বল্লাল সেনের চরিত্র ও কৃতিত্ব আলোচনা কর

বল্লাল সেনের চরিত্র ও কৃতিত্ব আলোচনা কর
বল্লাল সেনের চরিত্র ও কৃতিত্ব আলোচনা কর

বল্লাল সেনের চরিত্র ও কৃতিত্ব আলোচনা কর

  • অথবা, বল্লাল সেনের কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর। 
  • অথবা, বল্লাল সেনের চরিত্র ও কৃতিত্ব বিচার কর। 
  • অথবা, বল্লাল সেনের চরিত্র ও কৃতিত্বের উপর একটি নিবন্ধন রচনা কর।

উত্তর : ভূমিকা : সেন রাজবংশের শাসকদের মধ্যে বল্লাল সেন ছিলেন এক প্রতাপশালী শাসক। তিনি তার পিতা বিজয় সেনের মৃত্যুর পর আনুমানিক ১১৫৮ খ্রিষ্টাব্দে পিতৃসিংহাসনে আরোহণ করেন। 

তার অসামান্য দক্ষতা সেন সাম্রাজ্যকে নতুন রূপে জাগ্রত করেছিল। তিনি পিতৃরাজ্য রক্ষাসহ নতুন করে সেন রাজ্য বিস্তার করেন। এ কারণে তাঁর শাসনামল ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে।বল্লাল সেনের চরিত্র। 

বল্লাল সেনের চরিত্র সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :

১. সমাজ সংস্কারক : বল্লাল সেন তাঁর পিতার মতোই সমাজ সংস্কারক ছিলেন। তিনি তার সেন রাজ্যে বহু স্থানে বল্লাল সেনের কীর্তি আজও বর্তমান। দিনাজপুরের পাথর ঘাটায় 'বল্লাল দীঘি' তার পরিচয় বহন করে।

২. ন্যায়বিচারক : বল্লাল সেন ছিলেন ন্যায় বিচারক। তিনি বিচারের ক্ষেত্র কোনো পক্ষপাতিত্ব করতেন না। এ জন্য প্রজারা তাকে খুব ভালোবাসত।

৩. প্রজাকল্যাণ কর : বল্লাল সেন ছিলেন প্রজাকল্যাণকামী শাসক। তিনি প্রজাদের কল্যাণের জন্য বহু স্থানে রাস্তাঘাট, সেতু, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন।

৪. সমরকুশলী : বল্লাল সেন পিতা বিজয় সেনের মতো দক্ষ সমরকুশালী ছিলেন। তিনি সিংহাসনে আরোহণ করে রাজ্য বিস্তারে মনোনিবেশ করে এর পরিচয় দেন।

৫. ধর্মের পৃষ্ঠপোষক : ক্যান সেন ছিলেন ধার্মিক। তার পিতা বিজয় সেনের মতোই সে ছিলেন শৈব মতাবলম্বী। তাই অন্যান্য উপাধির সাথে তিনি 'অবিরাজ নিঃশঙ্কর' উপাধি গ্রহণ করেছিলেন।

৬. সুপণ্ডিত : বল্লাল সেন তার একজন সুপণ্ডিত ছিলেন। তিনি দানসাগর ও অদ্ভুতসাগর নামক গ্রন্থসহ পাঁচটি গ্রন্থ রচনা করেন। এ থেকে তার পাণ্ডিত্যের পরিচয় পাওয়া যায়।

বল্লাল সেন প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম। তিনি সেন বংশকে উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করেন। 

তার কৃতিত্বের সেন সাম্রাজ্য দীর্ঘায়ু লাভ করেছিল। এ কারণে তাকে সেন বংশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শাসক বলে অভিহিত করা হয়েছে।

→ বক্সাল সেনের কৃতিত্ব : অসাধারণ কৃতিত্বের অধিকারী বিজেতা বল্লাল সেনের কৃতিত্ব নিয়ে আলোচনা করা হলো।

১. সেনাদক্ষ শাসক : বল্লাল সেন একজন দক্ষ শাসক ছিলেন। তার সামরিক দক্ষতার কারণে তিনি দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে পেরেছেন। 

তিনি এমন একজন শাসক ছিলেন যে তার সেনা দক্ষতা এমন পর্যায়ে ছিল যে, সে সময়কার বড় বড় সেনাপতিরা তার সামরিক দক্ষতার প্রশংসা করেছিল। এজন্য বলা হয় বল্লাল সেন ছিল একজন সেনাদক্ষ কৌশলী শাসক।

২. বিজেতা শাসক : পিতার ন্যায় বল্লাল সেন ছিলেন মহাবিজেতা। তিনি ছিলেন ক্ষমতা লোভী। ক্ষমতায় আসার পর তিনি পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলো জয় করে তার শাসনাধীনে নিয়ে আসেন। 

তিনি মিথিলা জয় করেন। মিথিলা জয় করার পর তিনি বরেন্দ্রভূমি, রায়, বঙ্গ, জয় করে রাজ্যর সীমা বৃদ্ধি করেন।

