স্বপ্ন কবিতার সার্থকতা আলোচনা কর

স্বপ্ন কবিতার সার্থকতা আলোচনা কর।
স্বপ্ন কবিতার সার্থকতা আলোচনা কর।

স্বপ্ন কবিতার সার্থকতা আলোচনা কর


উত্তর:বর্তমানের প্রত্যক্ষ ভিত্তি ও ব্যক্তিগত জীবনের ক্ষুদ্র পরিসরের উপর স্থাপিত রবীন্দ্রনাথের 'কল্পনা' কাব্য। কাব্যটি পরোক্ষ কল্পনার অসীম ও বৃহত্তর অতীত জীবনের বিরাট পাদপীঠের উপর দণ্ডায়মান। কবির চোখে কালপ্রবাহ অখণ্ড, তাঁর কাছে ভারতের অতীত ও বর্তমানে যেমন বিচ্ছেদ নেই, তেমনি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে গ্রথিত এই দুই কাব্য পর্যায় ।

মানুষ বিশ্বলোকে বসে স্বীয় শক্তিবলে সৃষ্টি করে শিল্পলোক। এই শিল্পলোকের অন্তর্গত সাহিত্যলোক— যা বিশ্বলোকের তুলনায় খাটো নয়, বরং বিরাটতর ব্যঞ্জনায় পূর্ণ। শিল্পীরা শিল্পনির্মাণে বিশ্বলোক ও শিল্পলোক হতে উপাদান সংগ্রহ করে। সাহিত্য রচনায় প্রকৃতির বর্ণ শব্দ গন্ধ গ্রহণ করা যেমন চুরি নয়, তেমনি কালিদাস ব্যাস-বাল্মীকির শিল্পজগৎ হতে উপাদান সংগ্রহ করা চুরি নয়। 'কল্পনা' এই শিল্পলোকের উপাদানে বহুল পরিমাণে গঠিত।

অন্য অনেক কাব্যে বর্তমান জীবন ও প্রকৃতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কবি বিশ্বলোক হতে সাহিত্য উপাদান সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু 'কল্পনা'য় কবির দৃষ্টি অতীতের দিকে— দুরবর্তী দেশ ও কালের দিকে, যে জীবন আজকের ভারতবর্ষ হতে নিঃশেষে অপসুত সেই জীবনের কাহিনী কবির বক্তব্য। কাজেই কবিকে সেই পুরাতন জীবনের সৌন্দর্য-জিজ্ঞাসু হয়ে শিল্প জগতের সাহায্য নিতে হয়েছে।

 এই সৌন্দর্যব্রতে কালিদাস তাঁর প্রধান সহায়। 'কল্পনা'র বহু কবিতায় বর্তমানের মহাকবি প্রাচীন কবিদের শিল্পজগতের চশমা দিয়ে অতীত জীবনকে দেখেছেন, ফলে তার রংটা শিল্পলোকের, কিন্তু দৃষ্টি পুরাতন নয়, অন্যের নয়, তা আধুনিক এবং রবীন্দ্রনাথের একান্তভাবে নিজস্ব

আধুনিক মন অত্যন্ত তত্ত্বপরায়ণ, কেবল সৌন্দর্যে তৃপ্ত নয়। কিন্তু প্রাচীন মন তত্ত্বজিজ্ঞাসু ছিল না, সুন্দর বস্তু দেখে, সুন্দর গল্প শুনেই সে খুশি। 'কল্পনা' কিন্তু অন্য কাব্যে সৌন্দর্যের সাথে কবির মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। কিন্তু 'কল্পনা'য় যখন কবি প্রাচীন জীবনে প্রবেশ করেছেন, তখন আধুনিক মুখের মনটা শান্ত করে নিছক শিল্পীর মতো সৃষ্টি করেছেন যা রবীন্দ্রনাথের বিশেষ শক্তির পরিচায়ক।

 প্রাচীন জীবনের মর্মের সাথে এমন নিবিড়ভাবে কবি নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন যাতে দৃষ্টিকে পর্যন্ত অতীত জীবনের অবিমিশ্র সৌন্দর্য দর্শনের উপযোগী করে ফেলেছেন। প্রাচীন ভারতের বিচিত্র জীবনের, অভিনব শিল্প জগতের যে খণ্ড - ছিন্ন অংশগুলো ইতস্তত কাব্যে পুরাণে পড়ে আছে, তা কবির চিত্তের যে সুর, যে চিত্র জাগ্রত করে দিয়েছে কল্পনার কবিতাগুলো তার সাথে কবির মানব ভাষায় উত্তর-প্রত্যুত্তর।

