পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিবরণ দাও

আসসালামু আলাইকুম প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা আজকে বিষয় হলো পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিবরণ দাও জেনে নিবো। তোমরা যদি পড়াটি ভালো ভাবে নিজের মনের মধ্যে গুছিয়ে নিতে চাও তাহলে অবশ্যই তোমাকে মনযোগ সহকারে পড়তে হবে। চলো শিক্ষার্থী বন্ধুরা আমরা জেনে নেই আজকের পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিবরণ দাও ।

পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিবরণ দাও
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিবরণ দাও

পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিবরণ দাও

  • পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিবরণ দাও।
  • অথবা, পাকিস্তানি শাসনামলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কি বৈষম্য ছিল?
  • অথবা, তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য সম্পর্কে লিখ।
  • অথবা, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্যের একটি চিত্র তুলে ধর।

উত্তর : ভূমিকা : পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন হওয়ায় বাঙালিরা আশা করেছিল তারা স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকবে এবং অর্থনৈতিক মুক্তি সাধিত হবে কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের আশার প্রতিদানে হতাশা চাপাতে থাকে । তারা বাঙালিদের প্রতি সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে শোষণ করতে থাকে। তাদের বৈষম্যমূলক নীতির কারণে পূর্ব পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারেনি। অধিকন্তু প্রাদেশিক সরকারের হাতে ব্যাংক, মুদ্রা ব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের কোনো ক্ষমতা ছিল না, বরং পূর্ব পাকিস্তান হতে অর্থ পাচার করে পশ্চিম পাকিস্ত ানে নিয়ে যাওয়া হতো। পশ্চিম পাকিস্তানিদের উক্ত এ শোষণ বৈষম্যের হাত হতে রক্ষার জন্য বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করে। নিম্নে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক সৃষ্ট আর্থিক বৈষম্য বিষয়ে আলোচনা উপস্থাপন করা হলো :

১. অর্থনৈতিক বৈষম্য : পাকিস্তানি শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তান ভয়াবহ অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হয়। ফলে পূর্ব পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে ব্যর্থ হয়। প্রাদেশিক সরকারের হাতে মুদ্রা ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের কোনো ক্ষমতা ছিল না। কেন্দ্র সরাসরি এসব নিয়ন্ত্রণ করতো বলে পূর্ব পাকিস্তানের সমুদয় আয় পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যেত। স্টেট ব্যাংকসহ প্রায় সকল ব্যাংক, বিমা, বাণিজ্য, সরকারি-বেসরকারি প্রধান এবং বিদেশি মিশনসমূহের হেড অফিস ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্বাঞ্চলের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ যোগানের ব্যাপারটি ছিল তাদের দয়ার উপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে, উদ্বৃত্ত আর্থিক সঞ্চয় পশ্চিম পাকিস্তানে জমা থাকতো যে কারণে বাংলাদেশে কখনো মূলধন গড়ে উঠতে পারেনি। এ প্রক্রিয়ায় যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে তা থেকে পরিত্রাণের উপায় হলো অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসন। পূর্ব পাকিস্তান মুদ্রা রাজস্ব নীতিতে প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ, স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীন বাণিজ্য, অর্থনৈতিক সাহায্য দাবি করে। পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক এরূপ শোষণমূলক নীতি অনুসরণের ফলে ১৯৬০ এর দশকে পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য চরম আকার ধারণ করে। বাঙালি চেয়েছিল এমন একটি অর্থনৈতিক পরিবেশ যাতে তাদের সমাধিকার নিশ্চিত হয়।

