১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পটভূমি ও ঘটনা প্রবাহের বিবরণ দাও

আসসালামু আলাইকুম প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা আজকে বিষয় হলো ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পটভূমি ও ঘটনা প্রবাহের বিবরণ দাও জেনে নিবো। তোমরা যদি পড়াটি ভালো ভাবে নিজের মনের মধ্যে গুছিয়ে নিতে চাও তাহলে অবশ্যই তোমাকে মনযোগ সহকারে পড়তে হবে। চলো শিক্ষার্থী বন্ধুরা আমরা জেনে নেই আজকের ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পটভূমি ও ঘটনা প্রবাহের বিবরণ দাও ।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পটভূমি ও ঘটনা প্রবাহের বিবরণ দাও
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পটভূমি ও ঘটনা প্রবাহের বিবরণ দাও

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পটভূমি, ঘটনা ও এর গুরুত্ব আলোচনা কর

উত্তর : ভূমিকা : ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বাঙালি জাতি তার অধিকার আদায়ের জন্য যতগুলো আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ভাষা আন্দোলন সেগুলোর মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে ১৯৫২ সালে বাঙালি জাতি ভাষা আন্দোলনে অবতীর্ণ হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সকল শ্রেণির মানুষ এ আন্দোলনের ডাকে সাড়া প্রদান করে। আর তাই জীবনের মায়া তুচ্ছ করে তারা নিজ ভাষার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য পূর্ব পাকিস্তানিরা পশ্চিম পাকিস্ত ানিদের বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়াই চালিয়ে গেছে। জীবন দিয়ে বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে গেছে।

→ ভাষা আন্দোলনের পটভূমি এবং ঘটনা প্রবাহ : ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন একদিনে সৃষ্টি হয়নি। বাঙালি জাতির উপর। অর্থাৎ তৎকালীন সময়কার পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানিদের উপর অনেক অত্যাচার করেছে, শোষণ নিপীড়ন সবকিছু মুখ বুজে মেনে নিলেও নিজের মাতৃভাষা বাংলাকেও যখন পশ্চিম পাকিস্তানিরা কেঁড়ে নিতে চেয়েছিল তখন তারা আর চুপ করে থাকতে পারেনি। তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের চেতনার উদয় ঘটে। ভাষা আন্দোলন সৃষ্টির পেছনে ব্যাপক ঘটনা বহুল বিষয় রয়েছে। আর এ বিষয়গুলো এবং ভাষা আন্দোলন সংঘটনের পটভূমি সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো :

১. পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষাকে সমর্থনদান : পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু হবে এ বিষয়ে তৎকালীন সময়কার বুদ্ধিজীবী এবং শিক্ষিত মহলে একটা আলোচনার সৃষ্টি হয়। ১৯৪৭ সালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মনোনীত করলেও ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহ বাংলা ভাষার পক্ষে তাঁর মতামত প্রকাশ করেন। ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ছাড়াও তৎকালীন সময়ের অন্যান্য লেখকগণও বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বেছে নেন। আর এ কারণে পূর্ব বাংলার শিক্ষিত সমাজ এবং ছাত্রসমাজের মধ্যে একটি ভিন্ন ধরনের চেতনার উদয় ঘটে। এসময় অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের পর এ ঘটনাগুলো যেমন শিক্ষিত সমাজের নজর কাড়ে তেমনি দেশের পত্র পত্রিকা এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গন বাংলা ভাষা পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সমর্থন দেয়।

২. পূর্ব পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক যুবলীগের সমর্থন : পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ নামক সংগঠনটি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিকে সাদরে গ্রহণ করে। ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর এক সম্মেলনে এ সংগঠনটি বাংলা ভাষার সপক্ষে যে সিদ্ধান্তগুলো দিয়েছিল তা ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। এ সংগঠনটি পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থা, আইনকানুন ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকে ব্যবহার করার দাবি জানায়। এছাড়াও পাকিস্ত ানের রাষ্ট্রভাষা বেছে নেওয়ার দায়িত্ব এবং অধিকার জনগণকে ন্যস্ত করার ব্যাপারেও উক্ত সম্মেলনে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এছাড়াও তমদ্দুন মজলিশ নামক একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনও বাংলা ভাষা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সমর্থন দেয়।

