্পিত ও কলঙ্কিত। তাদের লালসার লেলিহান শিখায় শতসহস্র কৃষক জীবন হারিয়েছে, ঘরবাড়ি হারিয়ে হয়েছে সর্বহারা। বাংলার শত সহস্র নারী ইজ্জত সম্ভ্রম হারিয়েছে। তাদের বিলাসের হোলি খেলায় রক্তে রঞ্জিত হয়েছে বাংলার পথ প্রান্তর। 

তাদের তাণ্ডব নৃত্যের ঝাপটায় নিভে গেছে কত প্রাণ প্রদীপ । নিপীড়িত মানবতার ক্রন্দন রোলে আকাশ বাতাস শান্ত ও ম্লান হলেও নীলকর শোষকের হৃদয় টলে নি। লাঠিয়ালের ভয় দেখিয়ে তারা তাদের কার্য সিদ্ধ করেছে।দুর্পণে যেমন আমরা হুবহু ছবি দেখতে পাই তেমনি লেখকের এ নাটকে আমরা নীলকরদের অত্যাচার ও কৃষকদের বিদ্রোহের চিত্র স্পষ্ট দেখতে পাই। তদুপরি নীলকরদের অত্যাচারে কাহিনীর মৌল চরিত্রগুলোর জীবনে নেমে এসেছে ট্র্যাজিক পরিণতি । নাটকটির আপাদমস্তক নীলকরদের দৌরাত্ম্যে কম্পমান। উনিশ শতকের নীলকরদের তথা নীলচাষের চালচিত্র নাটকে ফুটে উঠেছে, তাই এ নাটকের নাম 'নীল দর্পণ' সর্বৈব সাফল্য পেয়েছে। সমসাময়িক বিক্ষুব্ধ গণজীবনের ওপর নির্যাতনের ভাষ্য হিসেবে 'নীল দর্পণ' নামটি বিশেষ মর্যাদায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