৩. জনকল্যাণকামী শাসন : দীর্ঘদিন বল্লাল সেন শাসন ক্ষমতায় ছিলেন। তাতে বোঝা যায় তিনি একজন যোগ্য শাসক এবং কৌশলী ছিলেন। তিনি চিন্তা করেন জনগণের কল্যাণ না করতে পারলে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ঠিকে থাকা সম্ভব হবে না। 

এজন্য তিনি জনকল্যাণের পথ বেছে নিয়েছিলেন। জনকল্যাণই তার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল। জনকল্যাণের জন্য তিনি ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নিয়েছিলেন।

৪. কূটকৌশলী : বল্লাল সেন একজন কূটকৌশলী শাসক ছিলেন। তিনি চিন্তা করেন ক্ষমতার চেয়ে মাঝে মাঝে কৌশল করে কাজ করলে সাফল্য পাওয়া যায়। এজন্য তিনি পশ্চিম চালুক্য বংশের রাজকুমারী রামদেবীকে বিয়ে করেন। 

রামদেবীকে বিয়ে করে তিনি ঐ সাম্রাজ্যের বস্তুতে পরিণত হলেন। চালুক্য সাম্রাজ্য যাতে এর বিরোধী না হয়, এজন্য তিনি এ কৌশলী কাজটি করেন।

৫. পার্শ্ববর্তী রাজ্যের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি : বল্লাল সেন কারো সাথে শত্রুতা নয়, সকলের সাথে বন্ধুত্ব- এ নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলো যেন তার প্রতি বৈরি হয়ে না উঠে, সেজন্য তিনি পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোর সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করেন। 

এমন কি তিনি নিজে বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে এ সুসম্পর্ক ঠিক রাখেন। তার সময় দেখা যায় দক্ষিণ ভারতের সাথে তার সুসম্পর্ক ছিল।

৬. কৌলিন্য প্রথার প্রবর্তক : বল্লাল সেন একজন সেনা দক্ষ চৌকস শাসক ছিলেন। তিনি একটা প্রথা প্রবর্তন করে সে সময় ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। 

তার প্রবর্তিত কৌলিন্য প্রথা সমাজে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। তিনি কৌলিন্য প্রথার মাধ্যমে বঙ্গের সামাজিক সংস্কার সাধন করেন।

৭. লেখা-লেখির অভ্যাস : বল্লাল সেন লেখা-লেখি করতেন, তার এই লেখা-লেখির দ্বারা তিনি জনগণের কাছে যেতে পেরেছেন। তিনি তার মনের কথা সর্বসাধারণের কাছে লেখনির মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারতেন। 

এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে তার লেখা বার্তা পৌঁছে যেত। তিনি 'সানসাগর' ও 'অদ্ভুত সাগর' নামক দুটি বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করে সে সময় ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন।

৮. দানবীর ব্যক্তি : বল্লাল সেন একজন দানবীর ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত ছিল এবং তিনি অকাতরে দান করতেন। কেউ তার কাছে সাহায্যের জন্য আসলে কাউকে তিনি খালি হাতে ফিরিয়ে দিতেন না এবং যে কেউ সমস্যায় পড়লে তার কাছে সাহায্য পেত। তিনি দান করতে পছন্দ করতেন; এজন্য দান সংক্রান্ত অনেক গ্রন্থ তিনি রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন।

৯. সনাতন ধর্ম পুনঃস্থাপন : পৃথিবীর পুরনো ধর্ম সনাতন ধর্ম। তিনি কোনো ধর্মের বিদ্বেষী ছিলেন না, সকল ধর্মকে তিনি ভালোবাসতেন। 

কোনো ধর্মের প্রতি তিনি বৈরি আচরণ করতেন না। তিনি সনাতন ধর্মের পুনঃস্থাপন করে ধর্মের জন্য কাজ করেন, এটা প্রমাণ পাওয়া যায়।

১০. সমাজ সংস্কারক : বল্লাল সেন সমাজ সংস্কারক হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং তিনি সমাজের কুসংস্কারগুলোর আমূল পরিবর্তন করে সমাজকে পুনর্গঠন করেন। 

সমাজের কুপ্রথা, অদ্ভুত প্রথা-এগুলো তিনি দূরীকরণে কাজ করেন। তিনি শুধু নিজেই সমাজ সংস্কার করেনি। এমন কি তিনি সমাজ সংস্কারকদের কাজ করার জন্য উৎসাহ প্রধান করতেন।

১১. মসজিদ, মন্দির ও গির্জা প্রতিষ্ঠা : তিনি শিক্ষা দীক্ষার জন্য ধর্মীয় স্থান লাভের জন্য মসজিদ, মন্দির ও গির্জা প্রতিষ্ঠা করেন। ধর্মীয় কাজ যাতে অবাদে সম্পূর্ণ হয়, সে জন্য তিনি সকল ধর্মীয় কাজকর্ম উন্মুক্ত করে দেন। তার সময় অনেক মসজিদ, মন্দির, গির্জা প্রতিষ্ঠা হয় ।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বল্লাল সেন অসাধারণ চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। তার সময়কার ইতিহাস সেন বংশের গৌরব চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। তিনি তার চরিত্র ও কৃতিত্বের বলে সমাজ থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত সকল পর্যায়ে তিনি খ্যাতি লাভ করেন ।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