সম্রাট আকবরের ধর্মনীতি আলোচনা কর
সম্রাট আকবরের ধর্মনীতি আলোচনা কর |
সম্রাট আকবরের ধর্মনীতি আলোচনা কর
- অথবা, দ্বীন-ই-ইলাহির পটভূমি ও নীতিসমূহ আলোচনা কর।
- অথবা, আকবরের ধর্মনীতি বিশ্লেষণ কর।
- অথবা, কি কি পরিস্থিতির মধ্যে আকবর দ্বীন-ই- ইলাহী ঘোষণা করেন?
উত্তর : ভূমিকা : মুঘল আমলের যে ক'জন শাসক খ্যাতির শীর্ষে অবস্থান করার সুযোগ পেয়েছিলেন, আকবর ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। শ্রেষ্ঠত্ব আর মহত্ত্বের এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছিল।
তার মধ্যে তার মানবতাবাদী ধর্মনীতিও প্রশংসা পেয়েছিল সকলের কাছে। তার ধর্মমত ভারতে এক নতুন চেতনার জন্ম দেয়। গতানুগতিকতার বাইরে মানুষকে নতুনভাবে ভাবিয়েছিল এ ধর্মমত।
→ আকবরের ধর্মনীতি : আকবরই প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, হিন্দুস্থানের সম্রাটকে জাতি, ধর্ম, নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের স্বাভাবিক আনুগত্যের উপর নির্ভরশীল জাতীয় সম্রাটের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হতে হবে। তিনি রানি এলিজাবেথ, রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ এবং মার্টিন লুথারের অনুকরণে পাক-ভারতে ধর্মীয় সংস্কারে ব্রতী হন।
নিম্নে তার ধর্মনীতি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. যুগ ধর্মের প্রভাব : যুগের ধারা ও পারিপার্শ্বিক প্রভাব আকবরের ধর্মমতকে প্রভাবান্বিত করে। ষোল শতকে বিশ্বব্যাপী এক ধর্মীয় জাগরণ দেখা দেয়। এটা ছিল জ্ঞানান্বেষণের যুগ এবং আকবর ছিলেন এ যুগের একজন অকৃত্রিম প্রতিনিধি ।
২. পারিবারিক প্রভাব : আকবরের পিতা হুমায়ূন ও পিতামহ বাবর কেউ গোড়া মুসলমান ছিলেন না। মাতা হামিদা বানুর মানসিক উৎকর্ষ ও পরমত সহিষ্ণুতা তাঁকে শৈশবকাল থেকে- যথেষ্ট প্রভাবিত করে।
৩. গৃহশিক্ষকের প্রভাব : আকবরের গৃহশিক্ষক আব্দুল লতিফ ছিলেন উদারপন্থি। তার সুলহ-ই-কুল নীতি আকবরের ধর্মীয় আদর্শ গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
৪. রাজপুত পত্নীদের প্রভাব : রাজপুত রমণীদের প্রভাব এবং সমসাময়িক আমলের হিন্দু ধর্মাচার্যগণের ধর্মসংস্কার আন্দোলন আকবরের ধর্ম মতবাদকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল।
৫. ভক্তি আন্দোলন : আকবরের সর্বজনীন ধর্মীয় সহিষ্ণুতার সুফল পরিলক্ষিত হয় ভক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে। কবির, নানক, চৈতন্য প্রমুখ ধর্মাচার্যের ন্যায় আকবরও সকল ধর্মের সর্বজনীনতায় ও একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী ছিলেন।
৬. সুফিদের প্রভাব : আকবর বাল্যকালেই সুফিদের সংস্পর্শে এসে সেই মতাদর্শে প্রভাবান্বিত হয়। তিনি শেখ মুবারক ও তার দুই পুত্র ফজল ও ফৈজির প্রভাবে প্রভাবান্বিত হন। বস্তুত তিনি বিভিন্ন পরিবেশের মাধ্যমে ধর্মকে উপলব্ধি করেছিলেন।
৭. রাজনৈতিক কারণ : রাজনৈতিক দৃষ্টি নিয়ে আকবর উপলব্ধি করতে সক্ষম হন যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের সহযোগিতা ব্যতীত সাম্রাজ্যের ভিত্তি সুদৃঢ় হতে পারে না। সকল শ্রেণির প্রজাদের শুভেচ্ছা ও সহযোগিতার উপর ভিত্তি করে তিনি মুঘল সাম্রাজ্যকে সুদৃঢ় করার প্রয়াস পান।
→ ধর্মনীতি ক্রমবিকাশের স্তর : সম্রাট আকবরের ধর্মনীতি ক্রমবিকাশের ৩টি স্তর ছিল। যথা-
প্রথম স্তর : ১৫৫৬ সাল থেকে ১৫৭৪ সাল পর্যন্ত স্থায়ী প্রথম স্তরে আকবর একজন গোঁড়া মুসলমান ছিলেন। তিনি পূর্ব পুরুষদের ধর্মের অনুসারী ছিলেন।
