সভ্যতার ইতিহাসে ক্রুসেডের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা কর
সভ্যতার ইতিহাসে ক্রুসেডের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা কর |
সভ্যতার ইতিহাসে ক্রুসেডের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা কর
- অথবা, সভ্যতার ইতিহাসে ক্রুসেডের প্রভাব মূল্যায়ণ কর।
উত্তর : ভূমিকা : মধ্যযুগের শুরু থেকেই খ্রিস্টধর্মেaর বিস্তার ঘটতে থাকে। আরব ভূমি থেকে ইসলাম ধর্মের বিজয়াভিযান ছড়িয়ে পড়ার পূর্ব পর্যন্ত খ্রিস্টধর্ম কোনোরূপ বাধার মুখোমুখি হয়নি।
কিন্তু ইসলাম ধর্ম অত্যন্ত দ্রুততার সাথে বিস্তৃত হতে থাকে। মুসলমানদের রাজ্য বিস্তারের গতি ছিল অপ্রতিরোধ্য। ফলে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে ইউরোপের খ্রিস্টানরা।
এরই প্রতিক্রিয়া হিসেবে একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীব্যাপী সময় ইউরোপে সর্বগ্রাসী ধর্মযুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধ ইতিহাসে ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ নামে পরিচিত।
→ সভ্যতার ইতিহাসে ক্রুসেডের প্রভাব : ক্রুসেড হলো ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মের মধ্যে প্রথম বিঘোষিত সংগ্রাম। খ্রিস্টান ইউরোপের অর্বাচীন, বর্বর ও অশিক্ষিত লোকেরাই ক্রুসেডে যোগদান করেছিল। যুদ্ধে জয়-পরাজয় যাই ঘটুক না কেন এই যুদ্ধ বিশ্ব সভ্যতায় এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে।
১. ধ্বংসাত্মক পরিণতি : প্রকৃতপক্ষে ক্রুসেড ছিল ধ্বংসলীলার প্রতীক স্বরূপ। ক্রুসেডসমূহ ইতিহাসের এক চরম ক্ষিপ্ততাপূর্ণ অধ্যায়।
ক্রুসেডের ফলে অসংখ্য মুসলমান প্রাণ হারায় এবং পশ্চিমে এশিয়ার এক বিস্তীর্ণ এলাকা এবং নগররাজি শ্মশানে পরিণত হয়েছিল।
অন্যদিকে, খ্রিস্টানরা বিপুল ধনসম্পদ এবং লক্ষ লক্ষ প্রাণ বিসর্জান নিয়োও মুসলমানদের হাত হতে পবিত্র ভূমি জেরুজালেম উদ্ধার করতে পারেনি। ধ্বংস আর রক্তক্ষয়ই ছিল ক্রুসেডের প্রভাব ।
২. কর ব্যবস্থা প্রবর্তন : সালাউদ্দিন আইয়ুবীর সকল রাজ্যে কর ব্যবস্থা কার্যকর ছিল। ক্রুসেডের ফলে অন্যন্য রাজারা এ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। তারা সালাউদ্দিনের নামানুসারে করগুলোর নামকরণ করে সালাউদ্দীনের কর।
৩. রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধি : সামন্ত প্রথার অবনতীর ফলে একদিকে নতুন দায়িত্ব পালনও অন্যদিকে, ক্রুসেডের ফলে ইউরোপের পর ফ্রান্স, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশের রাজারা নিজস্ব ক্ষমতা বৃদ্ধি করেন।
ভারা নিজেরাই প্রজাদের উপর প্রত্যক্ষভাবে করা আরোপ করে। এর ফলে ধীরে ধীরে শক্তিশালী রাজতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে।
৪. জাতিগত ঐক্য : ক্রুসেডের ফলে বিভিন্ন দেশে জাতিগত ঐক্য দেখা দেয়। এসময় বিভিন্ন অঞ্চলের লোক একত্রিত হওয়ায় তারা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য্য বুঝতে পারে। ফলে ইউরোপে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটে।
৫. ভূমিদাসদের মুক্তি ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান : সামন্তপ্রথার ভাঙনের ফলে ভূমিদাসদের অবস্থার উন্নতি হয়। এ সময় সামন্তপ্রভুদের ভূমি মালিকানা স্বত্ব বিক্রি এবং ক্রুসেডে যোগদানের জন্য অসংখ্য ভূমিদাস মুক্তি পায়। পরবর্তীতে এই মুক্ত ভূমিদাসদের থেকেই মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটে ।
