রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আমেরিকার সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম আলোচনা কর
রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আমেরিকার সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম আলোচনা কর
প্রশ্ন ২.২৬ | রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আমেরিকার সমাজসেবামূলক কর্মসূচির বর্ণনা দাও।
অথবা, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আমেরিকার সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম আলোচনা কর।
উত্তর ভূমিকা : বর্তমান বিশ্বের কল্যাণরাষ্ট্রসমূহের মধ্যে আমেরিকা অন্যতম। আমেরিকা তার সুবিন্যস্ত ও সংগঠিত সমাজসেবামূলক কার্যকলাপের মাধ্যমে কল্যাণরাষ্ট্রের তকমা অর্জন করেছে। অতীতকাল থেকেই আমেরিকা তার জনগণের উদ্ভূত প্রয়োজন পূরণের জন্য সরকারিভাবে নানা ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে । আমেরিকা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গৃহীত সমাজসেবামূলক কার্যক্রমগুলোর বাস্তবায়নের পথপ্রশস্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে ।
রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আমেরিকার সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম আলোচনা কর |
রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আমেরিকার সমাজসেবামূলক কার্যক্রম : নিম্নে আমেরিকায় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গৃহীত সমাজসেবামূলক কার্যক্রমগুলো আলোচনা করা হলো—
১. মানসিক প্রতিবন্ধীদের জন্য সেবা : আমেরিকার মানসিক প্রতিবন্ধীদের বাস্তব অবস্থা তুলে ধরার ক্ষেত্রে ফ্রিডল্যান্ডারের যুক্তিটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, "They were kept at home without proper care or were committed to jails or poor houses whenever their tamilies were unable or unwilling to keep them." অর্থাৎ, মানসিক প্রতিবন্ধীদের অযত্নে বাড়িতে রাখা হতো অথবা তাদের জেলখানায় প্রেরণ করা হতো যদিও তাম্যাসাচুয়েটস ও নিউইয়র্ক শহরে মানসিক প্রতিবন্ধীদের ব্যাপারে প্রথম গবেষণা কর্ম পরিচালিত হয়। বোস্টনে মানসিক প্রতিবন্ধী যুবকদের জন্য সরকারি স্কুল খোলা হয়। এসব স্কুলে খেলার ছলে মানসিক প্রতিবন্ধী এসব যুবকদের প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করা হয় ।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৮৭৫ সালে আমেরিকার অন্যান্য রাজ্যগুলোতেও অনুরূপ স্কুল স্থাপন করা হয়। এসব স্কুলে মানসিক প্রতিবন্ধীদের শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মানসিক প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ড. স্যামুয়েল গ্রিডলে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পেনসিলভিনিয়ায় ১৮৭৫ সালে মানসিক অনগ্রসর স্কুল স্থাপন করা হয় । সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় মানসিক প্রতিবন্ধীদের জন্য গৃহীত সবচেয়ে বড় উদ্যোগ হলো ১৯৭০ সালে প্রণীত The Development Disabilities Service Act' এ আইনের মাধ্যমে মানসিক প্রতিবন্ধীদের ভরণপোষণে রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের যৌথ উদ্যোগ গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। এ আইনের মাধ্যমে মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত সবার জন্য চিকিৎসা ও শিক্ষাসহ সব ধরনের মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা গৃহীত হয় ।
২. অন্ধদের সেবা : আমেরিকায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অন্ধদের ভরণপোষণের জন্য ব্যাপকভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় । প্যারিসে অন্ধদের জন্য প্রতিষ্ঠিত স্কুলের আদলে ম্যাসাচুয়েটসে 'অন্ধ স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। ম্যাসাচুয়েটসে প্রতিষ্ঠিত এ অন্ধদের পরিবারের সদস্যরা তাদেস্কুলের পরবর্তী নামকরণ করা হয় Perkins Institute and marsachuts School for the Blind. ১৮৩২ সালে নিউইয়র্কে অন্ধদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। আমেরিকায় অন্ধদের কল্যাণের জন্য আরেকটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়।
