প্রাচীন বাংলার আর্থ সামাজিক অবস্থার বিবরণ দাও
প্রাচীন বাংলার আর্থ সামাজিক অবস্থার বিবরণ দাও |
প্রাচীন বাংলার আর্থ সামাজিক অবস্থার বিবরণ দাও
- অথবা, প্রাচীন বাংলার আর্থসামাজিক অবস্থা উল্লেখ কর।
উত্তর : ভূমিকা : প্রাচীনকাল থেকেই বাংলা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপার লীলাভূমি। অসংখ্য নদী-নালা, খাল, বিল, মাঠ-ঘাট, পথ-প্রান্তর, প্রকৃতি মিলনে সৃষ্টি হয়েছে যে এক অপরূপ সুন্দর্যের লীলাভূমি।
প্রাচীনকাল থেকেই বাংলা ছিল কৃষিনির্ভর। তাই বাংলার আর্থসামাজিক অবস্থার ক্ষেত্রে কৃষির অবদান অপরিসীম।
বিভিন্ন কৃষিজাত দ্রব্যকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের শিল্প কলকারখানা এবং নানাবিধ প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা-বাণিজ্য। তাই বলা হয়ে থাকে প্রাচীনকাল থেকে বাংলার আর্থসামাজিক অবস্থা ছিল সচ্ছল এবং সমৃদ্ধিশালী ।
→ প্রাচীন বাংলার আর্থসামাজিক অবস্থা : নিম্নে প্রাচীন বাংলার আর্থসামাজিক অবস্থার বিবরণ উল্লেখ করা হলো :
(ক) প্রাচীন বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা : প্রাচীন বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত সচ্ছল এবং উন্নত।
নিম্নে প্রাচীন বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. কৃষির অবস্থা : প্রাচীন বাংলার অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রাণ ছিল কৃষি। মূলত কৃষিকে ঘিরেই প্রাচীন বাংলার অর্থনীতি ছিল সচ্ছল।
এ সময় বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপন্ন করা হতো এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ধান, পাট, আখ, তুলা, ডাল প্রভৃতি ছিল প্রাচীন বাংলার উৎপন্ন ফসলের মধ্যে অন্যতম।
এছাড়া বিভিন্ন ধরনের ফল ও প্রাচীন বাংলায় উৎপন্ন হতো। এ সময় সমস্ত জমির মালিক ছিল রাজা।
তাই কৃষক রাজার জমিতে চাষ করে উৎপন্ন ফসলের একটি নির্দিঃ পরিমাণ রাজার কোষাগারে জমা দিত। কৃষির এ উন্নতিই প্রাচীন বাংলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পরিচয় বহন করে।
২. শিল্প : প্রাচীন বাংলার অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হচ্ছে শিল্প। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে যে এ সময় বাংলায় উন্নতমানের তুলা উৎপাদিত হতো।
এ তুলা থেকে মিহি সুতি কাপড় প্রস্তুত হতো। এ সময় বাংলায় এক প্রকারের কার্পাস কাপড় তৈরি হতো যা বাংলার বাইরে রপ্তানি হতো।
এ সময় বাংলায় বেশ কয়েকটি কুটির শিল্পের উল্লেখ পাওয়া যায়, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বস্ত্র শিল্প, ধাতু শিল্প, চর্ম শিল্প প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
এ সময় লোহা দিয়ে কর্মকাররা বিভিন্ন ধরনের হাতিয়ার তৈরি করতো। যথা দা, কাস্তে, কোদাল, কুড়াল, শাবল প্রভৃতি। এছাড়াও বাংলায় প্রচুর আখ উৎপাদনের জন্য প্রাচীন বাংলা চিনি শিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল।
৩. বাণিজ্য : প্রাচীন বাংলা ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বিখ্যাত। এ সময় দুই ধরনের বাণিজ্যের প্রচলন ছিল।
৪. অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য : বাংলা ছিল নদীমাতৃক একটি দেশ তাই নৌপথে বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল প্রাচীনকালে। নদীপথে আমদানি রপ্তানি সুবিধা হওয়ায় এবং তুলনামূলক পরিবহণ ব্যয় কম হওয়ায় মৌপথকে কেন্দ্র করে বাংলার অভ্যন্তরে বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার লাভ করেছিল। এ অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে বাংলার গ্রামগুলো হয়ে উঠেছিল সমৃদ্ধশালী।
৫. বৈদেশিক বাণিজ্য : অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের পাশাপাশি বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রাচীনকালে বাংলা বেশ উন্নতি লাভ করেছিল।
জনপথ ও স্থলপথ উভয় পথে বহির্দেশের সাথে বাণিজ্যিক যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবিধা থাকায় বাংলা বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি লাভ করে।
