কাকে তুমি সর্বশ্রেষ্ঠ সেলজুক সুলতান বলে মনে কর

কাকে তুমি সর্বশ্রেষ্ঠ সেলজুক সুলতান বলে মনে কর
কাকে তুমি সর্বশ্রেষ্ঠ সেলজুক সুলতান বলে মনে কর

কাকে তুমি সর্বশ্রেষ্ঠ সেলজুক সুলতান বলে মনে কর

  • অথবা, সেলজুকসের শ্রেষ্ঠ সুলতান মালিক শাহের কৃতিত্ব আলোচনা কর।
  • অথবা, সেলজুকসের শ্রেষ্ঠ সুলতান মালিক শাহের শাসনকাল বর্ণনা কর।

উত্তর : ভূমিকা : তুর্কি বংশোদ্ভূত সেলজুক সুলতানদের উত্থান, ইসলামের ইতিহাসে এবং আব্বাসীয় খিলাফতে একটি নতুন দিগন্তের সূচনা করে। 

একটি উন্নত জাতিগোষ্ঠী হিসেবে তারা এগারো শতকে সুন্নি ইসলাম এবং আব্বাসীয় দুর্বল খলিফাদের বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করেন। 

বিশেষ করে মালিক শাহের রাজত্বকালে সেলজুকরা ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে উপনীত হয়। এ সম্পর্কে ঐতিহাসিক P.K. Hitti বলেন, It was Malik shah (1072-92) Under whom saljuk powerreached is Meridian. "অর্থাৎ, তার রাজত্বকালে মুসলিম সাম্রাজ্যের সীমানা চতুদিকে সম্প্রসারিত হয়। 

সেলজুক রাজত্বের শাসনসংস্কার, প্রভাব প্রতিপত্তি, জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ও সর্বোপরি সুন্নি ইসলাম প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন মহানায়ক।”

→ পরিচয় ও সিংহাসন আরোহণ : সেলজুক সুলতান মালিক শাহ ১০৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৮ আগস্ট ইরানের ইস্পাহানে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন সেলজুক সুলতান আলপ আরসালান। 

মালিক শাহ ১০৭২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বর সিংহাসনে বসেন এবং ১০৯২ খ্রিস্টাব্দের ১৯ নভেম্বর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন।

— সর্বশ্রেষ্ঠ সেলজুক সুলতান : সেলজুক সুলতানদের মধ্যে মালিক শাহই সর্বশ্রেষ্ঠ সুলতানের স্থানের মর্যাদা অধিকারী নিম্নে তাঁর কৃতিত্বপূর্ণ কাজের বর্ণনা দেওয়া হলো :

১. সাম্রাজ্যের সুসংহতকরণ : মালিক শাহের রাজত্বের প্রথম দিকে কয়েকটি বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল। এদের একটি তার ভাইয়ের নেতৃত্বে সংঘটিত হয়েছিল। 

পূর্বে কাশ্মীর থেকে পশ্চিমে ভুমধ্যসাগরীয় পর্যন্ত এবং উত্তরে জর্জিয়া থেকে দক্ষিণে ইয়েমেন পর্যন্ত সাম্রাজ্যের সীমানা বিস্তৃতি লাভ করে। 

তিনি বিদ্রোহ দমনের পাশাপাশি সাম্রাজ্যের সুসংহতকরণ এবং শান্তিপূর্ণভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করে সুখ, শান্তি ও শৃঙ্খলা বৃদ্ধির চেষ্টায় মনোযোগ দিয়েছিলেন।

২. উপযুক্ত উজির নিয়োগ : সুলতান মালিক শাহ তার পিতার আমলের বিখ্যাত উজির নিজামুল মুলককে স্বপদে বহাল রেখে আব্বাসীয় খিলাফত এবং সেলজুক বংশের গৌরব বহুলাংশে বৃদ্ধি করেছিলেন। 

নিজামুল মুলকের বিচক্ষণতা, কর্ম নৈপুণ্যতা, দূরদর্শিতা এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার জন্যই মালিক শাহের রাজত্বকাল মহিমান্বিত ও চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। 

একনিষ্ঠ সেবা আত্মত্যাগ, বিচক্ষণতা ও প্রজাহিতৈষী শাসনে প্রীতি হয়ে সুলতান তাকে "আতাবেগ" বা আমিরের শাসনকর্তা উপাধিতে ভূষিত করেন।

