হুসেন শাহী যুগে শিল্প সাহিত্যের বিকাশ আলোচনা কর

হুসেন শাহী যুগে শিল্প সাহিত্যের বিকাশ আলোচনা কর
হুসেন শাহী যুগে শিল্প সাহিত্যের বিকাশ আলোচনা কর

হুসেন শাহী যুগে শিল্প সাহিত্যের বিকাশ আলোচনা কর

  • অথবা, বাংলা সাহিত্য বিকাশে হোসেনশাহী যুগের অবদান পর্যালোচনা কর।

উত্তর : ভূমিকা : বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং পরিপুষ্টতায় হুসেন শাহী বংশের (১৪৯৩-১৫৩৮ খ্রি.) সুলতানদের অবদান চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। 

হুসেন শাহী যুগের শাসকেরা রাজ্য শাসনের সাথে সাথে বাংলা শিল্প সাহিত্যের বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন। শিল্প সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করার ফলে এসময়ে বাংলা সাহিত্য চরম উৎকর্ষ লাভ করে ।

বাংলা সাহিত্যের অমর গ্রন্থসমূহ এসময়ে রচিত হয়েছিল। তাই হুসেন শাহী যুগ বাংলার ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি শাসনকাল ।

হসেন শাহী যুগে শিল্প সাহিত্য : সুলতানি আমলের শুরু থেকে বাংলা সাহিত্য জড়িত হতে থাকে। সুলতানি আমলের ধারাটি একটি গতিশীল রূপ লাভ করে হুসেন শাহ যুগে এসে। নিজে হুসেন শাহী যুগে বাংলার শিল্প সাহিত্যসমূহ বর্ণনা করা হলো-

১. মহাভারত : মধ্যযুগের খ্যাতনামা কবি এবং বাংলা ভাষায় প্রথম মহাভারত রচয়িতা হিসেবে কবীন্দ্র পরমেশ্বরের নাম সর্বজনবিদিত। 

চট্টগ্রামের শাসক পরাগন খান মহাভারতের কাহিনী লোকমুখে শুনে কৌতূহলী হন এবং তাকে সংক্ষেপে মহাভারত রচনা করতে নির্দেশ দেন। এ গ্রন্থে পাণ্ডবদের কাহিনী বিবৃত হয়েছে। 

হস্তিনাপুর রাজ্যের উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব নিয়ে এ গ্রন্থ রচনা করা হয়েছে। যুদ্ধবিগ্রহের কাহিনী হওয়ায় পরাগণ যান এ বিষয়ে তার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন।

২. মনসামঙ্গল : সুলতান হুসেন শাহের সময়ে 'বিজয়গুপ্ত' 'মনসামঙ্গল' কাব্য রচনা করেন। মনসামঙ্গল কাব্যে চাঁদ সওদাগর ও দেবী মনসার দ্বন্দ্বের বাহিনী ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। 

চাপ সওদাগর ছিলেন শিবের পূজক। মনসাকে পূজা করতে তিনি অস্বীকার করলে দেবী তার সমূহ ক্ষতি করেন। অবশেষে নিজপুত্র লখীন্দরকে বাসর রাতে মনসা দংশন করে। 

লখীন্দরের স্ত্রী বেহুলা দেবতাদের সন্তুষ্ট করে স্বামীর প্রাণভিক্ষা লাভ করেন। অবশেষে বেহুলার অনুরোধে চাঁদ সওদাগর মনসার পূজা করতে রাজি হয়।

৩. শ্রীকৃষ্ণ বিজয় : সুলতানি আমলের একজন বিখ্যাত কবি হলেন মনোধর বসু। তিনি হুসেন শাহের মন্ত্রী ছিলেন। তিনি ‘শ্রীকৃষ্ণ বিজয়' গ্রন্থটি রচনা করেন। ‘শ্রীকৃষ্ণ বিজয়' গ্রন্থে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ঐশ্বর্য ও মহিমা কীর্তন করা হয়েছে।

B. মনসা বিজয় : বিপ্রদাস হুসেন শাহের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। তিনি 'মনসা বিজয়' গ্রন্থটি রচনা করেন। দেবী মনসার বিজয়কে প্রাধান্য দিয়ে তিনি এ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।

৫. চণ্ডীর উপাখ্যান : জি জনাদিন হুসেন শাহের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় 'চন্ডীর উপাখ্যান' রচনা করেছিলেন। এ উপাখ্যান বাংলা সাহিত্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানস্বরূপ।

৬. সত্যপীরের পাঁচালী : কবি কংক মধ্যযুগের একজন কবি ও সত্যপীরের পাঁচালি কাব্যের আদি রচয়িতা। তিনি একজন মুসলিম ফকিরের মুরিদ হন। 

ঐ পীরের আদেশেই তিনি 'সত্যপীরের পাঁচালী' রচনা করেন। সত্যপীরের পাঁচালী বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ।

