তাম্রশাসন বা লিপিমালা সমূহের বর্ণনা দাও

তাম্রশাসন বা লিপিমালা সমূহের বর্ণনা দাও
তাম্রশাসন বা লিপিমালা সমূহের বর্ণনা দাও


তাম্রশাসন বা লিপিমালা সমূহের বর্ণনা দাও

  • অথবা, প্রাচীন বাংলার উৎস হিসেবে তাম্রশাসনের বর্ণনা দাও।

উত্তর : ভূমিকা : প্রাচীন বাংলার ইতিহাস রচনার উৎসসমূহ দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- লিখিত উৎস ও অলিখিত উৎস লিখিত উৎসের মধ্যে সাহিত্য, জীবনী, নথিপত্র উল্লেখযোগ্য। 

আর অলিখিত উৎসের মধ্যে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, মুদ্রা, মূর্তি, লিপিমালা, ভাস্কর্য, ইমারত ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। 

লিখিত উপাদানগুলো বিশেষ করে মহাফেজখানায় সংরক্ষিত থাকে আর অলিখিত উপাদানগুলো জাদুঘরে সংরক্ষিত থাকে। 

আর এসব অলিখিত উৎসগুলোর মধ্যে তাম্রশাসন বা লিপিমালা অন্যতম একটি উপাদান। প্রাচীনকালের অনেক রাজার রেখে যাওয়া তাম্রশাসন থেকে তৎকালীন সময়ের অনেক তথ্য -আবিষ্কার করা আমাদের কাছে খুব সহজ হয়।

তাম্রশাসন বা লিপিমালাসমূহ : প্রাচীন বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠনে তাম্রশাসন বা শিলালেখ। লিপিমালা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সোনা, রূপা, লোহা, তামা, ব্রোঞ্জ, মাটির জিনিস, ইট, পাথর প্রভৃতি তাম্রশাসনের বাহন বলে মনে করা হয়। আর এগুলোর মধ্যে তামার ভূমিকা মুখ্য। 

বিভিন্ন তাম্রশাসনসমূহ হলো :

১. খালিমপুরের তাম্রশাসন : প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে পাল রাজবংশ বা পাল সাম্রাজ্য ছিল অন্যতম। আর এ পালবংশের ইতিহাস রচনায় খালিমপুরের তাম্রশাসন ছিল অন্যতম। 

খালিমপুরের তাম্রশাসনে গোপালের পিতার নাম বাপট বলে উল্লেখ আছে। এছাড়াও খালিমপুরের তাম্রশাসন থেকে পাল সম্রাট ধর্মপাল সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়।

২. গুপ্ত রাজাদের তাম্রশাসন : গুপ্ত রাজবংশ সম্পর্কে জানার অন্যতম উৎস হলো গুপ্ত রাজাদের সময়ের তাম্রশাসন বা লিপিমালাসমূহ। 

গুপ্ত রাজাদের তাম্রশাসন থেকে জানা যায় যে, গুপ্ত রাজাদের উত্তরবঙ্গে প্রাদেশিক রাজধানী ছিল 'পুত্রনগর'। এছাড়াও গুপ্ত তাম্রশাসন থেকে গুপ্ত রাজাদের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কেও অনেক ধারণা লাভ করা যায়।

৩. গুদের তাম্রশাসন : পাল সাম্রাজ্যের ইতিহাস জানার অন্যতম আরো একটি লিপিমালা হলো- দেবপালের অঙ্গের তাম্রশাসন। অঙ্গের তাম্রশাসন থেকে দেবপালের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে বেশ কিছু জানা যায়। 

এছাড়া দেবপালের অঙ্গের তাম্রশাসন থেকে জানা যায় যে, রাজা গোপাল বাংলায় অরাজকতার রাজনীতির অবসান ঘটিয়ে পাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।

8. বানগড় ও কমৌলির তাম্রলিপি : পালরাজাদের তাম্রশাসনসমূহের মধ্যে ধানগড় ও কমৌলির তাম্রশাসন অন্যতম। বানগড় ও কমৌলির তাম্রলিপি থেকে পাল সাম্রাজ্য ও পাল রাগানের সম্পর্কে জানা যায়। বানগড় ও কমৌলি লিপিমালায় উল্লেখ আছে যে, পাল রাজাদের আদি বাসস্থান ছিল উত্তর বাংলায়।

