মুঘল সম্রাট আকবরের বিজয় অভিযানসমূহ আলোচনা কর

মুঘল সম্রাট আকবরের বিজয় অভিযানসমূহ আলোচনা কর
মুঘল সম্রাট আকবরের বিজয় অভিযানসমূহ আলোচনা কর

মুঘল সম্রাট আকবরের বিজয় অভিযানসমূহ আলোচনা কর

  • অথবা, সম্রাট আকবরের সাম্রাজ্য বিস্তারের বিবরণ দাও।

উত্তর : ভূমিকা : ১৫৫৬ সালে সম্রাট আকবর বাংলার সিংহাসনে উপবিষ্ট হন। সে সময় ভারত ছিল বিভিন্ন রাজ্যে বিভক্ত এবং হিন্দু মুসলমান রাজন্যবর্গ কর্তৃক শাসিত। 

১৬০৫ সালের মধ্যে তিনি সমগ্র উত্তর ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য বিস্তার করেন। আকবর ছিলেন ঘোর সাম্রাজ্যবাদী। 

তাই ভারতের রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা অর্জনের জন্য একচ্ছত্র প্রভুত্ব স্থাপন ও একই ধরনের শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করাই ছিল তার রাজ্য বিস্তারের লক্ষ্য। তার দীর্ঘ ৪০ বছরের শাসনকালে ভারতবর্ষ একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্যে পরিণত হয়।

→ সম্রাট আকবরের বিজয় অভিযান : নিম্নে প্রশ্নালোকে আলোচনা উপস্থাপন করা হলো :

১. মালব বিজয় : ১৫৫৬ সালে পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে সম্রাট আকবর হিমুকে পরাজিত করে আদম খানকে মালবের সবদার রাজবাহাদুরকে দমনের জন্য প্রেরণ করেন। এতে রাজবাহাদুর পরাজিত হন।

রাজবাহাদুরকে পরাস্ত করে আদম খান অতি উৎসাহিত হয়ে সম্রাটের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করতে থাকে। এমতাবস্থায় আকবর নিজেই মালব আক্রমণ করে আদম খানকে দমন করেন।

২. গাণ্ডোয়ানা বিজয় : আকবর ১৫৬৪ সালে গান্ডোয়ানার দিকে মনোনিবেশ করেন এবং পাণ্ডোয়ানা অধিকারের জন্য তিনি আসফ খানকে অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেন। 

আসফ খান পান্ডোয়ানায় রানি দুর্গাবতীর মুখোমুখি হলে তুমুল লড়াই হয়। যুদ্ধে রানি দুর্গাবতী পরাস্থ হয়ে আত্মহত্যা করেন। 

তার পুত্র বালক বীর নারায়ণও প্রাণপণ যুদ্ধে করে পরাজিত হয়ে আত্মাহুতি দেন। এতে গান্ডোয়ানা মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।

৩. চিতোর বিজয়' : সম্রাট আকবর ১৫৬৭ সালে মেবারের রাজধানী চিতোর বিজয়ের পরিকল্পনা করেন। মেবারের রানা উদয় সিংহ আকবরকে 'অপরিচ্ছন্ন বিদেশি' বলে তার সাথে কোনো রকমের সম্পর্ক স্থাপন অপমানজনক বলে মনে করতেন। 

এ কারণে তিনি আকবরের বশ্যতা স্বীকার করতে ও তার সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি করতে অস্বীকৃতি জানান। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে আকবর ১৫৬৭ সালে চিতোর আক্রমণ করেন। 

যুদ্ধের তীব্রতায় ভীত হয়ে উদয় সিংহ পলায়ন করেন এবং দীর্ঘ ৪ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৫৬৮ সালে চিতোর মুঘলদের হস্তগত হয়।

৪. রণথম্বোর বিজয় : মুঘল সম্রাট আকবর চিতোর দখল করে ১৫৬৯ সালে রণথম্বোর অভিযান পরিচালনা করেন। এতে রাজপুত নরপতি সরজনহারা পরাজিত হয়ে শান্তি প্রার্থনা করেন। 

এমনকি স্বীয় দু'পুত্র ভোজ ও দুদাকে মুঘল দরবারে পাঠিয়ে দেন। তারা আকবরের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে তার দাসত্ব স্বীকার করেন। ফলে অতি অল্প সময়েই রণথম্বোর হস্তগত হয় ।

৫. কালিঞ্জর বিজয় : রাজ্য বিজেতা আকবর রণথম্বোর বিজয়ের পর কালিঙ্করের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। চিতোর ও রণথম্বোর পতনের সংবাদ পেয়ে কালিঞ্জরের রাজা আত্মসমর্পণ করেন। ফলে আকবর বিনা রক্তপাতে কালিঞ্জর দখল করে নেন।

৫. গুজরাট বিজয় : মুজাফ্ফর শাহের দুর্বলতা ও রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার সুযোগে বিদ্রোহী নেতা ইতিমাদ খান আকবরের সাহায্য প্রার্থনা করেন। এ সুযোগে আকবর ১৫৭২ সালে গুজরাট আক্রমণ করে মুজাফ্ফর শাহকে পরাজিত করে গুজরাট অধিকার করে নেন।

৭. বাংলা ও বিহার বিজয় : বাংলার শাসক হিসেবে কররানিরা স্বাধীনভাবে রাজ্য পরিচালনা করলেও তারা সম্রাটের বশ্যতা স্বীকার করতেন। 

