ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষের উল্লেখপূর্বক ধর্মপালের রাজ্যবিস্তার সম্পর্কে আলোচনা কর

ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষের উল্লেখপূর্বক ধর্মপালের রাজ্যবিস্তার সম্পর্কে আলোচনা কর
ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষের উল্লেখপূর্বক ধর্মপালের রাজ্যবিস্তার সম্পর্কে আলোচনা কর

ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষের উল্লেখপূর্বক ধর্মপালের রাজ্যবিস্তার সম্পর্কে আলোচনা কর

উত্তর : ভূমিকা : প্রাচীন বাংলার ইতিহাস এক উল্লেখযোগ্য সময় হলো পালবংশের রাজত্বকাল। ধর্মপাল ছিলেন, ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলা অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী পাল সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় শাসক। তিনি ছিলেন পাল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপালের পুত্র ও উত্তরাধিকারী। 

তিনি পৈত্রিক রাজত্বের সীমানা বহুলাংশে বৃদ্ধি করেন এবং পালবংশকে উত্তর ও পূর্ব ভারতের প্রধান রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেন। সাম্রাজ্য বিস্তার করতে গিয়ে তিনি কনৌজকেন্দ্রিক ত্রিপক্ষীয় শক্তির সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। 

নিম্নে প্রশ্নাবলিকে বিস্তারিত আলোচনায় তুলে ধরা হলো-

→ ত্রিশক্তির বর্ণনা : ত্রিশক্তি বা ত্রিপক্ষীয় শক্তি বলতে পাল শাসনামলকালীন পালবংশসহ আরও দুটি সমসাময়িক শক্তিশালী শাসকগোষ্ঠীকে বুঝানো হয়েছে। 

তৎকালীন সময়ে এই তিন শাসকশ্রেণির মাঝে কনৌজে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষ হয়েছিল। পালবংশ ছিল ত্রিশক্তির মাঝে অন্যতম। অন্য দুটি শাসক শ্রেণি হলো প্রতীহার ও রাষ্ট্রকূট।

→ ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষ : পালবংশের প্রতিষ্ঠাতা দেবপালের মৃত্যুর পর তার পুত্র ধর্মপাল সিংহাসনে আরোহণ করে ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। 

নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা তুলে ধরা হলো-

১. আধিপত্য বিস্তার : ত্রিপক্ষীয় শক্তি তথা পাল, প্রতীহার ও রাষ্ট্রকূটদের মাঝে সংঘর্ষের অন্যতম কারণ ছিল আধিপত্য বিস্তার। 

প্রতিটি শক্তিই সর্বদা অপর শক্তি তথা তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের উপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করতো আর তৎকালীন শাসননীতিতে একে অপরের উপর আধিপত্য বিস্তার প্রচেষ্টা দোষের ছিল না বরং এটা যুদ্ধনীতির একটি অন্যতম অংশ ছিল।

২. ত্রিশক্তির সংঘর্ষের প্রথম পর্যায় : আনুমানিক ৭৯০ খ্রিষ্টাব্দে ত্রিশক্তির মাঝে সংঘর্ষের ১ম পর্যায় শুরু হয়। পাল রাজা এ সময়ে কনৌজের রাজনৈতিক শূন্যতার সুযোগ নিয়ে বাংলা হতে পশ্চিম দিকে দ্রুত অভিযান পরিচালনা করেন। 

একই সময় প্রতিহার রাজা বৎসরাজও মধ্যদেশে সাম্রাজ অগ্রসর হন। এক পর্যায়ে ধর্মপাল ও বৎসরাজের মাঝে সংঘর্ষ বাঁধে এবং ধর্মপাল পরাজিত হন।

৩. প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূট রাজার মাঝে সংঘর্ষ : প্রতিহার রাজ কংসরাজের নিকট যখন ধর্মপাল পরাজিত হয় এমন পর্যায়ে তৃতীয় শক্তির আবির্ভাব হয়। তিনি হলেন রাষ্ট্রকূট রাজা ধ্রুব।

ধ্রুবপালবংশের উপরে বিজয়ী প্রতিহার রাজা বংসরাজের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হন এবং রাষ্ট্রকূট রাজা ধ্রুব প্রতিহার রাজা বৎসরাজকে পরাজিত করেন এবং কনৌজে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা

