বিজেতা হিসেবে আলাউদ্দিন হুসেন শাহের কৃতিত্ব আলোচনা কর

বিজেতা হিসেবে আলাউদ্দিন হুসেন শাহের কৃতিত্ব আলোচনা কর
বিজেতা হিসেবে আলাউদ্দিন হুসেন শাহের কৃতিত্ব আলোচনা কর

বিজেতা হিসেবে আলাউদ্দিন হুসেন শাহের কৃতিত্ব আলোচনা কর

  • অথবা, সামরিক বিজেতা হিসেবে আলাউদ্দিন হুসেন শাহের কৃতিত্ব বিচার কর।

উত্তর : ভূমিকা : হুসেন শাহ সামরিক বিজেতা হিসেবে তার অমরকীর্তি স্থাপন করেছেন। ব্লকম্যান তার সামরিক কীৰ্ত্তি সম্পর্কে লিখেছেন- 'The Name of Husain Shah, the good, is remembered from the frontiers of orissa to the Brahmaputra” (হুসেন শাহের সুনাম উড়িষ্যার সীমান্ত থেকে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত এবং ছড়িয়ে রয়েছে ।) 

আলাউদ্দিন হুসেন শাস্ত্রের রাজ্যের আয়তন ছিল অত্যন্ত বিরাট, পূর্ববর্তী সুলতানদের রাজ্যের তুলনায় অনেক বেশি। এই কারণে তার খ্যাতির প্রসার ক্ষেত্র স্বভাবতই বিস্তীর্ণ হয়েছে। 

আলাউদ্দিন হুসেন শাহের যত ঐতিহাসিক | স্মৃতিচিহ্ন আছে, এত বাংলার আর কোন সুলতানের নেই। এ পর্যন্ত তাঁর অজস্র শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়েছে এখনও হচ্ছে।

হুসেন শাহের সামরিক কৃতিত্ব : আলাউদ্দিন হুসেন শাহ অনেকগুলো রাজ্যের সাথে যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হয়েছিলেন। তিনি এ সকল যুদ্ধে সফলতাও লাভ করেছিলেন। 

নিম্নে হুসেন শাহের সামরিক কীৰ্ত্তি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-

১. দক্ষ সেনাবাহিনী গঠন : হুসেন শাহ ক্ষমতায় আসেন একটি সামরিক ক্যুর মাধ্যমে। মুজাফফর শাহের শাসনামলে সেনাবাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। 

এ সেনাবাহিনী বিশৃঙ্খল হবার কারণে হুসেন শাহ ক্ষমতায় এসে সেনাবাহিনীর বিশৃঙ্খল অংশকে সেনাবাহিনী থেকে বাদ দেন। 

তিনি নতুনভাবে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন করেছিলেন। এ সেনাবাহিনী বেশ দক্ষ ছিল তা তাদের অভিযান থেকে বোঝা যায়। 

দক্ষ সেনাবাহিনী গড়ে তোলার ফলে হুসেন শাহ অল্প সময়ের মধ্যে বিভিন্ন রাজ্য আক্রমণ করে জয়লাভ করেছিলেন।

২. সামরিক লক্ষ্য নির্ধারণ : হুসেন শাহ তার রাজত্বের প্রথম বছর হতে মুদ্রায় নিজেকে 'কামরূপ-কামতা-জাজনগর-উড়িষ্যা- বিজয়ী' বলে ঘোষণা করেন। 

এ ঘোষণাকে অনেকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখেন। কেননা রাজত্বের প্রথম বছরেই এতগুলো রাজ্য বিজয় করা অসম্ভব বলে মনে হয়। 

কিন্তু হুসেন শাহ এসকল রাজ্য আক্রমণ করেছিলেন সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। তাই হুসেন শাহ তার রাজত্বের প্রথম বছরে তার সামরিক লক্ষ্য নির্ধারণ করে মুদ্রায় এ ঘোষণা দেন বলে মনে হয়।

৩. কামতাপুর-কামরূপ রাজ্য জয় : ১৪৯৩-৯৪ খ্রিষ্টাব্দ হুসেন শাহ কামতাপুর-কামরূপ রাজ্য আক্রমণ করেন। এ রাজ্য উত্তর বঙ্গে অবস্থিত ছিল। 

এই অভিযানের কথা নানা সূত্রে লেখা আছে। হুসেন শাহ এই অভিযানে সাফল্য লাভ করেন, এ সম্বন্ধে সব সূত্রই একমত। 

