ক্রুসেড সম্পর্কে যা জান বিস্তারিত আলোচনা কর

ক্রুসেড সম্পর্কে যা জান বিস্তারিত আলোচনা কর
ক্রুসেড সম্পর্কে যা জান বিস্তারিত আলোচনা কর

ক্রুসেড সম্পর্কে যা জান বিস্তারিত আলোচনা কর 

উত্তর : ভূমিকা : ইসলামের ইতিহাসের অন্যতম এক কলঙ্কময় অধ্যায় হচ্ছে ক্রুসেড। মুসলমানদের প্রতি খ্রিস্টানদের বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ ঘটে এ যুদ্ধের মাধ্যমে। 

একাদশ থেকে ত্রয়োদশ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় তিন শতাব্দীকাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল এ যুদ্ধ। যিশুখ্রিস্টের জন্মভূমি বলে জেরুজালেম ছিল খ্রিস্টানদের পবিত্র ভূমি। 

অন্যদিকে মুসলমানদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এখান থেকে মিরাজ গমন করেছেন। অপরদিকে ইহুদিদের মাতৃভূমি ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে জেরুজালেমের গুরুত্ব ছিল। ভূমিটি দখলের জন্য খ্রিস্টান ও মুসলমানদের মাঝে যে সকল যুদ্ধ সংঘটিত হয় তাই ক্রুসেড নামে পরিচিত।

→ ক্রুসেডের পরিচয় : Crusade শব্দটি ইংরেজি Cross শব্দ থেকে এসেছে। যার অর্থ ধর্মযুদ্ধ । ক্রুসকে খ্রিস্টানদের ধর্মীয় প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। 

জেরুজালেম দখল নিয়ে একাদশ থেকে ত্রয়োদশ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ২০০ বছর যাবত মুসলমান ও খ্রিস্টানদের মাঝে যে ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয় তা ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ নামে পরিচিত। 

ইউরোপীয় খ্রিস্টানগণ তাদের ধর্মীয় নেতা পোপের নির্দেশানুসারে বুকে ক্রুস চিহ্ন নিয়েও যুদ্ধ পতাকা হিসেবে ব্লুসকেই ব্যবহার করেছিল বলে এটি ক্রুসেডের যুদ্ধ বলে অভিহিত করা হয়।

এ যুদ্ধ সম্পর্কে ঐতিহাসিক Wall bank ও Taylor যথার্থই বলেছেন, “The word crusade is derived from taking the cross after the example of christ a practice started by the participants in the first crusade."

ব্যাপক অর্থে ক্রুসেড : একাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রায় দুই শতাব্দীকাল পর্যন্ত জেরুজালেম উদ্ধারের জন্য মুসলমান ও খ্রিস্টানদের মাঝে যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়, ইসলামের ইতিহাসে সেটি ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ নামে পরিচিত। 

কারো কারো মতে, মুসলমানদের কাছ থেকে জেরুজালেম কেড়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে সমগ্র ইউরোপের খ্রিস্টানদের সম্মিলিত অভিযানকে ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ বলে। 

কারো কারো মতে খ্রিস্টীয় একাদশ শতাব্দীর শেষভাগ হতে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত মুসলমানদের নিকট হতে জেরুজালেম উদ্ধার করার জন্য ইউরোপের খ্রিস্টানগণ প্রাচ্যের মুসলমানদের সাথে যে ভয়াবহ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল ইতিহাসে সেটিই ক্রুসেড নামে পরিচিত। 

ধর্মের নামে বুকে জুস চিহ্ন ধারণ করে অসংখ্য হতভাগ্য খ্রিস্টান যুবকদেরকে এ ঘৃণ্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয় বলেই এটি ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ নামে পরিচিত। ক্রুসেডের কারণ বিভিন্ন কারণে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

নিম্নে ক্রুসেডের কারণ সম্পর্কে তুলে ধরা হলো :

১. ধর্মীয় কারণ : ধর্মীয় দিক থেকে জেরুজালেম মুসলমান ও খ্রিস্টানদের উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রত্যেকে এটিকে পবিত্র মনে করত। 

কারণ মুহাম্মদ (সা.) এখান থেকে মেরাজে গমন করেছিলেন অন্যদিকে যিশু খ্রিস্ট এখানে জন্মগ্রহণ করেন ফলে উভয়েই এটিকে নিজেদের কর্তৃত্বে রাখতে চেয়েছিল।

২. আধিপত্য বিস্তার : তীর্থযাত্রার উপর নির্যাতন নিয়ে৷ ইউরোপ যখন উত্তেজনা আরম্ভ হয়। ১০৭১ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানরা বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের অংশবিশেষ দখল করে নেয়। এতে ইউরোপীয়রা আতংকিত হয়ে যায় পোপের নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।