৩. বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি অগ্রাহ্যকরণ : তৎকালীন সময়ে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষা ছিল বাংলা, আর মাত্র ৩.২৭% অর্থাৎ সংখ্যালঘু মানুষ উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা শিক্ষা ক্ষেত্রে, হিসেবে গ্রহণ করেছিল। তা সত্ত্বেও আইন ব্যবস্থা, অফিস-আদালত ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে এ ভাষা, অর্থাৎ উর্দু ভাষাকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হতো। এমনকি পাকিস্তানের পাবলিক সার্ভিসের বিষয় তালিকা থেকে এবং নৌ-বিভাগ এবং অন্যান্য বিভাগের নিয়োগ পরীক্ষা থেকে বাংলা ভাষাকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এসময় ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের সকল রাজনৈতিক কাজ তথা বিভিন্ন বিভাগের; যেমন- আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে উর্দু এবং ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি সরকারি ভাষার মর্যাদা প্রদানের প্রস্তাব উত্থাপন করে। ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাবনার উপর একটি আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এ আলোচনা চলাকালীন সময়ে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে যুক্তি দেন। কিন্তু তিনি অমুসলিম বলে মুসলিম নেতৃবৃন্দ তাঁর এ প্রস্ত াবের মধ্যে প্রাদেশিকতার ছায়া দেখতে পায়। আর তাই তার প্রস্তাবকে বাতিল ঘোষণা করা হয়। এসময় গণপরিষদের অধিবেশনে লিয়াকত আলী খান বলেন যেহেতু পাকিস্তান একটি মুসলমান দেশ তাই এ রাষ্ট্রের সাধারণ ভাষা হবে উর্দু এবং উর্দু সরকারি ভাষা হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হবে। এভাবেই বাংলাকে গণপরিষদের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিকে অগ্রাহ্য করা হয়েছিল। ফলে পূর্ব বাংলায় এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য গণ আন্দোলন সৃষ্টি হয়।

৪. উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার প্রতিবাদ লিয়াকত আলী খান উর্দুকে সর্বপ্রথম পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করার পর ১৯৪৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্ররা ধর্মঘট পালন করে। তারা রমনা এলাকায় ধর্মঘট চালায় এবং স্লোগান দিতে দিতে মিছিল করে। এ মিছিল এবং ধর্মঘট শেষ হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় তারা ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাবনার পক্ষে যুক্তি দেয়। তৎকালীন সময় পাকিস্তানের মুদ্রায়, টিকিটে, মানি অর্ডার ফরমে শুধু উর্দু ভাষা উল্লেখ করা হতো কিন্তু বাংলা ভাষার কোনো উল্লেখ ছিল না। আর এর প্রতিবাদেও ঐ দিন ছাত্ররা মুখর হয়ে উঠে

৫. রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ : বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন আরও জোরদার করার উদ্দেশ্যে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ 'রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ' নামক একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার দাবিতে সমস্ত পূর্ব পাকিস্তানে ধর্মঘট আহ্বান করে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। এ সময় ছাত্র ধর্মঘট চলাকালীন সময়ে পুলিশ ছাত্রদের উপর লাঠিচার্জ করে এতে ৫০ জন ছাত্র মারাত্মকভাবে আহত হয়। উক্ত সমাবেশে ছাত্ররা খাজা। নাজিমউদ্দিন এবং তার মন্ত্রিসভার বিরোধিতা করে। এ আন্দোলনের পর সরকার ঘোষণা করে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষায় পরিণত করার আন্দোলন মূলত রাষ্ট্র বিরোধী এক গভীর ষড়যন্ত্র এবং চক্রান্ত। কিন্তু তারপরও এ ছাত্র আন্দোলন থেমে যায়নি, বরং আরও শক্তিশালী হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে ৷ আর পরিস্থিতি এমন পর্যায় পৌছে যায় যে, নাজিমউদ্দিন ছাত্রদের কাছে হার মানে এবং ১৫ মার্চ তাদের সাথে এক আলোচনা সভায় মিলিত হয়। এ আলোচনা সভায় আট দফা কর্মসূচি গ্রহণসহ নাজিমউদ্দিন রাষ্ট্রভাষার পক্ষে এ আন্দোলনকে সমর্থন জানান।