২. অর্থনৈতিক বৈষম্য নীতি : পাকিস্তান সরকার তথা কেন্দ্রীয় সরকার ছিল সর্বক্ষেত্রে চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী। ফলে রাষ্ট্রীয় সকল পরিকল্পনা প্রণীত হতো কেন্দ্রীয় সরকারের দপ্তরে। আর এ বিভাগে পূর্ব বাংলার প্রতিনিধি না থাকায় পশ্চিম পাকিস্ত ানি স্বার্থান্বেষী মহল কৌশলে পূর্ব বাংলাকে ন্যায্য অধিকার হতে বঞ্চিত করে। অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও সম্পদ বিভাজনের ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের তত্ত্ব ছিল যে, এক এলাকায় যে খরচ বা বিনিয়োগ হবে অর্থনীতি অবিচ্ছেদ্য হওয়ায় তার সুফল দুটি এলাকাতেই সমভাবে ভোগ করা যাবে। এ তত্ত্বে বিশ্বাসী পশ্চিমা শাসকবর্গ বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পূর্ব পর্যন্ত প্রণীত পরিকল্পনাগুলোতে বরাদ্দের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট বৈষম্য নীতি অনুসরণ করে।

৩. প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার বৈষম্য : প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় ১৯৫৫-৫৬ সাল থেকে ১৯৫৯-৬০ সাল পর্যন্ত। এর পরিকল্পনা অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়ন খাতে সরকারিভাবে মোট ৩০০ কোটি ২০ লক্ষ রুপি বরাদ্দ করা হয়েছিল কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ব্যয় ছিল ১১৩ কোটি ৩ লক্ষ ৮০ হাজার রুপি। অপরপক্ষে পাকিস্তানের তথা পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন খাতে ব্যয় ছিল ৫০০ কোটি রুপি। আবার এ সময়ে ব্যক্তিগত মালিকানা খাতে পূর্ব পাকিস্তানে ৭৩ কোটি এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ২৯৩ কোটি রুপি বিনিয়োগ করা হয়েছে।

৪. দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার বৈষম্য : পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময়কাল ছিল ১৯৬০-৬১ থেকে ১৯৬৪-৬৫ সাল । প্রথম পঞ্চম বার্ষিকী পরিকল্পনায় সমালোচনার ঝড় উঠলে এবং সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে উত্তেজনা ও অসন্তুষ্টি দেখা দিলে আইয়ুব খানের পরিকল্পনায় দু'অঞ্চলের বৈষম্য কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেন। এরই ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় পূর্ব পাকিস্তানের বাজেটের ব্যয় ছিল ৯৫০ কোটি আর পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যয় ছিল ১৩৫০ কোটি রুপি। তিনি দুই প্রদেশের মধ্যে বৈষম্য হ্রাস করতে চাইলেও পরিশেষে দেখা গেল মোট বরাদ্দ পড়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ৪৫% কিন্তু উন্নয়ন ব্যয় হলো ৩১%। আবার বরাদ্দ ছাড়াও পাকিস্তানের সিন্ধু নদীতে উন্নয়ন প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় করা হয় ২১১ কোটি রুপি । দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনীয় ব্যক্তিগত খাতে পূর্ব পাকিস্তানের বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল ৩০০ কোটি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ১০৭০ কোটি রুপি। এগুলো ছাড়াও আরো বিভিন্নভাবে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ অর্থনৈতিক বৈষম্যের স্বীকার হতে হয়।

(ক) জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য : পাকিস্তানের ২৪ বছরের শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য ছিল চরম অবস্থায়। প্রথমেই দুই অঞ্চলের লোকের বৈষম্যের চিত্র সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে দুই অঞ্চলের লোকের অর্থনৈতিক ব্যবধানের মাপকাঠি মাথাপিছু আয় হিসাব করে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়। সেই সময় পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মাথা পিছু আয় ২৫ টাকার বেশি ছিল। দুই বছর পর সেই ব্যবধান এসে দাঁড়ায় ৬৩ টাকায়। আবার ১৯৪৯-৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় যেখানে ছিল ২৮৮ টাকা তখন পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ছিল ৩৫১ টাকা। ১৯৬৯-৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মাথাপিছু আয় দাঁড়ায় ৩৩১ টাকা। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়ায় ৫৩৩ টাকা। এখানে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে বৈষম্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০২ টাকা আর বৈষম্যের অনুপাত ছিল ৬১.০%।

