সিয়াসতনামার আলোকে নিজামুল মুলকের রাষ্ট্র দর্শন সম্পর্কে আলোচনা কর

সিয়াসতনামার আলোকে নিজামুল মুলকের রাষ্ট্র দর্শন সম্পর্কে আলোচনা কর
সিয়াসতনামার আলোকে নিজামুল মুলকের রাষ্ট্র দর্শন সম্পর্কে আলোচনা কর

সিয়াসতনামার আলোকে নিজামুল মুলকের রাষ্ট্র দর্শন সম্পর্কে আলোচনা কর

  • অথবা, সিয়াসতনামার প্রেক্ষাপটে নিজামুল মুলকের রাষ্ট্র দর্শন লিখ ।

উত্তর : ভূমিকা : নিজামুল মুলক ছিলেন মালিক শাহের প্রধানমন্ত্রী। তিনি হাদিস ও ফিকহ শাস্ত্রে অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। ইয়াহিয়া বার্মাকির পর নিজামুল মুলকই ছিলেন এশিয়ার একমাত্র যোগ্যতম প্রধানমন্ত্রী। 

মধ্যযুগে আরব অঞ্চলে যে সব রাষ্ট্রচিন্তাবিদ ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন নিজামুল মুলক। নিজামুল মূলক রচিত সিয়াসতনামাকে রাষ্ট্রদর্শনের বাইবেল বলা হয়।

→ নিজামুল মূলকের পরিচয় : আবু আলী আল হাসান আল তুমি নিজামুল মুলক। ১০১৮ খ্রিস্টাব্দের ইরানের তুস নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। 

তার পিতামহ ইসহাক ছিলেন রায়হাকের সীমান্তবর্তী এক গ্রাম্য কৃষক এবং পিতা ছিলেন পজনবী রাজ্যের একজন কর আদায়কারী। তিনি তুম্রিল বেগের খতিব ছিলেন। 

এর পরে আলপ আরসালানের সময়ে প্রথম উজির নিযুক্ত হন এবং মশহুর নিজামুল “মুলক উপাধি গ্রহণ করেন। মালিক শাহের সময় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১০৯২ খ্রিস্টাব্দে ইরানে মারা যান।

→ নিজামুল মুলকের সিয়াসাতনামা : নিজামুল মুলক একজন বিশিষ্ট পণ্ডিত ও প্রতিভাবান রাজনীতিবিদ ছিলেন। মালিক শাহের অনুরোধক্রমে তিনি 'সিয়াসতনামা' গ্রন্থটি রচনা করেন। “সিয়াসতনামা' বিখ্যাত গ্রন্থটি ফারসি ভাষায় লেখা হয়। শাসনব্যবস্থার জন্য এ গ্রন্থটি উৎকৃষ্ট মানের ।

ঐতিহাসিক আরনল্ড বলেন, “রাজনৈতিক নীতিমালা সংবলিত এ গ্রন্থে শুধু দার্শনিক নিবন্ধই ছিল না বরং এতে শাসন প্রণালি, দরবার, বিচার কার্য, সামরিক পদ্ধতি এবং অর্থনৈতিক কার্যাবলির উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ প্রভৃতি বিষয়ে ব্যবহারিক উপদেশ প্রদান করে। এতে তিনি রাজতন্ত্রের ব্যাখ্যাও দেন।

→ সিয়াসাতনামার আলোকে নিজামুল মূলকের রাষ্ট্রদর্শন : সিয়াসতনামার আলোকে নিজামুল মুলকের রাষ্ট্র দর্শন নিম্নে আলোচনা করা হলো -

১. খলিফা নির্বাচন : বিখ্যাত গ্রন্থ সিয়াসতনামা গ্রন্থে নিজামুল মুলক উল্লেখ করেছেন শাসন ব্যবস্থায় অধিষ্ঠিত থাকা খলিফা তার ভাই এবং সন্তানকে খলিফা মনোনীত করতে পারবে। 

যদি ভাই অথবা সন্তান না থাকে তাহলে শাসন ব্যবস্থায় সাহায্যকারী | বিভিন্নপদের ব্যক্তিকে খলিফা নির্বাচন করা যেতে পারে।

২. শপথ গ্রহণ : খিলাফতের সাথে বায়াত বা শপথ গ্রহণ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। নিজামুল মুলক তার সিয়াসতনামা গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, খলিফা হওয়ার সাথে সাথে তাকে বাইয়াত অথবা রাষ্ট্র পরিচালনা করার জন্য শপথ গ্রহণ করা প্রধান কাজ।