৪. ধর্মপাল ও ধ্রুবর মাঝে সংঘর্ষ : প্রতিকারের রাজা বৎসরাজকে পরাজিত করার পর রাষ্ট্রকূট রাজা পান বাজা ধর্মপালের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। 

এ যুদ্ধে রাষ্ট্রকূট রাজা ধ্রুব পাল রাজা ধর্মপালের উপর বিজয়ী হন। তবে তিনি আধিপত্য বিস্তার বা বিজয় সংরক্ষণের চেষ্টা না করে দাক্ষিণাত্যে প্রত্যাবর্তন করেন।

৫. কনৌজে প্রভাব বিস্তার : রাষ্ট্রকূট রাজা ধ্রু রক্ষা করার জন্য তড়িঘড়ি করে কনৌজ ত্যাগ করেন। আর এ শূন্যতার সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগান পাল রাজা ধর্মপাল। 

তিনি সুযোগমতো তার হারানো শক্তি পুনরুদ্ধারে মনোনিবেশ করেন। যাষ্ট্রকূট রাজার অনুপস্থিতে তিনি (গোপাল) কনৌজে পূর্ণ আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হন।

৬. নাগভটের যুদ্ধ প্রস্তুতি : কনৌজে আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে পাল রাজা ধর্মপাল এ রাজ্যে নিজ শাসননীতি প্রতিষ্ঠা করেন। অন্যদিকে, প্রতিহার রাজা বৎসরাজের পুত্র দ্বিতীয় নাগরী সিংহাসনে বসেন।

পূর্ব প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে তিনি পালবংশের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার সুযোগ খুঁজতে থাকেন। নিজ সেনাবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য নাগভট্ট পার্শ্ববর্তী বেশ কয়েকটি রাজ্যের সাথে সন্ধি স্থাপন করেন, যা তার শক্তিকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল।

৭. চক্রাধের পরাজয় : পাল রাজা ধর্মপাল কনৌজে নিজ আধিপত্য ধরে রাখার জন্য তার একান্ত ঘনিষ্ঠ চক্রায়ুধকে কনৌজোর শাসনের দায়িত্ব দেন। 

এনিকে রাজা নাগভট্ট পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী কনৌজ আক্রমণ করেন এবং ধর্মপালের অত্যন্ত আস্থাভাজন চক্রায়ুধকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন।

৮. নাগভট্ট ও ধর্মপালের মাঝে সংঘর্ষ : প্রতীহার রাজা নাগভট্ট কনৌজের শাসক চক্রাধকে পরাজিত করার পর পাল সম্রাট ধর্মপালের সাথে ভয়াবহ সংঘর্ষে লিপ্ত হন। 

তুমুল যুদ্ধের পর পাল রাজা চক্রামুখের নগর একই ভাগ্য বরণ করেন। অর্থাৎ তিনিও প্রতিহার রাজা নাগভট্টের নিকট শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন।

৯. নাগভট্ট ও গোবিন্দের মুখোমুখি সংঘর্ষ : পাল রাজা ধর্মপালকে পরাজিত করার মাধ্যমে প্রতিহার রাজা নাগভট কনৌজে নিজ আধিপত্য বিস্তার করেন। তবে তার এ আধিপত্য খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।

রাষ্ট্রকূট রাজা ধ্রুবের পুত্র তৃতীয় গোবিন্দ নাগভট্টের রাজ্য আক্রমণ করেন। নাগভট্ট ও গোবিন্দের মাঝে মুখোমুখি লড়াই শুরু হয় এবং এক পর্যায়ে নাগভট্ট তৃতীয় গোবিন্দের নিকট পরাজিত হন।

১০. গোবিন্দের নিকট আনুগত্য স্বীকার : রাষ্ট্রকূট রাজা তৃতীয় গোবিন্দের নিকট নাগভট্ট পরাজিত হওয়ায় ধর্মপালের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়। 

তিনি রাষ্ট্রকূট রাজা তৃতীয় গোবিন্দের নিকট আনুগত্য স্বীকার করেন। খুব সম্ভব পিতার মতো তৃতীয় গোবিন্দও আধিপত্য সংরক্ষণ না করে দাক্ষিণাত্যে ফিরে গিয়েছিল। 