(খ) রাজস্ব আয় ও ব্যয়ে বৈষম্য : রাজস্ব খাতে আয়-ব্যয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্যনীতির ভিন্ন একটি চিত্র দেখা যায়। ১৯৬৫-৬৬ সাল থেকে ১৯৬৮-৬৯ সালে বাণিজ্য শুল্ক, আবগারি শুল্ক, বিক্রয় কর এবং আয় কর থেকে পূর্ব পাকিস্তান জমা দেয় ৭২৮ কোটি টাকা। খরচের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানকে দেয় ৪৮৫ কোটি টাকা। বাদ বাকি টাকা নিজের কাছে জমা রাখে অথচ পশ্চিম পাকিস্তান ১৭৮১.৭ কোটি টাকা আয় করে খরচের জন্য পায় ১৬৫৯.৫ কোটি টাকা। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান উন্নয়ন খাত থেকে পায় যথাক্রমে ৮৫১.৩ কোটি ও ১১০৭.৬ কোটি

(ঘ) অভ্যন্তরীণ ঋণ বরাদ্দে বৈষম্য : অভ্যন্তরীণ ঋণ বরাদ্দের ক্ষেত্রেও পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে চরম বৈষম্য করা হতো। পাকিস্তানে শিল্প উন্নয়ন ব্যাংক, পাকিস্তান শিল্প ঋণ ও বিনিয়োগ কর্পোরেশন, হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন এবং পাকিস্তান কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ঋণে ব্যাপক বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়।

(ঙ) আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শোষণ পাকিস্তানের বহির্বাণিজ্য সম্পূর্ণভাবে সরকারি নিয়ন্ত্রণে ছিল। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য পশ্চিম পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় দপ্তর হতে পরিচালনা করা হতো। ফলে ব্যবসা বাণিজ্যের অনুকূল পরিবেশ সবসময় পশ্চিম পাকিস্তানে বিরাজ করত। পাকিস্তানের বহির্বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত মোট রপ্তানি আয়ের ৬০ শতাংশ ছিল পূর্ব পাকিস্তান আর বাকি ৪০ শতাংশ পশ্চিম পাকিস্তানে। বিশ্ব বাজারে যখন প্রক্রিয়াজাতকরণ দ্রব্যের চাহিদা ছিল তুঙ্গে তখন পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানকে অগ্রাহ্য করে সকল কল কারখানা গড়ে তোলেন পশ্চিম পাকিস্তানে। এছাড়াও বৈদেশিক সম্পদ এবং পাকিস্তানের বাণিজ্যনীতির মধ্যেও শোষণের বীজ গৃহীত ছিল। আমদানি ও রপ্তানি পশ্চিম পাকিস্তান হতে নিয়ন্ত্রণ হওয়ায় পূর্ব পাকিস্তান সীমাহীন বৈষম্যের শিকার হন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে বেশি আয় করলেও পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আমদানি করা হয়েছে ২০০৬৭ মিলিয়ন টাকার পণ্য পশ্চিম পাকিস্তান ৪৪৩২৪ মিলিয়ন টাকা মূল্যের পণ্য আমদানি করেছে। আমদানি ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান পেয়েছে মাত্র ৩১.১% রপ্তানি।

(চ) দুই অঞ্চলের বাণিজ্যে বৈষম্য : অর্থনৈতিক শোষণের অন্য একটি উপায় দুই অঞ্চলের বাণিজ্য। ১৯৪৭-৬৯ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে রপ্তানি হয়েছে ৮২৩৮ মিলিয়ন টাকার পণ্য। অন্যদিকে, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আমদানি হয়েছে ৮২৩৮ মিলিয়ন টাকার পণ্য। পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে বাণিজ্যিক আগ্রহের কিছু কারণ হলো বিশ্ব বাজারের চেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে রপ্তানি করা পণ্যের মূল্য কিঞ্চিত বেশি হলেও পশ্চিম পাকিস্তানের পণ্যগুলো পূর্ব পাকিস্তানে আমদানি হতো তার মূল্য ছিল প্রায় দ্বিগুণ। এছাড়াও পশ্চিম পাকিস্তানে রপ্তানির ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান স্থানীয় মুদ্রার ব্যবসা করতে বাধ্য ছিল। অন্যদিকে, বিশ্ব বাজারে রপ্তানির ক্ষেত্রে সমুদয় অর্থ বৈদেশিক মুদ্রায় পেত। এমনিভাবে দুই অঞ্চলের বাণিজ্যের নামে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিপুল মুনাফা অর্জন ও অর্থ পাচার করে ।