কিন্তু সুলায়মান কররানির পুত্র দাউদ খান কররানি সম্রাট আকবরের বশ্যতা অস্বীকার করলে আকবর তার বিরুদ্ধে মুনিম খানকে ২০ হাজার সৈন্যসহ প্রেরণ করে সুরুজগড়, মুঙ্গের, ভাগলপুর প্রভৃতি অধিকার করেন। 

১৫৭৫ সালে মুনিম খান মৃত্যুবরণ করলে দাউদ খান পুনরায় বাংলা অধিকার করেন। ক্ষিপ্ত হয়ে সম্রাট আকবর ১৫৭৬ সালে এক সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করলে দাউদ খান পরাজিত ও নিহত হন। ফলে বাংলা সম্রাট আকবরের হস্তগত হয়।

৮. যোধপুর বিজয় : যোধপুরের রাজা চন্দ্র সেন মুঘলদের অধীনতা স্বীকার না করায় সম্রাট আকবর যোধপুরের উদ্দেশ্যে অভিযান পরিচালনা করে রাজা চন্দ্রসেনকে পরাজিত করে যোধপুর দখল করেন।

৯. সুরাট বিজয় : সম্রাট আকবর ১৫৭৩ সালে সুরটি বিজয়ের মধ্য দিয়ে তার সাম্রাজ্যের পরিধি আরো বিস্তৃত করেন। এতে পর্তুগিজদের সাথে আকবরের সম্পর্ক সুদৃঢ় হয় এবং পর্তুগিজরা তাদের সুযোগ-সুবিধা পরিপূর্ণভাবে ভোগ করার অনুমতি পায়।

১০. রাজমহলের যুদ্ধ : দাউদ খান বিদ্রোহ ঘোষণা করলে তা দমনের জন্য আকবর বাংলার সুবাদার খান জাহানকে টোডরমলসহ প্রেরণ করেন। ১৫৭৬ সালে দাউদ খান রাজমহলের যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন।

১১. কাবুল বিজয় : আকবরের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা হাফিজ বিদ্রোহ ঘোষণা করলে ১৫৮১ সালে সম্রাট আকবর এক বিশাল বাহিনী নিয়ে কাবুল আক্রমণ করেন। মির্জা হাকিম বশ্যতা স্বীকার করলে সম্রাট দিল্লি প্রত্যাবর্তন করেন। ১৫৮৫ সালে মির্জা হাকিমের মৃত্যুর পর কাবুল মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয়।

১২. কাশ্মীর বিষয় : কাশ্মীরের শাসনকর্তা ইউসুফ শাহের উৎপীড়নে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হলে সম্রাট আকবর ১৫৮৬ সালে ভগবান দালকে কাশ্মীরের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। তিনি সুলতান ইউসুফ ও | তদীয় পুত্র ইয়াকুবকে পরাজিত করে কাশ্মীর অধিকার করেন।

১৩. সিন্ধু অধিকার : সিন্ধুর শাসনকর্তা জানিবেগ আকবরের | বশ্যতা স্বীকার না করে স্বাধীনভাবে সিন্ধু শাসন করতো। সম্রাট আকবর ১৫৯০ সালে মুলতান শাসনকর্তা আব্দুর রহমানকে সিন্ধুর উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। আব্দুর রহমান জানিবেগকে পরাজিত করে সিন্ধু জয় করেন।

১৪. বেলুচিস্তান বিজয় : সম্রাট আকবরের নির্দেশ মীর মামুন | ১৫৯৫ সালে বেলুচিস্তানের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। তখনো বালুচিরা আকবরের বশ্যতা স্বীকার করেনি। মুঘল বাহিনী বেলুচিস্তানের মিরি দুর্গ আক্রমণ করলে প্রতিপক্ষ আত্মসমর্পণ করে এবং | বেলুচিস্তান মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হন।

১৫. আহমেদনগর বিজয় : সম্রাট আকবর ১৫৯৫ সালে পুত্র মুরাদ ও আব্দুর রহিম খান-ই-খানানের নেতৃত্বে আহমেদনগর অবরোধ করেন। নাবালক রাজার পক্ষে শাসনকার্যে নিযুক্ত চানথিবি চার মাস অবরুদ্ধ থেকে সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য হন। ফলে ১৬০০ সালে মধ্যে আহমেদনগর মুঘলদের অধীনে আসে।

১৬. খাদেশ অধিকার : আকবর খান্দেশের গুরুত্ব বিচারে তা জয় করার উদ্দেশ্যে অভিযান পরিচালনা করেন। মুঘলবাহিনী খান্দেশরাজ আলী খানকে বন্দি করে ১৫৯৯ সালে খান্দেশের রাজধানী বুরহানপুর অধিকার করেন। খান্দেশরাজ মুঘল সম্রাটকে কর দিতে বাধ্য হয়।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সম্রাট আকবর রাজ্য বিজেতা হিসেবে অসামান্য কৃতিত্ব প্রদর্শন করে মুঘল সাম্রাজ্যের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটান। 

সম্রাট আকবর বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হিসেবে প্রত্যেকটি অভিযানে বিজয় লাভ করেন। সুদীর্ঘ ৪০ বছরের শাসনকালে ভারতবর্ষ একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্যে পরিণত হয়।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