৩. শাসন সংস্কার : মালিক শাহের শাসনামলে রাজধানী ইস্পাহান থেকে বাগদাদে স্থানান্তর করলে শাসনব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন আসে। ফলে অল্প সময়ের মধ্যে সুলতানের সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। 

এ সময়ে বিশাল এ সাম্রাজ্যের সর্বত্র শান্তিশৃঙ্খলা বিরাজ করছিল। তিনি রাজ্য জয় অপেক্ষা শাসন সংস্কারের ক্ষেত্রে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন।

৪. অর্থনৈতিক সংস্কার : মালিক শহ পারসা প্রথার উপর ভিত্তি করে একটি অর্থব্যবস্থা গড়ে তোলেন। তিনি সুষ্ঠু ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য সামন্ততন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া সৈন্যদের মধ্যে ভূমি কটন করে তাদের নিকট থেকে নিয়মিত কর আদায়ের ব্যবস্থা করেন

৫. শাসনতন্ত্র প্রণয়ন : নিজান-উল-মুলক কেবলমাত্র রাষ্ট্রীয় শাসনকার্য নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন না বরং লেখালেখির কাজেও সময় ব্যয় করতেন। তিনি বিধান ও বিদ্যোৎসাহী ছিলেন। 

সুলতান মালিক শাহের অনুরোধে উজির নিজামুল মুলক ১০৯২ খ্রিস্টাব্দে রাজ্য শাসন প্রণালির উপর 'সিয়াসতনামা' নামে একটি গবেষণামুলক গ্রন্থ রচনা করেন। 

এই গ্রন্থের মূল্যায়ন করতে গিয়ে ঐতিহাসিক আরনল্ড বলেন, “রাজনৈতিক নীতিমালা সংবলিত এ গ্রন্থটিতে শুধুমাত্র দার্শনিক নিবন্ধনই ছিল না, বরং এতে শাসনপ্রণালি, দরবার, বিচারকার্য, সামরিক বিচার এবং অর্থনৈতিক কার্যাবলির উপর ব্যবহারিক উপদেশ প্রদান করা হয়। তিনি এতে রাজতন্ত্রের ব্যাখ্যাও দান করেন।

৬. নিজামিয়া মাদ্‌রাসা : কায়রোর আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিদ্বন্দী হিসেবে বিদ্যোৎসাহী নিজামুল মুলক বাগদাদে নিজামিয়া মাদ্রাসা নামে ইসলামের সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন।

ইসলামের ধর্মতাত্ত্বিক ও চিন্তাবিদ আল-গাজ্জালি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। এছাড়া মহাকবি শেখ সালী এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন।

৭. মানমন্দির প্রতিষ্ঠা : নিজামুল মুলকের পরামর্শে সুলতান মালিক শাহ ১০৭৫ খ্রিস্টাব্দে নিশাপুরে একটি জ্যোতির্বিদ সম্মেলন আহ্বান করেন। এ সম্মেলনে জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণীত হয়।

এ পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার জন্য নিশাপুরে একটি মানমন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রখ্যাত দার্শনিক, জ্যোতির্বিদ কবি এবং অংকশাস্ত্রবিদ ওমর খৈয়ামের নেতৃত্বে জ্যোতির্বিদ ও বিজ্ঞানীগণ এখানে দিনরাত গবেষণা করেন।

৮. জালালি পঞ্জিকা তৈয়ারিকরণ : অঙ্কশাস্ত্রের বিশারদ ওমর খৈয়ামের নেতৃত্বে জ্যোতির্বিদ ও বিজ্ঞানীগণ জালালি পঞ্জিকা ভৈয়ারিকরণে সিদ্ধান্ত নেয়। 

এ সময় তারা চন্দ্র মাসের পরিবর্তে সৌর মাস অনুযায়ী গণনার প্রথা চালু করেন। প্রচলিত পদ্ধতির যাবতীয় ভুলগুলো সংশোধন করে একটি নতুন পঞ্জিকা তৈরি করেন। 