৩. রাজনৈতিক কারণ : এ যুদ্ধের পেছনে ধর্মের চেয়ে বেশি ছিল ক্ষমতার লোভ। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকেই রাজ্য দখলের নেশায় মত্ত ছিলেন। যার ফলে যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

৪. অর্থনৈতিক কারণ : দশম শতাব্দী হতে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে মুসলমানদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলে ব্যবসায় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় বণিকগণ বাধার সম্মুখীন হন। 

ভেনিস, জেনোয়া, পিচলে প্রভৃতি শহরের উপর মুসলিম কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় তারা খ্রিস্টানরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 

১০ শতক হতে ইউরোপে জনসংখ্যার তুলনায় ভূমির পরিমাণ কমতে থাকলে তাদের উৎপাদন ব্যাহত হয়। বেকারত্ব বাড়তে থাকে। 

এ অবস্থায় ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ব্যবসা মুসলমানদের কর্তৃত্ব চলে যাওয়ায় তারা খুব হতাশ হয়ে পড়ে এবং তা উদ্ধারে আগ্রহী হয়।

৫. সাংস্কৃতিক কারণ : ইসলামের আধিবারের পূর্বে রোমান ও গ্রিকরা তাদের শিক্ষা ও সভ্যতার জন্য নিজেদের গর্বিত এবং অন্যান্য জাতিসমূহকে বর্বর ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনে করতেন। কিন্তু ইসলামের আবির্ভাবের পরে গ্রিক ও রোমান সংস্কৃতি হুমকির মুখে পড়ে।

৬. প্রত্যক্ষ কারণ : ১০৯৫ সালের ২৬ নভেম্বর দক্ষিণ পূর্ব ফ্রান্সের ক্লারমেন্ট শহরে খ্রিস্টানসের প্রধান কর্তা পোপ আরবান-২ একটি সুদূরপ্রসারী ভাষণ দেন এবং তিনি মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালান। বাইজান্টাইন সম্রাট আলক্সিস কমনেনাস আবেদন ও পোপের প্রচারণা এ যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ।

→ ক্রুসেডের ঘটনাবলি নিয়ে ক্রুসেডের পর্যায় বা ঘটনাবলী তুলে ধরা হলো :

প্রথম পর্যায়ের ক্রুসেড : (১০৯৫-১১৯৪ খ্রিস্টাব্দ) ১০৯৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম পর্যায়ের ক্রুসেড শুরু হয়। এ সময় পিটার গডফ্রে, বোহেমন্ড ও বলডুইনের নেতৃত্বে ইতালি, ফ্রান্স ও জার্মানির ক্রুসেডারগণ এশিয়া মাইনার দখল করে। 

এরপর ১০৯৮ খ্রিস্টাব্দে এডিসা ও এন্টিওকও দখলে নেয় তারা। পিটার গডফ্রের নেতৃত্বে খ্রিস্টানরা জেরুজালেম দখল করে। ক্রুসেডের এ সময়কার সময়ে মুসলমানদের উপর ভয়াবহ নির্যাতন শুরু হয় এবং প্রচুর মুসলিমকে হত্যা করা হয়।

১১২৭ খ্রিস্টাব্দে ইমামউদ্দিন জঙ্গি প্রথম ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেন। পরে ধারাবাহিকভাবে আলোপ্পো হারবান এবং মণ্ডল দখলে নেন। 

১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে ইমামউদ্দীন জঙ্গি এভিসা পুনরুদ্ধার করে সিরিয়া হতে খ্রিস্টান তথা ক্রুসেডারদেরকে বিতাড়িত করেন।

দ্বিতীয় পর্যায়ের ক্রুসেড : (১১৪৪-১২৯৩ খ্রিস্টাব্দ) ইমামউদ্দিন জঙ্গির মৃত্যুর পর তার পুত্র নুরুদ্দিন আলেপ্পোর সিংহাসনে বসেন। এ সময় খ্রিস্টানগণ পুনরায় এডিসা দখল করে নেয় এবং সেন্ট বার্নাডের নেতৃত্বে ক্রুসেডারের ঘোষণা আসে। 

জার্মান ও ফরাসির টেম্পলার ও হস্পিটালারদের একটি বিরাট বাহিনীর যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে নুরুদ্দিন জঙ্গি বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে এডিসাসহ অন্যান্য অঞ্চল দখল করে নেয়।