কামতাপুর রাজা আধুনিক কুচবিহার অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। হুসেন শাহের সময়ে এই রাজ্যের রাজা খুব প্রতিপত্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন। 

উত্তরবঙ্গের এক বিরাট অঞ্চল ও আসামের কামরূপ অঞ্চলের তিনি একচ্ছত্র অধিপতি ছিলেন। হুসেন শাহ তাকে যুদ্ধে পরাজিত করে তার রাজ্য নিজের অধিকারে আনেন।

৪. আসাম অভিযান : কামরূপের পূর্ব ও দক্ষিণে প্রাচীন আসাম বা অহোম রাজ্য অবস্থিত ছিল। এই রাজ্য নিতান্ত দুর্ভেদ্য ছিল। এখানকার লোকেরা বাইরের কোনো লোককে তাদের দেশে জা করতে দিত না। 

রাজ্যটি দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে পরিপূর্ণ হওয়ায় জন্য এবং এখানে বর্ষার প্রকোপ বেশি হওয়ায় এখানকার রাজাদের পক্ষে দেশ রক্ষায় খুব বেশি বেগ পেতে হতো না। 

হুসেন শাহ এই রাজ্য আক্রমণ করে এর সমতল অঞ্চলগুলো নিজের দখলে নিয়ে আসেন। রাজা দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। 

কিন্তু সমাগত হলে তারা পুনরায় আক্রমণ রচনা করে। তারা হুসেন শাহের সৈন্যদেরকে চারিদিক দিয়ে ঘিরে ফেলে। 

এতে করে তাদের রসন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে প্রথম দিকে জয়লাভ করলেও শেষ পর্যন্ত তাদের শোচনীয় পরাজয় ঘটে।

৫. উড়িষ্যার সাথে যুদ্ধ : হুসেন শাহ উড়িষ্যাও আক্রমণ করেছিলেন। রিয়াজ-উস-সালাতীনে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে- “আশপাশের সমস্ত রাজাকে বশীভূত করে এবং উড়িষ্যা পর্যন্ত জয় করে তিনি কর আদায় করেছিলেন।” 

১৪৯৩-৯৪ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয়ে উড়িষ্যার যুদ্ধ অন্তত ১৫১৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত চলেছিল। মাঝে কিছু কিছু সময় বিরতি দিয়ে এ যুদ্ধ চলেছিল। 

এই যুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ে কোন কোন সময় উভয় রাজা অন্য রাজ্যের অঞ্চল বিশেষ অধিকার করেন, কিন্তু কারও অধিকার স্থায়ী হয়নি। 

উভয় রাজাই এই যুদ্ধে জয়ের দাবী করেন, কিন্তু মোটের উপর এই যুদ্ধ অমীমাংসিত থেকে গিয়েছিল বলে মনে হয়। ১৫১৫ খ্রিষ্টাব্দেই এ যুদ্ধের অবসান হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।

৬. ত্রিপুরার সাথে যুদ্ধ : হুসেন শাহের সঙ্গে ত্রিপুরা রাজা | ধন্যমানিক্যের সংঘর্ষ হয়েছিল। ত্রিপুরার রাজাদের ইতিবৃত্ত 'রাজমালাতে' বলা হয়েছে- "ধনমানিক্যই প্রথম গৌড় রাজ্য আক্রমণ করেন এবং সাফল্য লাভ করেন।” 

প্রথম পর্যায়ের সূচনা হয় ত্রিপুরা রাজা ধন্যমানিক্যের বাংলা অভিযানের মধ্য দিয়ে ধন্যমানিক্য বাংলার সুলতানের অধীন গঙ্গামঙ্গল, পার্টীককারা, মেহেরজুন, ধৈনাসহর, ভানুগাছ, লাঙ্গনা প্রভৃতি অঞ্চল জায় করেন এবং বরদা খাতের জমিদার প্রতাপ রায় বাংলার সুলতানের পক্ষ ছেড়ে ত্রিপুরা রাজ্যের পক্ষে যোগ দেন। 

ধন্যমানিকা খণ্ডন পর্যন্ত জয় করেন এবং অধিকৃত অঞ্চলে একজন শাসনকর্তা নিয়োগ করে চলে যান। কিন্তু খণ্ডনের থেকে ঐ শাসনকর্তাকে বন্দি করে গৌড়ে প্রেরণ করেন। 