কল্পনার ভিত্তি প্রধানত অপরের অভিজ্ঞতা, তাই তা. সজীব, ক্রিয়াশীল, গতিমান নয়। কমল বন চলন্ত নদীতে সম্ভব নয়, মজে গিয়ে বন্ধ সরোবর হলে তার চারদিকে শৈবাল ও কমলে সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। কল্পনার অভিজ্ঞতা সেই অতীত জীবনের স্রোতচ্যুত বদ্ধ জলাশয়, স্থিতি যার বিশেষত্ব, গতি নয়। তাই এ কাব্য প্রসাদকলা সমৃদ্ধ। 'কল্পনা' এ ধারার কবিতাগুলো ইন্দ্রিয়ের দৌত্যেই আবদ্ধ ও সমাপ্ত। এর কবিতাগুলো রূপ, রস, শব্দ গন্ধে একেবারে নিটোল নিখুঁত।

'স্বপ্ন' কবিতায় কবিকে অনুসরণ করে আমরা প্রাচীন ভারতের সৌন্দর্যের চিররহস্যময় পুরীতে প্রবেশ করি। এ পুরী সামান্য, সমস্ত ভারতবর্ষ হলেও বিশিষ্টভাবে উজ্জয়িনী। উজ্জয়িনী প্রাচীন ভারতের শ্রেষ্ঠ কবির রাজধানী উজ্জয়িনী কালিদাসের কল্পনায় অত্যুজ্জ্বল হয়ে তাঁর কাব্যে এবং তৎপরে সমগ্র কাব্যামোদীর কল্পলোকে অমর হয়ে আছে। 

রবীন্দ্রনাথের কাছে সংস্কৃত সাহিত্য বলতে প্রধানত কালিদাসকেই এবং প্রাচীন ভারতের জীবনযাত্রা বলতে উজ্জয়িনীর জীবনযাত্রাকেই বোঝায়। আজ উজ্জয়িনী স্বপ্ন, স্বপ্নের গুপ্ত দ্বার ছাড়া প্রবেশের পথ নেই। কবি তাঁর পূর্বজনমের প্রথম প্রিয়াকে উজ্জয়িনীপুরে খুঁজেছেন। সে প্রিয়ার মুখে লোথ্ররেণু, নীলাপর হাতে, কর্ণমূলে কুন্দকলি, চরণে নূপুর। এ বর্ণনার অভিজ্ঞতা উপাদান কালিদাসের, কবি তাকে নিজস্ব করে নিজ রসে সিক্ত করে প্রকাশ করেছেন।

ধীরে ধীরে নামি এল মোর মালবিকা কবিকে শুধিয়েছে— হে বন্ধু আছ তো ভালো। মুখে তার চাহি

কথা বলিবারে গেনু — কথা আর নাহি।

এখানেই ট্র্যাজেডি। উজ্জয়িনী তো দূরের কথা। জীবনে একদা যারা সর্বাপেক্ষা প্রিয় ছিল, মৃত্যুর পরপার হতে আজ তারা ফিরে এলেও পূর্বের সে আসন পাবে না। মৃতদের কাছ থেকে দাবি স্বাভাবিক, তারা বৃহৎ জীবনের একপাশে স্থির হয়ে আছে। কিন্তু জীবিতদের কাছে জীবনের আকর্ষণ বেশি, নতুন ব্যক্তি ও ভাব এসে তার শূন্য আসন দখল করে। মালবিকা আজও উজ্জয়িনীর সেই জীবনে আবদ্ধ।

 সে কবিকে কুশল জিজ্ঞেস করতে পারে, কিন্তু যে কবি বহু শতাব্দীর বিচিত্র অভিজ্ঞতার জীবন পাড়ি দিয়েছেন, তিনি স্বপ্নদ্বার অতিক্রম করলেও ভাষা আজ বিস্তৃত। এই প্রণয়ীযুগলের বিস্তৃতবাক বেদনাতেই কবিতাটির প্রাণ। কবি এ অতীত স্বর্গের উপভোগ করেছেন 'কল্পনা'তে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