যার নামকরণ করা হয় The New York Institute for the Blind. ১৮৬৩ সালে এ স্কুলে French Baraile নামক অন্ধ শিক্ষা সহায়ক একটি পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। অন্ধদের জন্য কল্যাণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি অন্ধত্ব প্রতিরোধে প্রথম গুরুত্বারোপ করেন ড. পাক। যার প্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠা করা হয় National Society for the Prevention of Blindness. % প্রতিষ্ঠান থেকে শিশু জন্মপূর্ববর্তী ও পরবর্তী অন্ধত্ব প্রতিরোধে বিশেষ শিক্ষা ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এছাড়াও আমেরিকার হাসপাতালগুলোতে অন্যান্য রোগের পাশাপাশি চক্ষু প্রতিরক্ষা কর্মসূচির বিস্তার ঘটানো হয়। ১৯৩৫ সালে প্রণীত সামাজিক নিরাপত্তা আইনে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্য ও পুনর্বাসনে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় ।
৩. মনোবিকারদের জন্য সেবা : আমেরিকায় মনোবিকারদের সাথে প্রাথমিক পর্যায়ে অত্যন্ত নির্মম আচরণ করা হতো। ১৭৩২ খ্রিস্টাব্দে ফিলাডেলফিয়ার দরিদ্রাগারের হাসপাতালে মনোবিকারদের চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ১৭৫৩ খ্রিস্টাব্দে অনুরূপ ব্যবস্থা পেনসিভেনিয়াতেও গ্রহণ করা হয়। মনোবিকারদের জন্য প্রথম হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয় ভার্জিনিয়ায়। যার নামকরণ করা হয় Eastern State Hospital। আমেরিকায়র দায়িত্ব গ্রহণে অক্ষম বা অনিচ্ছুক ছিল ।মনোবিকারদের সেবায় ড. বেনজামিন রুশ, মিস ডরোথিয়া ডিক্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১৮৪১ সালে ডরোথিয়া ডিক্স জেলখানা পরিদর্শন করে মহিলা কয়েদিদের করুণ অবস্থা দেখে অত্যন্ত ব্যথিত হন। পরবর্তীতে তিনি দরিদ্রাগার, শ্রমাগার ও জেলখানা পরিদর্শন করে মনোবিকারদের প্রতি অমানবিক আচরণ লক্ষ করেন। পরবর্তীতে ডিক্স এর প্রচেষ্টায় মনোবিকারদের কল্যাণের জন্য আইনসভায় একটি বিল পাস হয়। ডিক্সের প্রচেষ্টায় পরবর্তীতে মনোবিকারদের জন্য মানসিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়। তার আবেদন ও প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে ১৮৫৪ সালে কংগ্রেসে মানসিক বিকারদের জন্য আইন প্রণয়ন করে জমি অনুদান দেওয়া হয় ।
৪. মূক ও বধিরদের জন্য সেবা : আমেরিকায় মূক ও বধিররা ছিল অবহেলার পাত্র। ফ্রিডল্যান্ডারের মতে, এসব মূক ও বধিরদের নির্বোধ বলে আখ্যায়িত করা হতো। মূক ও বধিরদের কল্যাণের জন্য আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। মূকদের জন্য ১৮১৭ সালে হার্ডফোর্ড শহরে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়। মূক ও বধিরদের জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ১৮২৩ সালে বেন্টকির ড্যানবিলে বোবাদের জন্য প্রথম আবাসিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ জাতীয় স্কুল পরবর্তীতে অন্যান্য শহরেও করা হয়। মূক ও বধিরদের কল্যাণে ১৮৬৯ সালে সর্বপ্রথম দিবা স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয় । মূক ও বধির সমস্যার প্রতিকার ও প্রতিরোধের জন্য American Society for the Hard of Hearing প্রতিষ্ঠা করা হয় । এসব প্রতিষ্ঠান থেকে মূক ও বধিরদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয় এবং শ্রবণযন্ত্র সরবরাহ করা হয় ।
৫. রাজ্য দরিদ্র সেবা : আমেরিকাতে প্যারিশ বা কাউন্টির স্থানীয় জনগণের কল্যাণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো। প্যারিসে নবাগত দরিদ্র বা কোনো কারণে বহিষ্কৃত দরিদ্রদের ভরণপোষণের জন্য কোনো ব্যবস্থা গহণ করা হতো না। এ জাতীয় শর্তের কারণে ম্যাসাচুয়েটসে ত্রাণ কার্যক্রমে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্ম হয়। এ অবস্থায় ১৬৭৫ খ্রিস্টাব্দে ম্যাসাচুয়েটসের দরিদ্রদের 'রাজ্য দরিদ্র' হিসেবে আখ্যায়িত করে সাহায্য প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। আমেরিকার অন্যান্য কলোনিতেও এ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এ জাতীয় সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য সরকার দরিদ্রদের জন্য রাজ্য দরিদ্র সেবা ব্যবস্থা চালু করেন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আমেরিকার বর্তমান সমাজসেবামূলক কার্যক্রমের পরিসর বহুদূর পর্যন্ত প্রসারিত। আমেরিকায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গৃহীত সমাজসেবামূলক কার্যক্রমগুলো সময়ের ক্রমবিবর্তন পেরিয়ে আজকের এ সমৃদ্ধ অবস্থানে এসেছে। এ জাতীয় সমাজসেবামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় ।