৬. মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর পূর্ব বাংলায় আগমন : নাজিমউদ্দিনের আট দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য তাঁর নেওয়া পদক্ষেপসমূহ সম্পর্কে জানতে ১৯৪৮ সালের ১৭ মার্চ ছাত্ররা এক সমাবেশের আয়োজন করলে উক্ত সমাবেশে পুলিশ গুলি করে। ফলে সমাবেশ সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। এমন এক সংকটময় পরিস্থিতিতে নাজিমউদ্দিনের আহ্বানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ব বাংলায় আসেন এবং ঘোষণা করেন, 'উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা'। জিন্নাহ এরপর আন্দোলনকারীদের ‘পঞ্চমবাহিনী' নামে অভিহিত করেন। তার এ ঘোষণা এবং স্বৈরাচারী মনোভাব পূর্ব বাংলায় বুদ্ধিজীবী এবং শিক্ষিত মহল তথা আপামর জনসাধারণের মনে কিছুটা অসন্তুষ্টির সৃষ্টি হয়।

৭. জিন্নাহর আগমনের পর ভাষা আন্দোলন : জিন্নাহ পূর্ব বাংলা সফর করার পর ভাষা আন্দোলন থেকে অনেক নেতাকর্মী সরে আসে। কারণ জনগণের কাছ থেকে অগাধ বিশ্বাস অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। আর তাই ভাষা আন্দোলনকে তিনি পাকিস্তানের শত্রুদের বিদ্বেষের ফলাফল হিসেবে আপামর জনসাধারণের নিকট উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তমদ্দুন মজলিশ তার কথা অনুসারে ভাষা আন্দোলন থেকে বিছিন্ন হয়ে যায়। এ সময় ভাষা আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হলেও থেমে যায়নি। ১৯৪৯ সালে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান বাংলা ভাষাকে আরবি ভাষায় রূপান্তরিত করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু এ প্রস্তাবের প্রতিবাদ করে বাংলা বিভাগের ছাত্রছাত্রীবৃন্দ এবং ৯ মার্চ মওলানা আকরাম খাঁ পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি গঠন করে। এরই মধ্যে ১৯৪৯ সালের ৩১ মার্চ ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহ এ প্রস্তাবের তীব্র নিন্দা করলে সরকারের টনক নড়ে এবং তখনকার মতো বাংলা ভাষাকে আরবিকরণের প্রয়াস কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। ১৯৫০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর পুনরায় উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব আসে কিন্তু ৪ ও ৫ নভেম্বর রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ও উর্দু উভয় ভাষাকে সমর্থন জানায় পূর্ব পাকিস্তানিরা। কিন্তু এ সময় এ বিষয়টি চাপা পড়ে যায়।

৮. পুনরায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন : ১৯৫০ সালে রাষ্ট্রভাষার দাবি ঢাকা পড়ে যায়। যার ফলে কিছু সংগ্রামী ছাত্ররা পুনরায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে যেটির আহ্বায়ক হিসেবে আবদুল মতিনকে নিযুক্ত করা হয়।

৯. ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের তীব্রতা : ১৯৫২ সালে জানুয়ারির শেষের দিকে খাজা নাজিমউদ্দিনের একপাক্ষিক ভাষণ | ভাষা আন্দোলনকে আরও জোরদার করে। তিনি পুনরায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর অনুরূপ ভাষণ দেন। তাঁর এ ঘোষণায় ছাত্র-শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ফলে এরই প্রতিবাদে ৩০ জানুয়ারিতে 'রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ' ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ধর্মঘটের আয়োজন করে। এ সভায় 8 জানুয়ারি তারিখে ছাত্র ধর্মঘট, বিক্ষোভ মিছিল এবং ছাত্র সভা করার ঘোষণা দেয় 'রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ'। ভাষা আন্দোলনকে বিস্তৃত করার উদ্দেশ্যে ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারিতে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে এক সভায় 'সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ' গঠিত হয়। উক্ত সভায় তিনি ৪ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট, | মিছিল, সভাকে সমর্থন জানায় এবং ২১ ফেব্রুয়ারিতে হরতাল, মিছিল এবং সভা করার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন।