৬. নারীর মর্যাদা বৃদ্ধি : ক্রুসেডে গমনকালে অনেক প্রভু স্বীয় স্ত্রীর কাছে ভূ-সম্পত্তির তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব অর্পণ করেন। ফলে একদিকে নতুন দায়িত্ব পালনও অন্যদিকে ক্রুসেডের ফলে সৃষ্ট প্রাচ্যের ভাবধারার প্রভাবে নারীর মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
৭. নতুন ধরনের যুদ্ধাস্ত্রের ব্যবহার : ক্রুসেডের ফলে ইউরোপীয় তা নতুন যুদ্ধাস্ত্রের ব্যবহার রপ্ত করে। যুদ্ধে তাঁর, ধনুক, পুরুষ ঘোড়ার ব্যবহার, প্যাড, জিন ও রেকাপের ব্যবহার | মূলত মুসলমানদের নিকট থেকেই তারা শিখে।
৮. পোপের ক্ষমতা হ্রাস : ক্রুসেডসমূহের উপর্যুপরি ব্যর্থতার ফলে খ্রিস্টান জগতে পোপের প্রতি জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস বহুল পরিমাণ হ্রাস পেতে থাকে।
ক্রুসেডের ফলে পোপ ও খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের ক্ষমতা সম্পর্কে মানুষের চিন্তাধারা পরিষ্কার হয় এবং সমাজে পোপ ও যাজকদের ক্ষমতা বহুলাংশে খর্ব হয়ে যায়।
৯. ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে মুসলমানদের প্রভাব হ্রাস : ক্রুসেডের পর থেকে ইউরোপীয় বণিকরা ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করতে থাকে। এর ফলে এখানকার বাণিজ্যে মুসলমানদের একাধিপত্য ক্ষুণ্ণ হয়।
১০. ইউরোপীয় জীবনধারায় পরিবর্তন : প্রাচ্যের মুসলমানদের সংস্পর্শে এসে ইউরোপের জীবনধারায় অনেক পরিবর্তন সূচিত হয়। তখনও পাশ্চাত্যের জীবন ছিল উগ্র ও অশিষ্ট।
ক্রুসেডের ফলে তারা মুসলমানদের উন্নত ধরনের রুচিসম্পন্ন সভ্যতার সংস্পর্শে আসে। তারা নব নব নির্মাণ কৌশল, পোশাক-পরিচ্ছদ ও আচার ব্যবহার সম্বন্ধেও জ্ঞান লাভ করে।
১১. শহরের পত্তন : গ্রাম্য সমাজের অনেক লোক গ্রাম ছেড়ে নতুন কর্মের সন্ধানে অগ্রসর হতে থাকে এবং অনেকে কৃষিকাজ ছেড়ে ব্যবসা বাণিজ্য শুরু করে। এভাবে ব্যবসা বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন শহরের পত্তন ঘটে।
১২. নতুন সভ্যতার বিকাশ : প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য তথা ইউরোপীয় ও মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির মধ্যে সংঘাত ও সমন্বয়ের মধ্য দিয়েই আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতার বিকাশ ঘটে।
ক্রুসেডের ফলেই আধুনিক ইউরোপ জন্মলাভ করে। এসময় মুসলমানদের | শিক্ষা-সংস্কৃতি জ্ঞানবিজ্ঞান ইউরোপে বিস্তার লাভ করে।
আরবিতে লেজা জ্যোতির্বিদ্যা, অংক শাস্ত্র, চিকিৎসাশাস্ত্র, ইতিহাস প্রভৃতি ইউরোপীয়রা ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করে। ১১৪১ খ্রিস্টাব্দে পবিত্র কোরআনও তারা ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করে।
এছাড়া উদ্ভিদবিদ্যা ও কৃষি সম্বন্ধেও ইউরোপীয়রা আরবদের কাছ থেকে অনেক কিছু লাভ করে। বস্তুত ইউরোপের নজাগরণের এবং বিশ্ব সভ্যতার অগ্রগতিতে ক্রুসেডের প্রভাব ছিল অপরিসীম ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ক্রসেডে মুসলিম প্রাচ্যের বিরুদ্ধে ইউরোপের তীব্র প্রতিক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ। এ যুদ্ধ সংঘটিত হবার পেছনে ধর্মীয় উদ্দীপনা বিশেষভাবে ভূমিকা রাখে।
প্রায় দুশ বছর স্থায়ী এ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ইতিহাসের এ উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ক্রসেড মানুষকে নতুন দেশ ও মানুষের আচরণে সম্পর্কে জানার আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়।
পরবর্তীকালে আধুনিক বিশ্বের সূচনাকারী যে ভৌগোলিক আবিষ্কার সংঘটিত হয়েছিল তার আরম্ভ হয়েছিল ক্রুসেড থেকেই মুসলমানদের উচ্ছেদ করার জন্য এ ক্রুসেড পরিচালিত হলেও অবশেষে মুসলমানরা ক্রুসেডে বিজয় লাভ করে।