মিশরের ইতিহাসে মামলুকদের অবদান আলোচনা কর

মিশরের ইতিহাসে মামলুকদের অবদান আলোচনা কর
মিশরের ইতিহাসে মামলুকদের অবদান আলোচনা কর

মিশরের ইতিহাসে মামলুকদের অবদান আলোচনা কর

  • অথবা, মিশরের ইতিহাসে মামলুকদের অবদান মূল্যায়ন কর।

উত্তর : ভূমিকা : সাজার উদ-দার কর্তৃক মিশরে মামলুক বংশ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস ইসলামের তথা সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে এক বিস্ময়কর ঘটনা। মামলুক রাজত্ব (১২৫০ ১৫১৭ খ্রি.) মিশরের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করেছিল।

আইয়ুবীয় সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর মৃত্যুর পর মুসলিম জাহানের এক চরম দুর্দিনে মামলুকরা ইসলামকে আসন্ন ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেন। 

ইসলামের ইতিহাসে মামলুক বংশের অবদান অত্যাধিক। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিদ্রোহ দমন ও রাজ্য দখল করার পাশাপাশি শিল্প-সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে তা যে উন্নয়ন সাধন করেন তা বিশ্বের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে ।

মামলুক বংশের পরিচয় : মামলুক শব্দের অর্থ ক্রীতদাস। মিশরে যুদ্ধ বন্দিদেরকে দাস বা ক্রীতদাস বলা হত । উরাল পর্বতমালা এবং কাস্পিয়ান সাগরের মধ্যবর্তী কিপচাক অঞ্চলে ছিল এই মামলুকদের আদি বাসস্থান। 

তারা ছিল তুর্কিদের কুমান শাখার আধিবাসী। আইয়ুবী সুলতান তার দেহরক্ষী বাহিনীতে ও সেনাবাহিনীতে এক সময় প্রচুর মামলুকদেরকে নিয়োগ প্রদান করে। 

এরা এক সময় শক্তিশালী হয়ে ওঠে। অপরদিকে আব্বাসীয় খলিফা মুস্তাসিম বিল্লাহ তার হেরেমের এক রূপবতী ক্রীতদাসীকে আইয়ুবী সুলতান মালিক আস সালিহের দরবারে উপহারস্বরূপ প্রেরণ করেন। 

এই ক্রীতদাসীর নাম ছিল শাজার-উদ-দার। পরবর্তীতে সুলতান মালিক আস সালিহ তাকে ক্রীতদাসী থেকে মুক্ত করে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে। 

১২৪৯ খ্রিস্টাব্দে আইয়ুবী সুলতান মালিক আস সালিহ মারা যান। এ সময় মালিক আস সালিহের পুত্র তুরান শাহ ক্রুসেডারদের বিদ্রোহ দমনে রাজ্যের বাইরে ছিল ফলে শালার-উদ-দার শাসন ক্ষমতার ভার নিজের হাতে নেন। 

ডুরান শাহ পিতার মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে রাজ্যে ফিরে আসে এবং আইয়ুবী সিংহাসনে বসেন। কিন্তু শাজার-উদ-দার প্রধান সেনাপত্তি বাইবার্স-এর সহযোগিতায় ডুরান শাহকে হত্যা করেন এবং ১৫২০ খ্রিস্টাব্দে মিশরে মামলুক বংশের শাসন শুরু করে। 

শাজার-উন-দার নিজেও একজন তুর্কি ক্রীতদাস ছিল বিধায় তার প্রতিষ্ঠিত বংশ মামলুক বংশ নামে পরিচিত। এ মামলুক বংশ ১২৫০-১৫১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মিশরের শাসন ক্ষমতায় ছিল।

→ মিশরে মামলুকদের অবদান : নিম্নে মিশরের ইতিহাসে মামলুক সুলতানদের অবদান আলোচনা করা হলো :

১. জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা : মামলুক সুলতানগণ ক্রসেডারদের পরাজিত করে ইসলাম ও মুসলিম সাম্রাজ্য পুনরপ্রতিষ্ঠা করেন। তাদের শাসনামলে শান্তিশৃঙ্খলা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক উৎকর্ষ সাধিত হয়। 

ইসলামের ইতিহাসে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মামলুকদের অবদান অনস্বীকার্য। তারা জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা শিল্পকলা, সাহিত্যে প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রাখেন।

২. চিকিৎসা বিজ্ঞান : চিকিৎসা বিজ্ঞান মামলুকদের অবদান রয়েছে। মামলুক সুলতান কালাউন চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য কায়রোতে একটি হাসপাতাল নির্মাণ করেন। 

তিনি এই হাসপাতালটি নুরুউদ্দিনের হাসপাতালের অনুকরণে তৈরি করেন। ১২৮৪ খ্রিস্টাব্দে হাসপাতালটির নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়। 

