মীরজাফর চরিত্র বিশ্লেষণ কর
মীরজাফর চরিত্র বিশ্লেষণ কর।
![]() |
মীরজাফর চরিত্র বিশ্লেষণ কর |
উত্তর: বাংলার ইতিহাসে কুখ্যাত জঘন্য চিরকালের বিশ্বাসঘাতক চরিত্র মীরজাফর। তার পুরো নাম মীরজাফর আলী খান। ইন্দ্রিয় ভোগবিলাসী, আফিম ও ভাঙের নেশায় আসক্ত মীরজাফর পারস্যের লোক। জীবন-জীবিকার জন্য হিন্দুস্থানে এসে নবাব আলিবর্দীর কাছে সামান্য সৈনিকের চাকরি নেয়।
আলিবর্দীর বৈমাত্র বোন শাহ খানমকে মীরজাফরের সাথে বিয়ে দিয়ে আলিবর্দী তাকে সরকারি উচ্চপদে নিযুক্ত করেন। মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মীরজাফর যথেষ্ট কৃতিত্ব প্রদর্শন করে। তাছাড়া চতুর ও কৌশলী মীরজাফর তার চাতুর্য ও কৌশলো নবাবের স্নেহ লাভ করে শেষ পর্যন্ত প্রধান সেনাপতির পদে আসীন হয়। অর্থলোভ ও ক্ষমতালিপ্সা মীরজাফর চরিত্রের অভিজ্ঞান। ষড়যন্ত্রের ধাতুতে তার চরিত্র নির্মিত। নবাবকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অপরাধে এবং দুর্নীতির অভিযোগে মীরজাফর দু'দুবার পদচ্যুত হয়েছে।
বোন শাহ খানমের অনুরোধে আলিবর্দী খাঁ বার বার তাকে ক্ষমা করেছেন। আলিবর্দী খাঁর কোন পুত্র ছিল না। সেনাপতি মীরজাফর মনে মনে লালন করেছে আলিবর্দীর মৃত্যুর পর সে ক্ষমতায় বসতে পারবে। মীরজাফরের সংলাপ থেকে জানা যায় যে, আলিবর্দীর আমল থেকেই মসনদ তার স্বপ্ন—-নবদূত অনার্স বাংলা দ্বিতীয় বর্ষ“সফল করতে হবে আমার স্বপ্ন।
বাংলার মসনদ নবাব আলিবর্দীর আমলে, উদ্ধৃত সিরাজের আমলে মসনদের পাশে অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে আমি এই কথাই শুধু ভেবেছি, একটি দিন মাত্র একটা দিনও যদি ওই মসনদে মাথা উঁচু করে আমি বসতে পারতাম । " আলিবর্দীর মৃত্যুর পর সিরাজ মসনদে বসলে মীরজাফর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। সে খুঁজে পায় সিরাজের শত্রু ইংরেজ ও কিছু অর্থলোভী অমাত্যদের, তাদের স্বার্থপরতার সাথে যুক্ত হয় মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতা।
সিরাজকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজে বাংলার মসনদে বসতে মীরজাফর শঠতা, চাতুর্য ও পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরানকে ব্যবহার করে। কোরান স্পর্শ করে সে প্রতিজ্ঞা করে যে, আজীবন সে সিরাজের আজ্ঞাবহ হয়ে থাকবে।দক্ষ অভিনেতা মীরজাফর তার অভিনয় নৈপুণ্য দিয়ে সিরাজকে জয় করে এবং পলাশী যুদ্ধের প্রধান সেনাপতির পদ আদায় করে নেয়।মীরজাফরের কাছে মসনদই ধর্ম খোদা। তাই ইংরেজের সাথে চুক্তি করে নেয় যে, সিরাজের পতনে সে ইংরেজদের সহায়তা দেবে এবং ইংরেজ কোম্পানি তাকে মসনদে বসাবে।
ইংরেজের কাছে সম্পূর্ণ সমর্পিত হয়ে মীরজাফর পলাশীর যুদ্ধে সেনাপতি হওয়া সত্ত্বেও কোন যুদ্ধ পরিচালনা করে নি; বরং যুদ্ধরত হাজার হাজার দেশপ্রেমিক সৈনিককে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করতে পরামর্শ দেয়। মীর জাফরের নিষ্ক্রিয়তায় পলাশীতে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্ত যায়।মীরজাফর বাংলার নবাববিরোধী ষড়যন্ত্রের প্রধান হোতা।