৩. সেক্রেটারিয়েট গঠন : রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য অবশ্যই প্রয়োজন হলো সেক্রেটারিয়েট বা মজলিসে শুরা আর মন পুরা ব্যবস্থা প্রবর্তন হয়েছিল দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রাঃ)-এর সময়। মজলিসে শুরা খলিফাকে রাষ্ট্রপরিচালনায় সহযোগিতা করবে।

৪. সার্বভৌমত্ব : নিজামুল মূলকের মতে, খলিফার সার্বভৌম ক্ষমতা হলো কুরআন, হাদিস, ইজমা, কিয়াস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ইসলামি রাষ্ট্রে কুরআন, হাদিস, ইজমা ও কিয়াস দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে যার কারণে খলিফা কোন আইন প্রণয়ন করতে পারবেন না। রাজধানীর প্রধান মসজিদে খলিফা ইমামতি করবেন এটা নিজামুল মূলকের অভিমত।

৫. রাজতন্ত্রের ব্যাখ্যা প্রদান : নিজামুল মুলক তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ সিয়াসতনামায় রাজতন্ত্রের ব্যাখ্যা প্রদান করেন। এ গ্রন্থে শাসন প্রণালি, বিচারকার্য, সামরিক পদ্ধতি এবং অর্থনৈতিক কার্যাবলির উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছেন। রাজতন্ত্রকে কিভাবে পরিচালিত করতে হবে সে বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছে।

৬. গোয়েন্দা বিভাগ : রাষ্ট্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী যেন অবৈধ পথে অর্থ উপার্জন না করে এবং অসৎ উপায় অবলম্ন না করে সে দিকে লক্ষ রাখা এবং সম্রাজ্যের সুশৃঙ্খল ব্যবস্থার জন্য গোয়েন্দা বিভাগ অতীব জরুরি।

৭. জায়গির প্রথা : সিয়াসতনামায় নিজামুল মুলক জায়গিরগণের নির্দিষ্ট পরিমাণ মাল আদায়ের ক্ষমতা রেখেছেন এবং তাদের দখলি মেয়াদও সংক্ষিপ্ত করে দিয়েছেন। 

নিজামুল মুলক জায়গির প্রথার পক্ষপাতী ছিলেন যার আয় দিয়ে ঐসব এলাকায়ও সেনাবাহিনীর ব্যয়ভার গ্রহণ করা যাবে।

৮. ইসলামি আইনের প্রয়োগ : সিয়াসডনা গ্রন্থে উল্লেখিত অন্যতম একটি বিষয় হলো খলিফাকে সবর্দা ইসলামি শাসন বিধির মাধ্যমে শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করতে হবে। হজ্জের বিধান এ তথ্য কাফেলায় খলিফার নেতৃত্ব একান্ত কাম্য।

৯. মালিশ উশ শুরা : নিজামুল মূলকের মতে, প্রশাসনিক ব্যাপারে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ করার জন্য খলিফা কর্তৃক মজলিশ উশ শুরা গঠন করা অপরিহার্য। 

তবে খলিফার শুরার পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে এমনটা নয়। তিনি ইচ্ছ করলে ও শুরার পরামর্শ উপেক্ষা করতে পারবেন।

১০. খলিফার যোগ্যতা : খলিফা নির্বাচন পূর্বে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো অবশ্যই থাকতে হবে-

(i) শরিয়তে জ্ঞান এ পণ্ডিত হতে হবে। যার দ্বারা হালাল হারাম বুঝতে পারা যায়।

(ii) জ্ঞান বুদ্ধি অবশ্যই থাকতে হবে। ইহকালীন এবং পরকালীন উভয় জ্ঞানে জ্ঞানী হতে হবে।

(iii) শারীরিকভাবে বিকলাঙ্গ না হওয়া কেননা বিকলাঙ্গ ব্যক্তি শাসনব্যবস্থা পরিচালনার সময় ব্যাপক সমস্যার সম্মুখীন হয়।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মুসলিম শাসনামলের যুগে যে কয়জন উজির শ্রেষ্ঠ ছিলেন, তাদের মধ্যে নিজামুল মুলক অন্যতম। ইতিহাসে নিজামুল মুলকের অবদান ছিল অপরিসীম। 

এ বিখ্যাত উজির সেলজুক সুলতান মালিক শাহের শাসনামলে দায়িত্বে ছিলেন। তার রাষ্ট্রদর্শন ছিল জগৎবিখ্যাত। 

তিনি অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেন, তার মধ্যে নিজামীয়া বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম। তাঁর লেখা “সিয়াসতনামা" হাটির রাষ্ট্রদর্শন প্রতিটি ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