হাসপাতাল ছাড়াও এখানে একটি মসজিদ ও সমাধি ছিল। এ হাসপাতালের অধ্যক্ষ ছিলেন আবুল হাসান আলী ইবনে উল নাফসী। 

তিনি ফুসফুসের রক্ত সঞ্চালন ক্রিয়া সম্পর্কে 'সারহ তাশরীহ আল কানুন' নামক একটি প্রামণ্য গ্রন্থ রচনা করেন। 

মামলুক যুগে স্ত্রীরোগ সম্পর্কে প্রামাণ্য গ্রন্থ রচিত হয় এবং এক্ষেত্রে মিশরের আল তাফাসী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

৩. চারুকলা ও স্থাপত্য : চারুকলা ও স্থাপত্যে মামলুক শাসকরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। মামলুকদের রাজত্বকালে মিশরে স্থাপত্যশিল্প ও চারুকলার গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল। 

এ যুগের স্থাপত্য শৈলী গড়ে উঠে নূরিদ এবং আয়ূবীয় স্থাপত্যের আদলে। তেরো শতকে সিরিয়া এবং মেসোপটেমীয়ার প্রত্যক্ষ প্রভাবে নতুন মাত্রা পায়। 

এ সময় অট্টালিকা বা স্মৃতিসৌধ নির্মাণের ক্ষেত্রে ইটের পরিবর্তে পাথর নেওয়া হয়। মসজিদ সংলগ্ন বিদ্যালয় তৈরির ঐশাকার কাঠামোকে গড়ে তোলা হয় আরও নিখুঁতভাবে। মামলুক আমলে একাধিক গম্বুজ বিশিষ্ট ইমারত নির্মিত হয়েছিল।

ঐতিহাসিক পি.কে হিট্রির মতে, টলেমী এবং ফেরাউনের যুগের পর মিশরের ইতিহাসে স্থাপত্যকীর্তি ও চারুশিল্পের গুণাগুণ বা বৈশিষ্ট্য উৎকর্ষের দিক হতে মামলুকদের অবদান নজীরবিহীন।

৪. কারুশিল্প : মামলুক সুলতানগণ কারুশিল্পে কৃতিত্বের সাক্ষর রাখেন। মসজিদের উপকরণ হিসেবে বিভিন্ন ধাতব দ্রব্য ব্যবহৃত হতো। কেবলমাত্র ধাতব পাত্রেই অসাধারণ কারু শিল্পের প্রতিভা প্রয়োগ হয়নি। 

মৃৎপাত্র কাষ্ঠ খোদিত কুরক্ষী মিহরাবের মোজাইক ব্রোজের অসাধারণ নকশা করা মসজিদ দুয়ারসহ অসংখ্য ক্ষেত্রে মিশরের কারুশিল্পের প্রভাব বিদ্যমান। 

গ্রাফিয়াতো রীতিতে নির্মিত এবং কায়রো থেকে সংগৃহীত একটি আকর্ষণীয় মৃৎপাত্রে ব্যবহৃত নকশাবলি নিঃসন্দেহে মামলুক শিল্পকে মনে করে দেয়।

৫. ইতিহাস রচনা : ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে মামলুক শামসনামল খুবই প্রসিদ্ধ ছিল। কারণ এ সময় ইসলামের বেশ কয়েকজন ঐতিহাসিকের আগমন ঘটে। 

তাদের মধ্যে আবুল ফিদা, ইবনে তাগরি বিরদি আল সুয়ুতি এবং আল মাকরিজী উল্লেখযোগ্য ছিলেন। আবুল ফিদা সুলতান নাসিরের অন্তরঙ্গ সহচর ছিলেন। 

তিনি ‘মুক্তাতাসার তারিখ উল বাশার' (অর্থাৎ মানব জাতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস) নামক বিখ্যাত ইতিহাসগ্রন্থ রচনা করেন। এছাড়া বিশ্বকোষ রচনায় মামলুক যুগ উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। 

এ সময়ের দুইজন খ্যাতনামা বিশ্বকোষ প্রণেতা ছিলেন আহমদ উল নুওয়াইবী এবং আহমদ উল কালকাশাব্দী। নুওয়াইবী “নিহাইয়াত আল আরাব আর আদর' এবং কালকাশান্দী ‘সুব্ধ উল আশা' নামক গ্রন্থ রচনা করেন।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মিশরে মামলুক সুলতানগণ প্রায় তিন শত বছর অত্যন্ত গৌরবের সাথে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। 

এ সময় জ্ঞান-বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান, ইতিহাসবিদ্যা, সাহিত্যে, ধর্মশাস্ত্র প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। 

মিশরের ইতিহাসে তথা ইসলামের ইতিহাসে মামলুকদের অবদান অপরিসীম। তাদের এ অবদান ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