১০. পূর্ব পাকিস্তানে ১৪৪ ধারা জারী : ৪ ফেব্রুয়ারি সভা, ধর্মঘট, মিছিল সংঘটিত হওয়ার পর ১২ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনকে সমর্থনকারী ইংরেজি পত্রিকা দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার' -এর কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং ২০ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। কিন্তু ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ হয়ে ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্ররা ১৪৪ ধারা না ভাঙার পক্ষে তাদের অভিমত ব্যক্ত করেন।

১১. ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত গ্রহণ : ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাত পর্যন্ত ১৪৪ ধারা ভাঙার এবং না ভাঙার বিষয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং শেষ পর্যন্ত অন্যান্য ছাত্ররা, নেতাকর্মীরা ও যুবলীগ কর্মীগণ ১৪৪ ধারা ভাঙার লক্ষ্যে পৃথক পৃথকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

১২. ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখের চূড়ান্ত আন্দোলন : ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে বাংলার মানুষ তাদের ইতিহাসের সাথে এক নতুন অধ্যায়ের সংযোজন ঘটায়। এ দিন সকাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্ররা বিভিন্ন সংগঠন থেকে দুজন দুজন করে সমবেত হয়। ঐ দিন বেলা ১১ টার দিকে ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় ১৪৪ ধারা ভাঙতে ছাত্ররা উদ্যত হয় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ আন্দোলনে মুসলিম লীগও ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়। ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভাঙার উদ্দেশ্যে পথে নামলে পুলিশ অনেক ছাত্রকে গ্রেফতার করে। কিন্তু তারপরও ছাত্র মিছিল বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছিল না। তখন পুলিশ ছাত্র মিছিলের উপর লাঠি চার্জ করে এবং টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে। এ অবস্থায় ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং মেডিকেল কলেজের প্রাচীর টপকে মেডিকেল হোস্টেলের প্রধান ফটকে এসে সমবেত হয়।

১৩. ২১ ফেব্রুয়ারি কর্মসূচি : মেডিকেল কলেজের প্রধান ফটক থেকে ছাত্ররা আবার মিছিল বের করার উদ্যোগ নেয়। তখন তিনজন তিনজন করে ছাত্র মিছিল বের করে। কিন্তু তারপরেও পুলিশ মিছিলের উপর টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে। ফলে ছাত্ররা মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের সামনে এসে আশ্রয় নেয়। কিন্তু সেখানেও পুলিশ টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে এবং ছাত্রদের উপর লাঠিচার্জ করে। এর প্রতিবাদে ছাত্ররা ইট- পাটকেল ছুঁড়তে থাকে। ফলে এমন পরিস্থিতিতে ঘটনা স্থলেই আবদুল জব্বার এবং রফিকউদ্দিন আহমদ নিহত হন। ১৭ জন আহত হন যাদেরকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের মধ্যে আবুল বরকত রাত আটটার সময় শহিদ হন। এরপর ছাত্রছাত্রীদের উপর অতর্কিতভাবে গুলি চালানো হয় যাতে এক ভয়ানক পরিস্থিতির জন্ম হয়।

১৪. ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ভাষা শহিদ : ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতেই যে শুধুমাত্র সকল শহিদ মৃত্যু বরণ করে তা নয়। ২২শে ফেব্রুয়ারিতেও অনেকে মৃত্যুবরণ করেন। আবার আহতদের মধ্যে অনেকেই এ ঘটনার কিছুদিন পর মৃত্যুবরণ করেন। ভাষা শহিদ সালাম ৭ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন। ভাষা শহিদদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শহিদরা হলেন আবদুল জব্বার, রফিকউদ্দিন আহমদ, আবদুস সালাম, আবুল বরকত, শফিউর এবং আরও অনেকে। তাঁদের মধ্যে প্রথম ভাষা শহিদ রফিকউদ্দিন আহমেদ।

→ নিচে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বর্ণনা করা হলো :