৫. আশ্রাফপুরের তাম্রশাসন : ঢাকা জেলার আশ্রাফপুরের দু'টি তাম্রশাসন ছিল সমসাময়িককালের উল্লেখযোগ্য উৎস। আশ্রাফপুর তাম্রশাসন থেকে খড়গ বংশের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়। 

উক্ত তাম্রশাসন থেকে জানা যায় যে, সপ্তম শতাব্দীর প্রথমদিকে বাংলার দক্ষিণ-পূর্বে খড়্গপ রাজবংশের উদ্ভব হয়।

৬. ময়নামতির তাম্রশাসন : কুমিল্লার ময়নামতিতে প্রাপ্ত তিনিটি তাম্রশাসন ছিল প্রাচীন বাংলার ইতিহাস রচনার উৎসগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি উৎস। বাংলায় দেবরাজ বংশের শাসনামল সম্পর্কে জানতে হলে উক্ত লিপিমালার উপর নির্ভর করতে হয়। 

ময়নামতির প্রাপ্ত তাম্রশাসন থেকে জানা যায় যে, অষ্টম শতাব্দীর শুরুর দিকে বাংলার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে দেব রাজবংশের উদ্ভব ঘটে। ময়নামতিতে প্রাপ্ত এ তাম্রশাসনের মাধ্যমে নেব রাজবংশের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কেও জানা যায়।

৭. বেলার গ্রামের তাম্রশাসন : ঢাকা জেলার বেলার গ্রামে প্রাপ্ত তাম্রশাসন থেকে সমসাময়িককালের বর্মরাজবংশের ইতিহাস সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়। 

উক্ত তাম্রশাসন থেকে বর্ম রাজাদের শাসনকাল ও তাদের নাম পাওয়া যায়। ভোজবর্মা, সামল বর্মা ও হরিবর্মা ছিল বর্ম রাজবংশের শ্রেষ্ঠ শাসন।

৮. ব্যারাকপুরের তাম্রশাসন : সেনরাজবংশের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হলে বিজয় সেনের ব্যারাকপুরের তাম্রশাসন এর উপর নির্ভর করতে হয়। 

পাল রাজাদের শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে সেনরা বাংলায় শাসনব্যবস্থা কায়েম করে। এছাড়া নৈহাটি ও ভাগলপুর তাম্রশাসন থেকেও সেন রাজত্বকালের পরিচয় পাওয়া যায়।

৯. লক্ষ্মণ সেনের ভাম্রশাসন : বাংলার সেন রাজবংশের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায় লক্ষ্মণ সেনের ৮টি তাম্রশান থেকে। 

সেন বংশের সর্বশেষ শাসক লক্ষ্মণ সেনের বিভিন্ন রাজ্য জয়ের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায় তাঁর এ ৮টি তাম্রশাসন থেকে। উক্ত তাম্রশাসনে সেন রাজত্বকালের পরিচয় পাওয়া যায়।

১০. ড. আব্দুল মমিনের মতামত : তাম্রশাসন সম্পর্কে ড. আব্দুল মমিন চৌধুরী একটি বিশেষ মতপ্রকাশ করেছেন। তিনি ধর্মপাল সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করেন যে, “খালিমপুরের লিপিতে ধর্মপালের উপরে সামন্ত রাজাদের সম্পর্কে অতিশয়েক্তি আছে”।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, প্রাচীন বাংলার ইতিহাস রচনায় তাম্রশাসন বা লিপিমালা বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে । 

দানপত্র, আদেশপত্র, রাজত্বকাল, অভিষেক, বিজয় কাহিনী ও রাজাদের নিষেধসমূহ তাম্রপাতে শ্লোক আকারে লিপিবদ্ধ থাকত। 

আর এগুলোই হলো তাম্রশাসন বা শিলালেখ লিপিমালা। প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে এ তাম্রশাসনের গুরুত্ব অপরিসীম । 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