মামলুক ও মোঙ্গল সম্পর্ক বর্ণনা কর

মামলুক ও মোঙ্গল সম্পর্ক বর্ণনা কর
মামলুক ও মোঙ্গল সম্পর্ক বর্ণনা কর

মামলুক ও মোঙ্গল সম্পর্ক বর্ণনা কর

  • অথবা, মিশরের মামলুক ও মোঙ্গল বংশ সম্পর্কের উপর আলোকপাত কর।
  • অথবা, মামলুক ও মোঙ্গল সম্পর্কসমূহ বিস্তারিত আলোচনা কর।

উত্তর : ভূমিকা : তেরো শতকের শেষার্ধে মোঙ্গলদের সাথে মামলুকদের সম্পর্ক ছিল দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষে ভরপুর। মিশরের ভৌগোলিক গুরুত্বের কারণে মামলুকদের নিকট থেকে এটা দখল করার জন্য পারস্যের মোঙ্গলরা সবসময় উদগ্রীব থাকত। 

এছাড়া মোঙ্গলদের খ্রিস্টানঘেঁষা নীতি এবং মোঙ্গল-ক্রুসেডার হৃদ্যতা মোঙ্গল-মামলুক অভিযানকে ত্বরান্বিত করেছে। খ্রিস্টানদের নীতি ছিল মোঙ্গলদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করে তাদের সাহায্যে জেরুজালেম উদ্ধার করা। 

অন্যদিকে মোঙ্গলদের উদ্দেশ্য ছিল ভূমধ্যসাগরীয় বিশ্বের অন্তত একটি অঞ্চল নিজেদের আধিপত্য স্থাপন করে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ করা । মামলুকরা তাদের সম্প্রসারণ নীতিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে পড়ে ।

→ মোঙ্গল ও মামলুক সম্পর্ক : মিশরের মামলুক বংশের সুলতানদের সাথে পারস্যের ইলখানি মোঙ্গলদের সম্পর্ক কিরূপ ছিল নিম্নে তা আলোচনা করা হলো :

১. সাইফুদ্দিন কুতুয ও হালাকু খান : বাহারি মামলুক বংশের সুলতান সাইফুদ্দিন কুতুযের সংক্ষিপ্ত রাজত্বকালের বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো মোগলদের সাথে যুদ্ধ। 

১২৫৮ সালে চেঙ্গিস খানের পৌত্র হালাকু খান বাগদান বিধ্বস্ত করে মিশর আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। কিন্তু এ সময় মোঙ্গল অধিপতি মেধু খান মৃত্যুবরণ করলে হালাকু খান রাজধানী কারাকোরাসে ফিরে যান এবং মোগল সিংহাসনে আরোহণ করেন। 

মামলুক সুলতান কুতুজ মোঙ্গলদের অধীনতা স্বীকারে অস্বীকৃতি জানালে এবং প্রকাশ্যে মোঙ্গল দূতকে হত্যা করলে মামলুক মোঙ্গল সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে পড়ে। 

মোঙ্গল সেনাপতি কেতবুদ্ধা দশ হাজার সৈন্য নিয়ে এবং মামলুক সুলতান কুতুজ ও সেনাপত্তি বাইবার্স এক লক্ষ বিশ হাজার সৈন্য নিয়ে ১২৬০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর প্যালেস্টাইনের বায়সান এবং নাবহুসের মধ্যবর্তী আইন-ই-জালুত নামক স্থানে যুদ্ধে লিপ্ত হন। 

এখানে এক চোখ ধাধানো মীমাংসাত্মক যুদ্ধে মোঙ্গলরা পরাজিত হয়। মোঙ্গল সেনাপতি কেতনুঘা যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন। তার ছিন্ন মস্ত ক প্রদর্শনীর জন্য কায়রোতে পাঠানো হয়। 

এটি ছিল একটি ভাগ্য নির্ধারণ যুদ্ধ। কেননা এই যুদ্ধে মামলুকরা পরাজিত হলে তারা নিঃশেষ হয়ে যেত এবং প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী সভ্যতার কেন্দ্রভূমি মিশর মোঙ্গলদের হাতে বিধ্বস্ত হতো।

২. বাইবার্স ও মোঙ্গলগণ : ১২৬০ সালে ২৪ অক্টোবর রুকনউদ্দিন বাইবার্স এক ছলনার আশ্রয় নিয়ে সুপরিকল্পিতভাবে কুভুজকে হত্যা করে মামলুক সিংহাসনে আরোহণ করেন। 

তার ১৭ বছরের রাজত্বকালে তিনি প্রধানত মোগল বাহিনী, খ্রিস্টান ধর্মযোদ্ধা ও গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়ের সাথে যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত ছিলেন। 

আইন জালুত ও হিমসের যুদ্ধে মোঙ্গলগণ উপর্যুপরি দু'বার পরাজিত হয়েও তারা মিশরের মামলুক বিরোধী নীতি পরিত্যাগ করেনি। 

বাগদাদের মোঙ্গল গভর্নর কারাবুঘার নেতৃত্বে মোঙ্গলরা আব্বাসীয় খলিফা আল-মুতানসির বিল্লাহকে পরাজিত ও হত্যা করতে সক্ষম হওয়ায় তাদের মামলুক বিরোধী নীতি পূর্বাপেক্ষা আরো জোরদার হয়।

১৯৬৬ সালে তারা হালাকু খানের নেতৃত্বে মার্কিন, হিনস্ ও কাইফা প্রভৃতি স্থান দখল করে অবশেষে বিরায় এসে উপস্থিত হয়। 