১১. সর্বময় অধিপত্য বিস্তার : রাষ্ট্রকূট রাজা তৃতীয় গোবিন্দ দক্ষিণাত্যে ফিরে যাওয়ায় আর্যবর্তে ধর্মপালের আর কোনো প্রতিদ্বনী শক্তি বর্তমান ছিল না। এ সুযোগে ধর্মপাল বাংলায় ব্যাপক আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ পান। 

পরবর্তীতে আর কোনো প্রতিষণীর মুখোমুখি না হতে হওয়ায় ধর্মপাল আমৃত্যু ভারতীয় উপমহাদেশে একক আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়েছিলেন।

→ ধর্মপাশের রাজ্য বিস্তার নীতি : পাল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা গোপালের পুত্র ধর্মপাল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে রাজ্য বিস্তার নীতি ছিল নিম্নরূপ-

১. উত্তর ভারতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা : গোপাল পুত্র ধর্মপাল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে সমগ্র উত্তর ভারতে আধিপত্য বিস্তারে মনোনতে করেন। তিনি এসময় প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূট রাজাদের বাধার সম্মুখীন হন।

ফলে তিনি তাদের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন, যা ইতিহাসের পাতায় ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষ নামে পরিচিত। ধর্মপাল তাদের নিকট পরাজিত হওয়ার পরও সু- কৌশলে সমগ্র উত্তর ভারতে নিজ আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হন।

২. রাজ্য বিজয়াভিযান : ধর্মপাল যতদিন ক্ষমতায় ছিলেন তিনি একের পর এক রাজ্য বিজয়ের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। তিনি দ্বিগ্বিজয়ে বের হওয়ার পূর্বে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির লক্ষ্যে কেনার ও গোফর্ন এই দুই তীর্থ ও গঙ্গা সাগর সঙ্গম দর্শন করেন। 

দ্বিগ্বিজয়ের বাসনা নিয়ে তিনি তার বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে পাঞ্জাব পর্যন্ত বিজয়াতিযান অব্যাহত রেখেছিলেন।

৩. চন্দ্রারুধের উপর শাসনভার অর্জন : বিখ্যাত পাল রাজা গোপাল কনৌজে আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা চালান। ধর্মপাল কনৌজের সিংহাসন থেকে ইন্দ্রায়ুধকে সরিয়ে চন্দ্রায়ুধকে বসানোর মাধ্যমে তার আধিপত্য বিস্তারের মনোবাসনার বাস্তব রূপদান করেন। পরবর্তীতে চন্দ্রায়ুধ পরাজিত হলেও তিনি কৌশলে আবার কনৌজে আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হন।

৪. উত্তর ভারতের রাজাদের স্বীকার : সমগ্র উত্তর ভারতে আধিপত্য বিস্তারের পর ধর্মপাল উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের রাজাদের কনৌজের রাজ দরবারে আমন্ত্রণ জানান। 

এ সময় উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত রাজাগণ ধর্মপালের নিকট বশ্যতা স্বীকার করেন। ফলে এসব অঞ্চলে ধর্মপালের আধিপতা চূড়ান্ত রূপ লাভ করে।

উপসংহার : আলোচনার শেষ পর্যায়ে এ কথা বলা যায় যে, গোপালের সুযোগ্য পুত্র পাল রাজা ধর্মপাল ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও দূরদর্শিতাসম্পন্ন। 

তিনি তার দীর্ঘ শাসনামলে পালবংশের রাজ্য বিস্তার নীতি অব্যাহিত রেখেছিলেন। তবে তার রাজ্য বিস্তার নীতিতে অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূট রাজবংশ। 

যাদের সাথে ধর্মপালকে কয়েক দফায় মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হয়েছিল। ইতিহাসের পাতায় যা ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষ বা ত্রিশক্তির সংঘর্ষ নামে অভিহিত। 

যে যুদ্ধে তিনি পরাজয়ের পরও কনৌজসহ সমগ্র উত্তর ভারতে পালবংশের আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়েছিলেন। পালবংশের এ সাম্রাজ্য বিস্তার নীতি আজও ইতিহাসের পাতায় সুরক্ষিত আছে)

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