(ছ) মুনাফা ও মূলধন আহরণের মাধ্যমে শোষণ : পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান একই রাষ্ট্র হলেও পশ্চিমের কর্মচারী ও অফিসার পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত থাকত কিন্তু তাদের মাসিক আয় পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যেত। এ অঞ্চলের কাঁচামাল সস্তা থাকায় পশ্চিমা পুঁজিপতিরা এ অঞ্চলে কিছু শিল্প কারখানা গড়ে তোলে। এসব উৎপাদিত পণ্য এখানে সরাসরি বিক্রি না করে পশ্চিম পাকিস্তানে যেত এবং পরে তা পশ্চিমাঞ্চলের রপ্তানি পণ্য হিসেবে পূর্বাঞ্চলে -আসতো এবং বিক্রিলব্ধ অর্থ আবার পশ্চিমে চলে যেতো। মূলধন আহরণের ক্ষেত্রেও পূর্ব পাকিস্তানের লোকজন শোষণ বৈষম্যের শিকার হয়েছে। পাকিস্তানের প্রধান প্রধান ব্যাংক, বিমা পশ্চিম পাকিস্তানে স্থাপিত ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের অধিকারে থাকায় ঐ অঞ্চলের শিল্পপতিরা সহজে ঋণ নিয়ে শিল্প প্রতিষ্ঠা করেছিল। ১৯৭০ সালে দেখা যায় পাকিস্তানের ৩৬টি তালিকাভুক্ত ব্যাংকের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে রেজিস্ট্রি করা হয়েছিল ১৫টি। এসব ব্যাংকের মধ্যে ১০টি পশ্চিম পাকিস্তানি মালিকানাধীন ছিল যেখানে ৭৫% মূলধন ঋণ জমা হতো। বাঙালি মালিকানাধীন ব্যাংক ছিল দুটি যাতে জমাকৃত মূলধনের হার ছিল ১৬৬% এবং বিদেশি তিনটি জমাকৃত ব্যাংকের মূলধনের হার ছিল ৮.৪%। এজন্য পূর্ব পাকিস্তানের সর্বস্তরের মানুষের পক্ষে ব্যাংকের সুযোগ- সুবিধা ভোগ করা সম্ভব হয়নি। পাকিস্তানে ১১টি বিদেশি ব্যাংকের সদর দপ্তর ছিল এর মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানে শাখা ছিল ১৯টি আর পূর্ব পাকিস্তানে শাখা ছিল ১২টি। পুঁজিপতিরা ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে পূর্বাঞ্চলীয়রা বৈষম্যের স্বীকার হন। পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো বিনিয়োগকারী তার ১০% মূলধন দেখিয়ে ৯০% ঋণ নিয়ে শিল্প কর তুলতে পারত। আবার পূর্ব পাকিস্তানিদের এ সুযোগ হতে বঞ্চিত করা হতো। দেখা যায়, মূলধন আহরণ ও মুনাফা অর্জন উভয় ক্ষেত্রেই পূর্ব বাংলার জনগণ শোষণের শিকার হয়েছিল ।

(জ) উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বৈষম্য : পাকিস্তানের সকল অর্থনৈতিক নীতিমালার উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের আঞ্চলিক আয়ের দ্রুত বৃদ্ধি। ২য় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা থেকে শুরু করে তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা এমনভাবে বাস্তবায়ন করা হয় যে পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থে পূর্ব পাকিস্তানের শোষণ ছিল তার মূলনীতি। তাই দেখা যায়, আঞ্চলিক বরাদ্দ যাই থাকুক না কেন বার্ষিক পরিকল্পনার পূর্বাঞ্চলের জন্য নানা অজুহাতে বরাদ্দ সীমিত রাখা হতো। এ বরাদ্দ বাস্তবায়ন পূর্ব পাকিস্তানে দায়িত্ব পালন করতো পশ্চিম পাকিস্তানিরা। এছাড়া বিভিন্ন উপায়ে উন্নয়ন ব্যাহত করা হতো। এর ফলে দেখা যেতো নির্দিষ্ট সময়ের পর অধিকাংশ প্রকল্পের অর্থ অব্যবহৃত থেকে যেতো। আবার এসব অর্থ পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন খাতে ব্যয় করা হতো। আবার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্যোগে যে সকল উন্নয়ন প্রকল্প গৃহীত ও বাস্তবায়িত হয়েছিল, সেগুলোর মূল্য পশ্চিম পাকিস্তানেই সীমাবদ্ধ ছিল।