৭. বিদগ্ধ মাধব ও ললিত মাধব রূপগোস্বামী : হুসেন শাহের রাজদরবারের প্রধান সচিব ছিলেন। তিনি বিদগ্ধ মাধব' ও 'ললিত মাধব' গ্রন্থ রচনা করেন। এছাড়া তিনি হংসদূত, উপদেশমৃত প্রভৃতি গ্রন্থও রচনা করেন।

৮. বৈষ্ণবপদ : নসরত শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় বিদ্যাপতি ও শেখ কবির দু'জনেই বৈষ্ণব পদে রচনা করেন। এ বিদ্যাপতি 'মৈথিল কবি নন। ইনি বাংলার বিদ্যাপতি। 

বৈষ্ণব পদগুলো খুবই মূল্যবান বলে বিবেচিত হয়। বৈষ্ণব পদগুলোতে শ্রীচৈতন্যের বাণীসমূহকে সংকলন করে রাখা হয়েছে।

৯. বিদ্যাসুন্দর : যুবরাজ থাকাকালীন ফিরোজ শাহ শ্রীধর কবিরাজকে 'বিদ্যাসুন্দর' কাব্য রচনায় অনুপ্রাণিত করেন। সম্ভবত 'কবিরাজ' ফিরোজ শাহ প্রদত্ত উপাধি, 'বিদ্যাসুন্দর' অনুবাদ কাব্যগীতিনাট্যের ভঙ্গিতে রচিত।

১০. চৈতন্যভগবত : সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহের রাজত্বকালেই শ্রীচৈতন্যের প্রথম জীবনীগ্রন্থ চৈতন্যভাগবত' (১৫৩৬ খ্রি.) বৃন্দাবন দাস কর্তৃক রচিত হয়। দু'বছর পর লোচন দাসের 'চৈতন্যমঙ্গল' কাব্যও পাওয়া যায়।

১১. পদ্মপুরান : হুসেন শাহের আনুকূল্যে বিজয় গুপ্ত ‘পদ্মপূরণ' কাব্য রচনা করেন। এ কাব্য বিজয় গুপ্তের কাব্য প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করে।

১২. হিদায়াতুল রামী : মুহম্মদ বুদই হিদায়াতুল রামী গ্রন্থটি রচনা করেন। গ্রন্থটি তিনি হুসেন শাহকে উৎসর্গ করেন। এ গ্রন্থটি ধনুর্বিদ্যা সংক্রান্ত, সে যুগে যুদ্ধবিগ্রহে অস্ত্রশস্ত্র হিসেবে তীরের ব্যবহার হত। ফলে বইটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। গ্রন্থটি ফারসি ভাষায় রচিত।

১৩. সহীহ আল বুখারী : মুহম্মদ-বিন-ইয়াজদান বক্‌স ১৫০৩ খ্রিষ্টাব্দে 'সহীহ-আল-বুখারী' গ্রন্থের তিন খণ্ড অনুবাদ সমাপ্ত করেন। গ্রন্থখানি হুসেন শাহের রাজধানী একডালায় বসে লিখিত। 

তৃতীয় খণ্ডের পুথির পুস্তিকায় হুসেন শাহের এক দীর্ঘ প্রশস্তি রয়েছে। ইনিও একজন ফারসি ভাষার পণ্ডিত।

১৪. মৃগাবতী : ‘মৃগাবতী' গ্রন্থটি রচনা করেন 'কুতবন' নামে একজন লেখক। গ্রন্থটি আরবি ভাষায় লিখিত। এ গ্রন্থে হুসেন শাহ সম্পর্কে বিশেষ গুণকীর্তন করা হয়েছে। গ্রন্থটি প্রণয় কাহিনী নিয়ে রচিত। কুতবন হুসেন শাহ শার্কীর সাথে বাংলায় এসে আশ্রয় গ্রহণ করেন।

১৫. চৈতন্যচরিতামৃত : হুসেন শাহের সময়ে 'কৃষ্ণদাস | কবিরাজ শ্রীচৈতন্যের জীবনীগ্রন্থ রচনা করেন। চৈতন্যচরিতামৃত' গ্রন্থে তিনি হুসেন শাহের ব্যাপক প্রশংসা করেছেন। 

কৃষ্ণদাস কবিরাজ তার এ গ্রন্থে শ্রীচৈতন্যের নানা বিষয় তুলে ধরেছেন। একই সাথে তিনি বাংলার শাসক হুসেন শাহ ও সুবুদ্ধি রায়ের একটি ঘটনারও বর্ণনা প্রদান করেছেন।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, মুসলমান লেখকেরাও এ সময়ে বাংলা সাহিত্যে অবদান রেখেছিলেন। পদাবলি রচনায় মুসলমানদের নাম পাওয়া যায়। হুসেন শাহী যুগে বাংলা সাহিত্যের ব্যাপক চর্চা হয়েছিল।

একই সাথে আরবি ও ফারসি ভাষায়ও বিভিন্ন গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। হুসেন শাহী যুগে বাংলা সাহিত্যের ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। তাই এ সময়কালকে ‘A golden era of Bengalee literature' বলা যেতে পারে। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