এ সময় জলপথে সম্পর্ক গড়ে ওঠে, সিংহল, ব্রহ্মদেশ, চম্পা, চীন, মালয়, শ্যামদেশ, সুমাত্রা, আরব প্রভৃতি দেশের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং স্থলপথে নেপাল তিব্বতসহ মধ্য এশিয়ার প্রভৃতি দেশের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠে এর ফলে বাংলা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক সমৃদ্ধি লাভ করে।
(খ) সামাজিক অবস্থা : প্রাচীন বাংলা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে রকম সমৃদ্ধি লাভ করেছিল সামাজিক ক্ষেত্রেও একই রকম সমৃদ্ধি লাভ করেছিল ।
নিম্নে প্রাচীন বাংলার সামাজিক অবস্থা বর্ণনা করা হলো-
১. নারীর মর্যাদা : প্রাচীন বাংলার মেয়েদের সম্পর্কে বাৎসায়ন তাদের, মৃদুভাষিণী, কোমলঙ্গী ও অনুরাগবতী বলে উল্লেখ করেছেন। এ সময় পর্দা পথার প্রচলন ছিল।
বিধবা নারী অপুত্রক স্বামীর সম্পত্তির মালিক হতো। এ সময় সতীদাহ প্রথার প্রচলন ছিল। পুরুষদের মধ্যে বহু বিবাহ প্রচলন ছিল কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রে তা নিষিদ্ধ ছিলো।
২. শিক্ষা ব্যবস্থা : শিক্ষা ক্ষেত্রেও বাংলা ছিল বেশ অগ্রগতি সম্পন্ন। এ সময় পাঠ্যসূচি হিসেবে বিভিন্ন শাস্ত্রসমূহ অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, বেন, মীমাংসা, ধর্মশাস্ত্র, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, অর্থশাস্ত্র, গণিত, জ্যোতিষ শাস্ত্র, তর্কশাস্ত্র প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া এ সময় বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের গ্রন্থসমূহ পঠিত হতো।
৩. কৌলিন্য প্রথা : প্রাচীনকালে বাংলার বিভিন্ন জাতি বর্ণের লোক বাস করতো। তাই এদের মধ্যে প্রচলিত ছিল জাতি ও বর্ণভেদ প্রথা।
এ সময় ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, শূদ্র, ক্ষত্রিয় এ চারটি- সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত ছিল কৌলীন্য প্রথা। বিশেষ করে বল্লাল সেনের শাসন আমলে এ কৌলীন্য প্রথার প্রসার ও প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
৪. বিনোদন : বিনোদন বা আমোদ প্রমোদের ক্ষেত্রে প্রাচীন বাংলার জনগণ ছিল বেশ উৎসাহী। এ সময় তারা আনন্দ-ফুর্তি করার জন্য বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার ব্যবস্থা করতো এর মধ্যে নৌকা বাইচ, কৌতুক প্ৰতিযোগিতা প্রভৃতির আয়োজন করা হতো।
এ সময়কার বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায় পাহাড়পুরে প্রাপ্ত লিপিতে, যথা- বীণা, বাঁশি, মুসঙ্গ, করতাল, ঢাক, ঢোল প্রভৃতি এছাড়া এ সময় নারীদের মধ্যে উদ্যান রচনা, জলক্রীড়া প্রভৃতি আমোদের প্রচলন ছিল।
৫. আবাসস্থল : এ সময় তারা অধিকাংশই গ্রামে বসবাস করতো। আর এসব গ্রামের বেশি ভাগই গড়ে উঠত নদীর কাছে। কারণ নদীপথেই যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল সহজ।
এছাড়া এ সময় অনেক শহর ও গড়ে উঠেছিল। রামাবতী শহরের বর্ণনায় স্বর্ণময় বিশাল অট্টালিকা ও শহরের চাকচিক্যময় জীবনের পরিচয় পাওয়া যায়।
৬. খাদ্য : প্রাচীন বাঙালিদের প্রধান খাদ্যের তালিকায় ছিল- ভাত, মাছ, মাংস, শাকসবজি, দুধ, ফলমূল প্রভৃতি ছিল এসময়কালের মানুষের প্রধান খাদ্য। এছাড়াও এ সময় মাদক জাতীয় খাদ্য দ্রব্যেরও উল্লেখ পাওয়া যায় এর মধ্যে মদ ছিল উল্লেখযোগ্য।
৭. নৈতিক জীবন : প্রাচীন বাংলার মানুষের মধ্যে নৈতিক জীবন বোধের এক বিশেষ পরিচয় পাওয়া যায়। তারা সত্য, সততা, দয়া, দান প্রভৃতি সৎকর্মের জন্য তাদের মহিমাকীর্তন করা হতো। আবার কেউ অন্যের অনিষ্ট করলে তাদের জন্য শান্তির ব্যবস্থা করা হতো।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, প্রাচীন বাংলা ছিল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একটি সমৃদ্ধশালী দেশ। যার বাণিজ্যিক সম্পর্ক বহির্দেশে পর্যন্ত পৌঁছে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছিল।
এছাড়া প্রাচীন বাংলার সামাজিক অবস্থার যে চিত্র আমরা বিভিন্ন উৎস থেকে জানতে পারি এবং উপরে উল্লিখিত আলোচনা হতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, প্রাচীন বাংলার সমাজ ব্যবস্থা ছিল একটি সুপরিকল্পিত সমাজ ব্যবস্থা। সুতরাং বলা যায় যে, প্রাচীন বাংলার আর্থসামাজিক অবস্থা ছিল অনেক উন্নত।