গৌড়েশ্বর তাকে হাতির পায়ের তলায় ফেলে বধ করার আদেশ দেন। তবে ত্রিপুরা রাজা আবারো এ অঞ্চল দখল করে নেন। 

এরপর ত্রিপুরা রাজা চট্টগ্রাম অধিকার করেছিলেন। তবে হুসেন শাহের সেনাবাহিনী তা আবার পুনরুদ্ধার করে। এভাবেই এ যুদ্ধ অনেকদিন চলে। 

তবে শেষ পর্যন্ত হুসেন শাহ ত্রিপুরা রাজ্যের কিছু অংশ দখল করেছিল কিন্তু হুসেন শাহের রাজত্ব শেষ হবার পরেও এ যুদ্ধ চলছিল।

৭. নিহত ও বিহারে হুসেন শাহের অভিযান : কামতাপুর- কামরূপ অভিযানের সময়েই হুসেন শাহ ত্রিহুতের কতকাংশ দখল করেছিলেন। কিন্তু কিভাবে তিনি এ অঞ্চল দখল করেন তা বর্তমানে বলবার অবকাশ নেই। 

হুসেন শাহ বিহারের অধিকাংশই নিজের রাজ্যভুক্ত করেন। এসব অঞ্চলের কিছু কিছু অঞ্চল আগে দিল্লির শাসক সিকান্দর লোদীর ছিল। 

হুসেন শাহ যে বছর সিকান্দর লোদীর সাথে সন্ধি করেন সে বছরই বিহারের এসব অঞ্চল দখল করে বলে জানা যায়।

৮. চট্টগ্রাম বিজয় : হুসেন শাহ চট্টগ্রাম অঞ্চলে নিজের বিজয় পতাকা উত্তোলন করতে সক্ষম হন। তিনি চট্টগ্রামের অধিকার নিয়ে আরাকান ও ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। 

ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে অনেকদিন যাবত যুদ্ধ চলছিল। তবে তিনি ত্রিপুরার রাজাকে চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হন। 

আরাকান রাজা হুসেন শাহের অধীনতা স্বীকার করেছিল বলে জানা যায়। ফলে হুসেন শাহ চট্টগ্রামের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করতে সক্ষম হন।

৯. সিকান্দর লোদীর সাথে সন্ধি স্থাপন : জৈনপুরের সুলতান হুসেন শাহ শাকীকে কেন্দ্র করে হুসেন শাহ সিকন্দর লোদীর সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। 

সিকান্দর লোদীর কাছে পরাজিত হুসেন শাহ শাকীকে বাংলায় আশ্রয় দেয়ার কারণে সিকান্দর লোদী বাংলার শাসক হুসেন শাহের উপর ক্ষিপ্ত হন।

 তিনি বাংলা আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। হুসেন শাহও সিকান্দর লোদীর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। 

দু'দল মুখোমুখি হলেও যুদ্ধ হয়নি। তাদের মধ্যে একটি সমঝোতামূলক সন্ধি স্থাপিত হয়েছিল। ফলে দিল্লির শাসকদের হাত থেকে বাংলা রক্ষা পায়।

১০. মূল্যায়ন : হুসেন শাহ একজন সমরবিজয়ী শাসক ছিলেন। এ কারণে তার খ্যাতি উড়িষ্যা থেকে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত আজও ছড়িয়ে রয়েছে। 

তার বীরত্বের স্বীকৃতি মেলে সেসময়ে রচিত সাহিত্য পর্যবেক্ষণ করলে। তার কৃতিত্বের জন্য তাকে 'নৃপতি তিলক' 'কৃষ্ণাবতার' ‘জগৎভূষণ' প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে ।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, হোসেন শাহ তার শাসনকালে স্বল্প সময়ের মধ্যে যে সামরিক নৈপুণ্য দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন তা বাংলার ইতিহাসে বিরল। 

তার সামরিক দক্ষতা তাকে বাংলার ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। তিনি অল্প সময়ের মধ্যে বাংলার সুনাম বৃদ্ধি করে বাংলার কথা সমগ্র ভারতবর্ষে ছড়িয়ে দেন। 

ফলে তাকে 'The Superior king' বলে অভিহিত করা যেতে পারে। তার সামরিক কীর্তির ফলে বাংলাসহ ভারতবর্ষে এখনও তার নাম সগৌরবে উচ্চারিত হয়ে থাকে। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