এদিকে মিশরের ফাতেমীয় খিলাফতের পতন ঘটিয়ে সালাউদ্দিন আইয়ুবীর নেতৃত্বে আইয়ুবীয় বংশের প্রতিষ্ঠা হয়। ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দে সালাহউদ্দিন আইয়ুবী হিত্তিনের যুদ্ধে ২০ হাজার সৈন্যসহ ফ্রান্ড নেতা রেজিল্যান্ডকে বন্দি করেন এবং প্রাণদণ্ড দেন। 

ফলে জেরুজালেম পুনরায় মুসলিমদের নিকট চলে আসে। এর পরবর্তীতে ইংল্যান্ডের রাজা রিচার্ড, ফ্রান্সের রাজা ফিলিপ অগাস্টাস এবং জার্মানির রাজা ফ্রেডরিক বারবারোসা তৃতীয় ক্রুসেড পরিচালনা করেন। 

ক্রুসেড চলাকালীন রাজা ফ্রেডরিক বারবারোসা সিলিসিয়ান নদীতে ডুবে মারা যান। জেরুজালেম উদ্ধার করতে না পেরে। খ্রিস্টানরা সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সাথে সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ হন ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে। 

সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে মারা গেলে ২য় পর্যায়ের ক্রুসেডের সমাপ্ত হয়।তৃতীয় পর্যায়ের ক্রুসেড (১১৯৩-১২৯১ খ্রিঃ) ১১৯৫ খ্রিস্টাব্দে পোপ তৃতীয় সেলেস্টাইন চতুর্থ ক্রুপেড ক্রুসেড ঘোষণা করেন। 

এ সময় ক্রুসেডারগণ জলপথে এসে বৈরুত অবরোধ করে কিন্তু সুলতান সালাহউদ্দিনের ভাই মালেক আল আদিলের হাতে পরাজিত হন এবং ১১৯৮ খ্রিস্টাব্দে একটি সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ হন। 

এ চুক্তিতে ৩ বছরের জন্য যুদ্ধ বিরতী রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু চুক্তি ভঙ্গ করে ১২০০ খ্রিস্টাব্দে পোপ ইনোসেন্ট ৫ম ক্রুসেডের ডাক দেন। 

ক্রুসেডারগণ কনস্টান্টিনোপল আক্রমণ করে ও অনেক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এ সময় অনেক মানুষকে হত্যা করেও ধনসম্পদ লুট করে ক্রুসেডারগণ স্বদেশে ফিরে যান। 

পরবর্তীতে ১২১৬ খ্রিস্টাব্দে লোভী ৩য় ইনোসেন্ট আবারও ৬ষ্ঠ ক্রুসেডের ডাক দেন। ক্রুসেডারগণ প্রথমে সিরিয়া যায়। 

সেখান থেকে মিশর ও ডালমাটিয়া আক্রমণ করে ধ্বংস্তামক কার্যক্রম পরিচালা করে। কিন্তু মুসলিমদের সাথে পেরে না উঠে ১২২১ সালে একটি সন্ধি করে তারা স্বদেশে ফিরে যায়।

১২৩৮ খ্রিস্টাব্দে নবম গ্রেগরী সপ্তম ক্রুসেডের সূচনা করেন। মালিক আদিলের পুত্র কামিল জার্মানির সম্রাটের কাছে জেরুজালেম হস্তান্তর করে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন। 

পরবর্তীতে ১২৩৯ খ্রিস্টাব্দে কামিলের পুত্র খ্রিস্টানদের পরাজিত করে জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করেন। ১২৪৪ খ্রিস্টাব্দে সর্বশেষ অর্থাৎ অষ্টম ক্রুসেডের ঘোষণা দেন ফ্রান্সের নবম লুই। 

তার নেতৃত্বে খ্রিস্টানরা মিশর আক্রমণ করেন। কিন্তু আইয়ুবীয় সুলতান তুরান শাহের নিকট ক্রুসেডারগণ পরাজিত হন। 

প্রকাশ্য আক্রমণের মাধ্যমে খ্রিস্টানদের অধিকৃত বিভিন্ন অঞ্চলগুলো মুসলমানরা ১২৯১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পুনরুদ্ধার করেন । এভাবে অষ্টম ক্রুসেড শেষ হয়।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ক্রুসেড ধর্মীয় উদ্দেশ্যে সংঘটিত হলেও মূলত এর গুরুত্ব ও ফলাফল ছিলো সুদূরপ্রসারী। ধর্মীয় গোড়ামী ও সামন্ত ব্যবস্থায় মুক্ত হয় বিশ্ব। 

এ যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় হলেও ক্ষতিসাধন হয়েছে বেশি। অন্যদিকে, লাভবান হয়েছে খ্রিস্টানরা। ঐতিহাসিক হিটি যথার্থই বলেছেন, প্রাচ্য অপেক্ষা প্রতীচ্যের জন্য ক্রুসেড ছিল অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