বিশ্বাসঘাতক ও ব্যক্তিত্বহীন কুচক্রী হিসেবে মীরজাফরের স্থান ইতিহাসে নির্ধারিত। 'মীরজাফর' বিশেষ্য থেকে বিশেষণ পদের মর্যাদা পেয়েছে। বাংলার কেউ তার সন্তানের নাম মীরজাফর রাখে না।ক্ষমতার লোভই মীরজাফরকে বিশ্বাসঘাতকে পরিণত করেছে। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ স্পর্শ করে শপথ করেও সে লোভ সংবরণ করতে পারে নি। তবুও তার বিবেক একেবারে লোপ পায় নি। এজন্যেই সিরাজের ক্ষতি করতে গিয়ে, দেশের অনিষ্ট করতে গিয়ে সে হৃদয়ের মাঝে মরাকান্না শুনতে পায়। বলে – “সবাই মিলে সত্যিই আমরা বাঙলাকে বিক্রি করে দিচ্ছি না তো?”একই কারণে প্রকাশ্যে সিরাজের অপমান অথবা তার হত্যার আদেশ দিতে সে কুণ্ঠিত হয়। আবার অন্যদিকে কোম্পানির ক্ষমতা সম্পর্কেও সে অবগত।
তাই সে ভীরু, দুর্বল ও ব্যক্তিত্বহীন। এই ভীরুতা এবং দুর্বলতা তাকে মাঝে মাঝে ভাঁড়ের পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। সরাসরি বাংলার সিংহাসনে মাথা উঁচু করে বসার ক্ষমতা তার নেই। সে বলে – “কর্নেল সাহেব হাত ধরে তুলে না দিলে আমি মসনদে বসবো না।” তার এই ভাঁড়ামি দেখে ক্লাইভ পর্যন্ত মন্তব্য করে— No clown will ever beat him.সিংহাসন আরোহণ উপলক্ষে আয়োজিত সভায় মীরজাফরের উপস্থিত হতে বিলম্ব দেখে জগৎশেঠ ও রাজবল্লভের বিদ্রূপমিশ্রিত সংলাপের মধ্যদিয়ে মীরজাফরের চরিত্রের বেশ ক'টি দিক ফুটে ওঠে।
দর্জি নবাবের নতুন পোশাক দিতে দেরির প্রসঙ্গে জগৎশেঠ জানিয়েছে- “নবাব আলিবর্দীর মৃত্যুর পূর্ব দিন থেকেই মীরজাফর ভবিষ্যৎ নবাবের পোশাকটি তৈরি করে রেখেছেন। এ সংলাপে কুচক্রী মীরজাফরের দুরভিসন্ধিমূলক রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছেতাছাড়া দরবার কক্ষে প্রবেশে দেরি দেখে জগৎশেঠ আশঙ্কা প্রকাশ করে যে, মীরজাফর বোধ করি সিরাজউদ্দৌলার হারেমে প্রবেশ করেছে।
এতে মীরজাফরের ইন্দ্রিয়পরায়ণতার নগ্ন দিক ফুটে উঠেছে।সিরাজউদ্দৌলা বন্দী হয়েছেন, এ খবর শুনে মীরজাফর নবাবকে রাজধানীতে না এনে অন্য কোথাও কয়েদ রাখার প্রস্তাব দেয়। এর মধ্য দিয়ে মীরজাফরের দুর্বলচিত্ত উচ্চকিত হয়েছে।ক্লাইভের গাধা বলে পরিচিত, ইতিহাসে চিরকালের শ্রেষ্ঠ বিশ্বাসঘাতক বলে কুখ্যাত মীর জাফর ১৭৫৭ সালের ২৯ জুন কর্নেল ক্লাইভের হাত ধরে বাংলার মসনদে বসে এবং ১৭৬০ সালে তাকে গদিচ্যুত করে ইংরেজরা তার জামাতা মীর কাসিমকে বাংলার মসনদ উপহার দেয়।
১৭৬৪ সালে ইংরেজরা পুনরায় মীরজাফরকে সিংহাসনে বসায়।বাংলার স্বাধীনতা সংহারকারী এই সর্বজন ঘৃণ্য মানুষটি দুরারোগ্য কুষ্ঠ ব্যাধির অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করে সকলের কাছে ঘৃণ্য ও অস্পৃশ্য হয়ে ১৭৬৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি মারা যায়। কিন্তু মৃত্যুতেও তার অপকর্ম মুছে নি। শত শত বছর মানুষের কাছে সে ঘৃণ্য হয়ে বেঁচে আছে ও বেঁচে থাকবে।