কিন্তু বিরার অনতিদূরে এক তুমুল যুদ্ধে মোগলরা তৃতীয়বারের মতো বাইবাসের নিকট শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। এ সময় হালাকু খানের মৃত্যু হলে বাইবাসের রাজত্বকালে মোঙ্গলরা আর মিশর আক্রমণের দুঃসাহস দেখায়নি ।

৩. কালাউন ও মোঙ্গলগণ : সুলতান সাইফুদ্দিন কালাউন ১২৭৯ সালে মিশরের মামলুক সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি মোট ১১ বছর রাজত্ব করেন। এর মধ্যে অধিকাংশ সময়ই তাকে মোঙ্গল বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ লিপ্ত থাকতে হয়। 

দামেস্তে বিদ্রোহ দমন করে যখনই মামলুকরা সমগ্র সিরিয়ায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করলো তখনই ইলখানি মোঙ্গলরা আবাগা খান ও মেজু খানের নেতৃত্বে সিরিয়ার আলেপ্পো নগরী দখল করে। 

অধিকৃত শহরবাসীর উপর মোঙ্গলরা এমন অত্যাচার চালায় যে, প্রাণ ভরে অনেকে তাদের সর্বস্ব পরিত্যাগ করে কায়রোতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। 

আবাগা খান জর্জিয়া ও আর্মেনিয়ার খ্রিস্টান শক্তির সহায়তায় ৮০,০০০ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে মিশর আক্রমণ করেন। পক্ষান্তরে, কালাউন মাত্র ৫০,০০০ সৈন্য নিয়ে মোঙ্গল ও খ্রিস্টান বাহিনীর মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত হন। 

১২৮০ সালে হিমসের প্রান্তরে উভয় বাহিনী তুমুল যুদ্ধে লিপ্ত হন। এই যুদ্ধে আবাগা খান মামলুকদের নিকট শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন ১২৮১ সালে আবাগা খানের মৃত্যু হলে তদীয় পুত্র তারনার মোঙ্গল সিংহাসনে আরোহণ করেন। 

কিন্তু তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে আহম্মদ নাম ধারণ করার মামলুক-মোঙ্গল সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয়। মামলুকদের সাথে সম্ভাব স্থাপন করার জন্য তিনি কালাউনের দরবারে দূত প্রেরণ করেন এবং সাময়িকভাবে মামলুক-মোঙ্গল বৈরী সম্পর্কের অবসান ঘটে।

৪. আল-আশরাফ ও মোঙ্গলগণ : সুলতান কালাউনের মৃত্যুর পর তার পুত্র আল আশরাফ বলিল ১২৯০ সালে মিশরের মামলুক সিংহাসনে বসেন। 

সিরিয়ায় মামলুক শাসন সুসংহত করার পর আশরাফ মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন। ১২৯২ সালে মামলুক বাহিনী তার নেতৃত্বে সম্মিলিত মোঙ্গল ও আর্মেনিয়া শক্তিকে পরাজিত করে কালাতরুম দখল করেন। 

সুলতান আশরাফ এই নব নির্বাচিত শহরের নাম দেন “কালাউন মুসলিমিন" অর্থাৎ মুসলমানদের কিন্না কিন্তু মামলুকদের এই বিজয় স্থায়ী হয়নি।

৫. আল-মাসির ও মোঙ্গলগণ : মামলুক সুলতান আল নাসিরের রাজত্বকাল (১২৯৩-১৩৪১) ছিল দীর্ঘ ঘটনাবহুল ও বৈচিত্র্য্যময়। তার শাসনামলে মিশরের অভ্যন্তরীণ গোলযোগের সুযোগ নিয়ে পাজান খানের নেতৃত্বে মোঙ্গলরা মিশর আক্রমণ করেন। 

মোঙ্গল বাহিনীর সাথে তাদের মিত্রশক্তি আর্মেনিয়া ও জর্জিয়ার সৈন্যগণও যোগদান করেন। ফলে ১২৯৯ সালে হিমস এর নিকট জানা ঊস সুরুজ নামক স্থানে উভয় বাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। 

এই যুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ মোঙ্গল বাহিনীর নিকট মামলুকগণ পরাজয় বরণ করেন এবং মোঙ্গলগণ সিরিয়ার রাজধানী নামে দখল করতে সক্ষম হন। 

কিন্তু পরবর্তী মাসে তারা সিরিয়া পরিত্যাগ করে যেতে বাধ্য হন এবং সমগ্র সিরিয়া মামলুক কর্তৃক আবার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৩০৩ সালে মোঙ্গলরা পুনরায় কুতলুগ শাহের নেতৃত্বে সিরিয়া আক্রমণ করেন।

কিন্তু মোঙ্গলরা এবার মারজ-উস-সাফারের যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। মোঙ্গল মামলুক সংঘর্ষের ইতিহাসে একে একটি চূড়ান্ত যুদ্ধ বলে বর্ণনা করা যেতে পারে। প্রায় একশ বছরের মধ্যে মোঙ্গলরা আর মিশর আক্রমণ করতে সাহস পায় নি।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মিশরে মামলুক সুলতান ও পারস্যের ইলখানি মোঙ্গলদের সম্পর্ক খুব মধুর ছিল না। মোঙ্গলরা বারবার সিরিয়া ও মিশর আক্রমণ করে মামলুক সুলতানদের অভিষ্ট করে তুলতো। 

কোন মামলুক সুলতানের সময় মোঙ্গনের উৎপাত বেড়ে যেত আবার কখনও তেমন আক্রমণ মোঙ্গলরা করতো না। আইন আলুতের যুদ্ধ, মার উস সাফার যুদ্ধগুলোতে মোগলরা মামলুদের নিকট পরাজিত হয়। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