লায়লী-মজনু' কাব্যের বৈশিষ্ট্যগুলি লেখ
লায়লী-মজনু' কাব্যের বৈশিষ্ট্যগুলি লেখ।
![]() |
উত্তর:মধ্যযুগের সাহিত্যক্ষেত্রে লায়লি-মজনু কাব্য নানাগুণে অনন্য। এ কাব্য বাল্যপ্রেমে অভিশপ্ত দুই বিরহী হৃদয়ের রক্তক্ষরা বেদনার জমাট অশ্রু। এর গীতোচ্ছ্বাস, এর কারুণ্য, এর নীতিনিষ্ঠ মানবিকতা অভিভূত করে পাঠককে।
অনুরাগে প্রেমের উন্মেষ, বিরহে তার বিকাশ, কিন্তু মিলনেই তার সার্থকতা। সে প্রেম মিলনমুখী নয়, তাতে আছে কেবল দাহ, মন-আত্মা দেহের অপমৃত্যুই তার পরিণাম । লায়নী-মজনু কাব্যে বিরহানলে দণ্ড দুটো হৃদয়ের জ্বালা যন্ত্রণার ইতিকথা পরিব্যক্ত। যুগ-দুর্লভ ছয়টি গুণে লায়লী-মজনু কাব্য অনন্য ।
লায়লী-মজনু কাব্য যথার্থ ট্রাজেডি। আত্মবিশ্বাস, আদর্শনিষ্ঠা, সহনশীলতা, প্রত্যয় দৃঢ়তা, তিতিক্ষা, সাহসিকতা এবং নির্যাতনপ্রসূত কারুণ্য ও যন্ত্রণাজাত বেদনা এ কাব্যে বিবৃত। আঘাত, ব্যর্থতা, রক্তঝরা ক্ষত, হৃদয়ের গভীরতর বেদনা, আর প্রেমাষ্পদের জন্য জীবন বিসর্জন এ বাক্যকে গভীর ট্র্যাজিক করে তুলেছে।
এ কাব্য-কাহিনী অলৌকিকতামুক্ত প্রায় স্বাভাবিক জীবনভিত্তিক। নগদ বনের শ্বাপদের মজনু প্রীতিতে, অঙ্গের চর্মে ও রক্তে পত্র রচনায়, দৌবারিকের হস্ত অবশতায় এবং গন্ধ শুকে কবর সন্ধানে অলৌকিকতার ছায়া থাকলেও যোগী সন্ত দরবেশের কেরামতিতে আস্থাবান লোকের কাছে তা হয়তো অসামান্য, কিন্তু অস্বাভাবিক নয়। কাজেই বলা যায়, লায়লী-মজনু কাব্যে কোথাও অতিপ্রাকৃত ঘটনা জাল বোনা নেই। লায়লী-মজনু আমাদের গাথা বা গীতিকা সাহিত্যের সমগোত্রীয়।
এ কাব্য আশ্চর্য রকমে অশ্লীলতামুক্ত। ষোলশতক অবধি বাঙলা সাহিত্য ভাবে, ভাষায় ও বর্ণন ভঙ্গিতে সাধারণভাবে গ্রাম্য আবহে লালিত। দৌলত উজীরের কাব্যে আমি প্রথম নাগরিক ভব্যতার, মননশীলতার ও শিল্পরুচির সুপ্রকাশ প্রত্যক্ষত হয়। পুরো কাহিনীর বিষয় আদিরসাশ্রিত কিন্তু কবি শৃঙ্গার রসের বীভৎসতা সুকৌশলে এড়িয়ে
গেছেন। এখানে রূপজমোহ ও দেহজ প্রেম মানস আস্বাদনের স্তরে উন্নীত। এ কাব্যের প্রেম সান্নিধ্য পিপাসু, ভোগবাসী নয়, এ প্রেম পাগল করে, প্রাণে মারে কিন্তু উচ্ছৃঙ্খল করে না ।
লায়লী-মজনু নিছক মানবিক উপাখ্যান। এ কাব্যের আখ্যানকে কবি লৌকিক রূপ দিয়েছেন, রূপক রাখেন নি। কাব্যটির অনুকৃতি মেলে বাঙলার নরনারীর চিরন্তন, রূপজ, দেহজ ও কামজ আকর্ষণের ইতিবৃত্ত। জীবনকে ভালবেসে জীবনকে সত্য বলে জানা হয়েছে এখানে, কোন বৃহত্তের সাধনায় তার সায় নেই।
লায়লী-মজনু — নিযামী, খসরু বা জামির কাব্যের অনুবাদ নয়। এঁদের যে কোন একজনের রচনার স্বাধীন অনুসৃতি বা লোক শ্রুত পুরানো কাহিনীর স্বাধীন রূপায়ণ। এ হিসেবে লায়লী-মজনু মধ্যযুগের আখ্যায়িকা সাহিত্যে একটি বিশিষ্ট রচনা।
এ কাব্যের বিশেষ বৈশিষ্ট্য গীতিনাট্যের আকারে বিন্যন্ত ঋতু পর্যায় বর্ণনা লায়লী- মজনু কাব্যে বারোমাসকে ষড়ঋতুতে সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। এটি নামে হেতুবতী লায়লী সংবাদ, আকারে গীতিনাট্য, প্রকারে কামোদ্দীপক বটিকা এবং স্বরূপে সংবাদী প্রতিবাদী সংলাপ। উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্যগুলোর কারণে দৌলত উজির বাহরাম খার লাইলী-মজনু এক অনবদ্য ব্যতিক্রম।