(ঝ) অবকাঠামোগত বৈষম্য : ঔপনিবেশিক মনোভাব উন্নয়ন প্রকল্পে পশ্চিমাঞ্চলকে অধিকতর প্রাধান্য দেয়ায় উভয় অঞ্চলের মধ্যে অবকাঠামোগত বৈষম্য আকাশ-পাতাল ব্যবধানে উপনীত হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের দুটি রাজধানী পশ্চিম পাকিস্তানে গড়ে তোলার কারণে সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ড মূলত পশ্চিম পাকিস্ত ানকে ঘিরেই পরিচালিত হয়। এছাড়াও ব্যাংক, বিমা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের হেড অফিস, নৌ এবং বিমান বাহিনীর সদর দপ্তর বিদেশি মিশনের প্রধান কার্যালয় প্রভৃতি পশ্চিম পাকিস্তানে স্থাপিত হয়েছিল। পাকিস্তানে ২৩টি বেসামরিক বিমানবন্দরের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল ১৮টি এবং পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র ৫টি। বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রেও একই অবস্থা পরিলক্ষিত হয়। যেমন ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন উন্নীত হয়েছিল ৫৫০ হাজার কিলোওয়াটে। সেক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানে উন্নীত হয়েছিল ১৯৫৬ হাজার কিলোওয়াট। সুতরাং অবকাঠামোগত উন্নয়নে পূর্ব পাকিস্তান বৈষম্যের স্বীকার হয়।

(ঞ) সম্পদ পাচার : তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তান হতে অনেক মূল্যবান দ্রব্য পাচার করে নিয়ে যেতো। প্রতি বছর প্রায় ৩ হাজার মিলিয়ন রুপি পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হয়। আর এক হিসেবে দেখা যায় ১৯৪৮-৪৯ থেকে ১৯৬৮-৬৯ পর্যন্ত বিশ বছরে পূর্ব পাকিস্তান থেকে অর্থ পাচার করা হয় যা পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নের ১৯ শতাংশ পাচার করা হয়। স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় পূর্ব পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে চরম বৈষম্য স্বীকার হয়েছিল। আর এ পাচারের ফলে পূর্ব বাংলার অর্থনীতি বিরাট আকারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেগুলো ক্ষতি থেকে কাটিয়ে উঠতে পূর্ব বাংলার অনেক সময় লেগেছিল ।