দ্বিতীয় স্তর : ১৫৭৪-১৫৮১ সাল পর্যন্ত স্থায়ী দ্বিতীয় স্তরে আকবর ধর্মের মূলনীতি সংগ্রহ ও সহযোগিতার সন্ধান লাভের উদ্দেশ্যে ধর্ম নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান।
তৃতীয় স্তর : ১৫৮১ থেকে ১৬০৫ সাল পর্যন্ত তার ধর্মনীতি ও তৃতীয় স্তর বিস্তৃত ছিল। এ স্তরে তার ধর্মীয় চিন্তাবোধ চূড়ান্ত রূপ লাভ করে এবং আকবর দ্বীন-ই-ইলাহি নামে একেশ্বরবাদী এক নতুন ধর্ম প্রবর্তন করেন।
• ইবাদতখানা নির্মাণ : সত্যের সন্ধানে ১৫৭৫ সালে সম্রাট আকবর ফতেহপুর সিক্রিতে ইবাদতখানা নির্মাণ করেন। তিনি এখানে শুধু মুসলমান ওলামাদের আমন্ত্রণ জানান। পরে তিনি বিভিন্ন ধর্মের পণ্ডিতদেরকে তাদের নিজ নিজ ধর্ম ব্যাখ্যা করার জন্য ইবাদতখানায় আমন্ত্রণ জানান ।
→ ইবাদতখানা নির্মাণ : সত্যের সন্ধানে ১৫৭৫ সালে সম্রাট আকবর ফতেহপুর সিক্রিতে ইবাদতখানা নির্মাণ করেন। তিনি এখানে শুধু মুসলমান ওলামাদের আমন্ত্রণ জানান। পরে তিনি বিভিন্ন ধর্মের পণ্ডিতদেরকে তাদের নিজ নিজ ধর্ম ব্যাখ্যা করার জন্য ইবাদতখানায় আমন্ত্রণ জানান ।
→ অভ্রান্ত ও সর্বময় ক্ষমতার ঘোষণা : ওলামাদের মধ্যে ধর্ম সংক্রান্ত বিবাদ বন্ধ করার জন্য ১৫৭৯ সালে আকবর তার অভ্রান্ত ও সর্বময় কর্তৃত্বের ঘোষণা দ্বারা নিজেকে রাষ্ট্র ও ধর্মব্যবস্থার সর্বোচ্চে স্থাপন করেন ।
→ দ্বীন-ই-ইলাহি : ধর্মীয় বিদ্বেষ ও তর্ক-বিতর্কে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ১৫৮২ সালে আকবর সকল ধর্মের যার সংবলিত দ্বীন-ই-ইলাহি নামে একেশ্বরবাদী এক নতুন ধর্মমত প্রবর্তন করেন।
ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, “দ্বীন-ই-ইলাহি ছিলেন সকল ধর্মের উৎকৃষ্ট নীতিমালার সমন্বয়ে গঠিত একটি সর্বেশ্বরবাদী ধর্ম।”
এ ধর্মের মূলকথা ছিল-বিশ্বজনীন শান্তি এ বিশ্বাসের জন্য কোনো পুস্তক, প্রবর্তক এবং দৃঢ় নীতি ছিল না । এ মতাবলম্বীরা কয়েকটি নিয়ম ও অনুষ্ঠান পালন করতেন ।
— দ্বীন-ই-ইলাহির নীতিমালা : এ ধর্মমতের নীতিমালা ছিল নিম্নরূপ :
১. সম্রাটের নামে সম্পদ, জীবন ও সম্মান উৎসর্গ করা।
২. কারো সাক্ষাৎ ঘটলে সালামের পরিবর্তে ‘আল্লাহু আকবর’ এবং জবাবে ‘জাল্লেজাল্লালুহু' বলা ।
৩. মৃত্যুর পূর্বেই পাথেয় সংগ্রহের জন্য ভোজের ব্যবস্থা করা ।
৪. সভ্যগণকে নিজ নিজ জন্মবার্ষিকী পালন ও প্রীতিভোজের ব্যবস্থা করা।
৫. ভিক্ষা দেওয়া যাবে কিন্তু গ্রহণ করা যাবে না ।
৬. মাংস ভক্ষণ থেকে বিরত থাকা।
৭. অগ্নিকে পবিত্র মনে করা।
৮. সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করা ইত্যাদি ।
→ সমালোচনা : দ্বীন-ই-ইলাহি জনগণের মধ্যে তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। আবুল ফজলের মতে, “এ ধর্মের সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র ১৮ জন।” বদায়নির মতে, “দ্বীন-ই-ইলাহি প্রবর্তনের জন্য আকবর ইসলাম বিরোধী আইন প্রবর্তন করেন।”
স্মিথ বলেন, “তার জীবনের সায়াহ্নে তার ইবাদত ছিল অগ্নি ও আলোককে শ্রদ্ধা নিবেদন করা।” বদায়ুনির অভিযোগে প্রমাণিত হয় যে, আকবর বড় জোর নামেমাত্র মুসলমান ছিলেন।
তার বিভ্রান্তিকর অনৈসলামিক ধর্মনীতির দ্বারা সাময়িক উপকার হয়েছিল বটে কিন্তু পরবর্তী সম্রাটদের জন্য মোটেও কল্যাণপ্রদ হয়নি।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সম্রাট আকবর ধর্মীয় চিন্তা-চেতনায় এক নতুন চেতনার জন্ম দেয়। তার ধর্মমত মানুষকে ভাবিয়েছিল। তার ধর্মমত প্রচারের আসল উদ্দেশ্য রাজনৈতিক ধর্মীয় নয়।
তিনি বড় রাজনীতিবিদ হিসেবে হিন্দু মুসলমানদের একসূত্রে গাঁথার পরিকল্পনা করেছিলেন। রাজনৈতিক সংস্থা হিসেবে তার আশা পূর্ণ হয়েছিল।