১. বাঙালি জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি : মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম হচ্ছে ভাষা। পূর্ব পাকিস্তানের সেই মাতৃভাষার উপর আঘাত হানে পশ্চিম পাকিস্তানিরা। ভাষার উপর আঘাতের প্রতিক্রিয়ায় পূর্ব বাংলায় আন্দোলনের জোয়ার উঠে। এ আন্দোলন পূর্ব বাংলার মানুষের মধ্যে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি হয়। সকলে মিলে এ জাতিসত্তার মধ্যে পরিচিত হয়ে উঠে ।

২. বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা : পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী চেয়েছিল উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রচলন করতে। এতে পূর্ব বাংলার সকল অফিস, আদালত, শিক্ষা পদ্ধতি উর্দুতে চালু হতো। তাহলে বাংলা ভাষা একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত । বাঙালিদের প্রবল আন্দোলনের মুখে এ হীন চক্রান্ত ব্যর্থ হয় । বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে পাকিস্তান সরকার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি প্রদান করে ।

৩. রাজনৈতিক বিবর্তন : বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিবর্তনে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। বাঙালিরা স্বাধিকারের ব্যাপারে সচেতন ছিল না। ভাষা আন্দোলকে কেন্দ্র করে বাঙালিদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা জাগ্রত হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিবর্তনে ভাষা আন্দোলন ছিল প্রথম পদক্ষেপ ৷

৪. যুক্তফ্রন্টের জয়লাভ : ভাষা আন্দোলন দমন করার নামে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের উপর যে অত্যাচার চালায় তা রাজনৈতিক কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করে ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যুক্তফ্রন্ট মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটিয়ে জয়লাভ করতে সক্ষম হয়। যুক্তফ্রন্টের জয়লাভ দ্বারা মুসলিম লীগের পতন ঘটায় এবং পূর্ব বাংলার বাঙালিরা স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়।

৫. ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ : পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের শাসন ও শোষণ করার ষড়যন্ত্র করছিল। ভাষাকে কেন্দ্র করে যে ষড়যন্ত্রের জাল তারা | বুনেছিল তা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হওয়ায় পরবর্তীকালে তাদের অন্যান্য ষড়যন্ত্র প্রতিহত করা বাঙালিদের পক্ষে সম্ভব হয়।

৬. সাম্প্রদায়িকতার অবসান : দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান গঠিত হওয়ার পর পূর্ব বাংলায় সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাঙালিদের মধ্য থেকে সাম্প্রদায়িকতার দূর করে সকল ধর্ম-বর্ণের মধ্যে একটা প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি করে।

৭. শহিদ মিনার স্থাপন ও শহিদ দিবস পালন : ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যারা শহিদ হন তাদের স্মরণে বাংলার শহর-বন্দর ও গ্রাম-গঞ্জে অসংখ্য শহিদ মিনার স্থাপন করা হয়। UNESCO ১৯৯৯ সালে, ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি যারা বাংলা ভাষার জন্য শহিদ হয়েছেন তাদের স্বার্থে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে যা একমাত্র ভাষা আন্দোলনেরই প্রতিফলন। এ দিনটিকে বাঙালি জাতি সম্মানের সাথে পালন করে এবং শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শহিদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে।

৮. জাতীয় চেতনার উন্মেষ : বাঙালি জাতি ভাষা আন্দোলনের পর বুঝতে পারে পশ্চিম পাকিস্তানিরা ধর্মের নামে পূর্ব বাংলা শোষণ করছে। ৫২-এর ভাষা আন্দোলনের পর প্রতিটি নির্বাচনে পূর্ব বাংলার প্রার্থীগণের নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জিত হয়। পূর্ব বাংলার মানুষের মধ্যে জাতীয় ঐক্যের প্রভাব পরিলক্ষিত হতে থাকে। তাই মানুষের মধ্যে জাতীয় চেতনা উন্মেষ হয়।

৯. দাবি আদায়ে শিক্ষা : ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনের মতো এত দুর্বার আন্দোলন এর আগে কখনো হয়নি। শান্তি পূর্ণভাবে কীভাবে দাবি আদায় করা যায় তা এ আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালিরা শিখে নেয়। এ আন্দোলনের সাফল্যের ফলে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনে বাঙালিরা শ্রেণি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফলে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি দেশের অভ্যুদয় ঘটে।