মালিক শাহ জালাল-উদ-দৌলাহর নামানুসারে এর নাম দেওয়া হয় জালালি পঞ্জিকা। জালালি পঞ্জিকা বর্তমানে প্রচলিত পঞ্জিকা পদ্ধতি অপেক্ষা বেশি সূক্ষ ও নির্ভুল ছিল। 

ঐতিহাসিক গিবন বলেছেন, “এটি জুলিয়ান পঞ্জিকা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ এবং গ্রেগরি পঞ্জিকার নির্ভুলভাবে সমকক্ষতা দাবি করেন।

৯. জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা : সুলতান মালিক শাহ ছিলেন মুলত প্রজাহিতৈষী। তিনি সেলজুক প্রজাদের মূল্যায়ন করতেন। এ সম্পর্কে পি.কে হিট্টি বলেন, ”সেলজুক সুলতান মালিক শাহ ছিলেন একমাত্র প্রতিনিধি যিনি সেলজুক তুর্কিদেরকে সম্মানের আসনে স্থান করে দিতে পেরেছিলেন। 

তিনি একজন বিদ্যোৎসাহী ও ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন। ইসলামি শিক্ষা ও প্রসারে তাঁর অবদান ছিল আসামান্য।” বিশ্বখ্যাত দার্শনিক, কবি, সাহিত্যিক জ্যোতির্বিদগণের | পদচারণায় তার রাজ দরবার ছিল মুখরিত।

১০. স্থাপত্যশিল্প : সেলজুক সুলতান মালিক শাহ স্থাপত্য শিল্পের একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি সাম্রাজ্যের অসংখ্য মসজিদ ও ইমারত নির্মাণ করেন। 

তার সময়ে ইস্পাহান মসজিদ, বিসতাম, আরদিস্তান, জাওয়ারা ও গুল পাইন প্রভৃতি অসংখ্য মসজিদ ও মিনার নির্মিত হয়। ফলে ইসলামি স্থাপত্যশিল্প বিকাশ লাভ করে ।

১১. জনকল্যাণমূলক কার্যাবলি : সেলজুক স্থাপত্য-শিল্প, পোড়া মাটি ইট এবং কারুকার্য খচিত মসজিদ, মিনার ও মাদ্রাসায় মূর্ত হয়ে রয়েছে। 

তাঁর ধর্মীয় অনুরাগ এবং জ্ঞান বিজ্ঞানের সাধনা পারস্য হতে উদ্ধৃত মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার অনুপ্রাণিত করে এবং তা সমগ্র ইসলামি সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। 

খলিফা হারুন-অর-রশিদ ও মামুনের মতো তিনি হজযাত্রী, বণিক ও পরিব্রাজকদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য প্রহরার ব্যবস্থা এবং আরাম আয়েশের জন্য বিশ্রামাগারে বা সরাইখানা নির্মাণ করেন। এ সময়, কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের প্রভৃতি উন্নতি সাধিত হয় ।

১২. মৃত্যু : সুলতান মালিক শাহ প্রায় একুশ বছর কৃতিত্বের সাথে রাজত্ব করে। মালিক শাহের রাজত্বের শেষভাগে এক নিকৃষ্ট গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ইসলামের ইতিহাসে একটি রক্তলোলুপ অধ্যায়ের সূচনা হয়। 

তারপর ১০৯২ খ্রিস্টাব্দে ঊনচল্লিশ বছর বয়সে মারা যান। তাঁর মৃত্যুতে সুন্নি ইসলাম ও মুসলিম সমাজের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়। তা কখনই সেলজুক আমলে পূরণ করা সম্ভব হয়নি।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সুলতান মালিক শাহ ছিলেন একজন ন্যায়বিচারক শাসক। মালিক শাহ জালাল-উদ- দৌলাহ সেলজুক বংশ এবং আব্বাসীয় বংশের স্থায়িত্ব বৃদ্ধিতে যে উদ্যম ও গতিশীলতার পরিচয় দিয়েছেন সমসামরিক। 

বিশ্বের খুব কম শাসকের পক্ষেই এরূপ সম্ভব হয়েছিল। তিনি সাম্রাজ্যের ঐক্য ও সংহতি বিধানে এবং শাসনে সংস্কারের যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন সেজন্য অধ্যাপক পি.কে. হিট্রি তাকে শ্রেষ্ঠ সেলজুক সুলতান হিসেবে অভিহিত করেছেন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