(ট) অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রতিক্রিয়া : কেন্দ্রীয় সরকার তত্ত্ব দেয় যে, রাষ্ট্রের এক এলাকায় যে খরচ বা বিনিয়োগ হবে অর্থনীতিটি অবিচ্ছেদ্য হওয়ায় তার সুফল দুটি এলাকাতেই উপভোগ করা যাবে। আর এ তত্ত্বের প্রথম প্রতিবাদ গড়ে ওঠে ১৯৫৬ সালে চট্টগ্রামে একটি নিখিল অর্থনৈতিক সম্মেলন থেকে। বাঙালি অর্থনীতিবিদরা এর অসুবিধা প্রমাণ করেন। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক উক্ত তত্ত্বের প্রতিবাদে দুই অর্থনীতি তত্ত্ব ঘোষণা করে। এতে দুই অঞ্চলের মধ্যে বিভেদ দেখা দিলে আইয়ুব খান ১৯৬২ সালে বিভাজনের বিষয়ে পুনর্বিবেচনার জন্য একটি ফাইন্যান্স কমিশন গঠন করেন। এ. কমিশনের মূল সুপারিশ ছিল যে, কেন্দ্রীয় রাজস্বের যে অংশ প্রদেশে বিভাজন করা হবে তার সিংহভাগ পাবে পূর্ব পাকিস্তানের নগর আর এ বিভাজন, জনসংখ্যা অনুপাতে হবে। প্রকৃতপক্ষে, কমিশনের রিপোর্ট ছিল আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। ১৯৬৫ সালে তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণীত হলে জনগণের বিতর্ক সাংবিধানিক অঙ্গীকার ও আঞ্চলিক অর্থ বরাদ্দের প্রশ্নকে পরিকল্পনা বিষয়ের বিতর্কের কেন্দ্রস্থলে নিয়ে আসে। তৃতীয় পরিকল্পনায় অর্থনীতিবিদ প্যানেলের আলোচনায় আঞ্চলিক বৈষম্য, সরকারি খাতের ভূমিকা ও ভূমি সংস্কার বিষয়ে বিতর্ক তীব্র হয়ে ওঠে যে উক্ত প্যানেলের চেয়ারম্যান ও কমিশনের মুখ্য অর্থনীতিবিদ এম. এল কোরেশী দুই বা তিনটি বৈঠকের পরই প্যানেলের আলোচনা হঠাৎ অসময়ে বন্ধ করে দেন। ফলে অর্থনৈতিক শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া গড়ে ওঠে। ১৯৬২ সালে সামরিক শাসন প্রত্যাহারের পর রাজনৈতিক নেতারা বাঙালি অর্থনীতিবিদদের সাথে যোগ দিয়ে বৈষম্যকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করে। ১৯৬৬ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের গোলটেবিল বৈঠকে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান আঞ্চলিক সমতাকে ভিত্তি করে ছয়-দফা রচনা করেন। এতে আঞ্চলিক বৈষম্য রোধ ও সম্পদ পাচার রহিত করার লক্ষ্যে পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে পৃথক মুদ্রা চালুর প্রস্তাবও দেয়। ছয়-দফাভিত্তিক বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিবাদী আন্দোলন ক্রমশ গণআন্দোলনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে আইয়ুব খান ইসলামাবাদে এক গোল টেবিল বৈঠক আহ্বান করে। সেই বৈঠকে ছয়-দফা পুনরায় ব্যক্ত করেন শেখ মুজিব। কিন্তু আইয়ুব খানের পক্ষে দাবিগুলো মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না পরবর্তীকালে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পেছনে প্রেরণা যুগিয়েছে পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্বাঞ্চলকে শোষণের বিষয়। বাংলার প্রতিটি ক্ষেত্রে এ বৈষম্যের বিপক্ষে সারা বাংলা ফুসে ওঠে। পূর্ব বাংলার জনগণ বার বার চেয়েছিল তাদের বৈষম্যের হাত হতে রক্ষা পেতে। তাই যারা এ বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চেয়েছিল বাংলার জনগণ তাকেই সমর্থন দেয়।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনৈতিকভাবে এতই শোষণ করেন যে, পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে পড়ে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল যদি পূর্ব বাংলার জনগণকে অর্থনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণ বা দারিদ্র্য সীমার নিচে রাখা যায় তাহলে তারা পাকিস্তানের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করার মতো সাহসও পাবে না। কিন্তু তাদের শোষণ বৈষম্যগুলো এতই বেশি ছিল যে পূর্ব পাকিস্তানি জনগণের সামনে তা চলে আসে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই তারা পরবর্তীতে নিজেদের অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতেই আন্দোলন করে এবং অধিকার প্রতিষ্ঠা করে।

আর্টিকেলের শেষকথাঃ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিবরণ দাও

আমরা এতক্ষন জেনে নিলাম পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিবরণ দাও । যদি তোমাদের আজকের এই পড়াটিটি ভালো লাগে তাহলে ফেসবুক বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করে দিতে পারো। আর এই রকম নিত্য নতুন পোস্ট পেতে আমাদের আরকে রায়হান ওয়েবসাইটের সাথে থাকো।

Next Post Previous Post
1 Comments
  • Anonymous
    Anonymous 05 March

    Bangladesher shathe orthnoitik boishommo koi?

Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