১০. মধ্যবিত্ত বাঙালিদের রাজনীতিতে প্রবেশ : ১৯৫২ সালে পূর্ব ভারতবর্ষে উচ্চবিত্ত ও জমিদার শ্রেণি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতো। কিন্তু ভাষা আন্দোলনে মধ্যবিত্ত বাঙালিরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করে । পাকিস্তান সৃষ্টির পর উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্যরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। এতে মধ্যবিত্তদের সাথে তাদের স্বার্থের দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করে। ভাষা আন্দোলনে তাই মধ্যবিত্তদের সক্রিয় অংশগ্রহণ লক্ষ করা যায়। এরপর থেকে পূর্ব বাংলায় মধ্যবিত্তদের রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান তৈরি হয়।

১১. ছাত্রদের গুরুত্ব বৃদ্ধি : ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ছাত্ররা অসামান্য অবদান রাখে। পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা যায় সকল আন্দোলনই ছাত্রদের অক্লান্ত চেষ্টায় সাফল্যমণ্ডিত হয়। ভাষা আন্দোলনের পর থেকেই ছাত্রনেতাদের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। এরপর গঠিত হয় ছাত্রলীগ। ছাত্র নেতারাই পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বিজয় ছিনিয়ে নে।

১২. সংগ্রামী মনোভাব সৃষ্টি : ভাষা আন্দোলনের সময় থেকেই বাংলার রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হয়। এরপর থেকেই এদেশের মানুষ প্রতিবাদী হয়ে উঠে। পাকিস্তানি শাসক চক্রের শোষণের সোচ্চার হয়ে উঠে পূর্ব বাংলার কোটি জনতা। পরবর্তীতে এ সংগ্রামী মনোভাব বাংলাদেশকে স্বাধীনতা এনে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।

১৩. একুশের চেতনা : বাংলাদেশের মানুষ একুশে ফেব্রুয়ারির আত্মত্যাগ থেকে যে চেতনা লাভ করে তা জাতির সকল আন্দোলনে প্রেরণা হিসেবে কাজ করছে। সমগ্র জাতির একতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে একুশে ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ঐক্যবদ্ধ জাতি দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছে চেতনা থেকে। বাংলাদেশের জনগণের স্বজাত্যবোধের স্ফুরণের উৎস ২১। ২১ হচ্ছে দেশ ও জাতির নতুন ইতিহাসের জন্মদাতা।

১৪. বীর মুক্তিযোদ্ধা সৃষ্টি : ভাষা আন্দোলনকারীরাই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশকে এনে দিয়েছে স্বাধীনতার লালসূর্য। এক্ষেত্রে ভাষা আন্দোলনকারীদের সাথে ছাত্র, যুবসমাজ, কৃষক-শ্রমিকসহ দেশের সর্বস্তরের জনসাধারণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশ পাকিস্তানি হানাদান বাহিনীদের সাথে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করে। এরাই পরবর্তীতে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মানিত হয়।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে সমগ্র বাঙালি জাতি যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল তা পৃথিবীর ইতিহাসে খুবই বিরল। আর এ জাতি মায়ের ভাষাকে কলুষিত হতে দেয়নি । জীবন দিয়ে এ ভাষার সম্মান অক্ষুণ্ণ রেখেছে। আর তাই আজ আমরা বাংলা ভাষায় স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারি। বাংলাদেশ আজ আমাদের মাতৃভূমি এবং আমরা বাঙালি জাতি হিসেবে বিশ্বের সর্বত্র পরিচয় দিতে পারি। আর এ সবকিছু সম্ভব হয়েছে ভাষা শহিদদের আত্মত্যাগের ফলে। কারণ ভাষার জন্য লড়াই করে তারা বাঙালি জাতিকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করেছে ।

আর্টিকেলের শেষকথাঃ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পটভূমি ও ঘটনা প্রবাহের বিবরণ দাও

আমরা এতক্ষন জেনে নিলাম ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পটভূমি ও ঘটনা প্রবাহের বিবরণ দাও । যদি তোমাদের আজকের এই পড়াটিটি ভালো লাগে তাহলে ফেসবুক বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করে দিতে পারো। আর এই রকম নিত্য নতুন পোস্ট পেতে আমাদের আরকে রায়হান ওয়েবসাইটের সাথে থাকো।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