এলিট সম্পর্কে প্যারেটোর মতবাদ ব্যাখ্যা কর

এলিট সম্পর্কে প্যারেটোর মতবাদ ব্যাখ্যা কর
এলিট সম্পর্কে প্যারেটোর মতবাদ ব্যাখ্যা কর

এলিট সম্পর্কে প্যারেটোর মতবাদ ব্যাখ্যা কর

  • অথবা, প্যারেটোর এলিটবাদ সম্পর্কিত ধারণাটি ব্যাখ্যা কর।

উত্তর : ভূমিকা : বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এলিট (Elite) একটি বহুল আলোচিত বিষয়। বিভিন্ন রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এলিটের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। 

ভিলফ্রেডো প্যারেটো (Vilfredo Pareto : 1848-1823) প্রথম সমাজবিজ্ঞানের আলোচনায় 'এলিট' শব্দটি ব্যবহার করেন। তাঁর মতে, 'এলিট' (Elite) ইংরেজি শব্দটির বাংলা অর্থ হল উৎকর্ষের বিচারে উচ্চতর।

প্যারেটো তাঁর 'The Rise and Fall of Elites' শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন, "The elites from the upper classes and usually also the richest."

প্যারেটোর এলিটবাদ : সমাজবিজ্ঞানের আলোচনায় প্যারেটোর এলিটবাদ একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে । প্যারেটো তাঁর The Mind and Society' শীর্ষক গ্রন্থে এলিটবাদ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

এলিট সম্পর্কে প্যারেটোর ধারণা : প্যারেটো একেবারে নিজস্ব মৌলিক ধারায় এলিট সম্পর্কিত ধারণা ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে সকল মানুষ সমান নয়। 

গুণগত যোগ্যতা ও সামর্থ্যের বিচারে সবাই সমান নয়। দৈহিক, বৌদ্ধিক ও নৈতিক দিক থেকে ব্যক্তিবর্গের মধ্যে স্বাভাবিক বৈষম্য বর্তমান থাকে। 

কেউ কেউ অন্যদের থেকে অধিকতর বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ ও দক্ষ। সমাজের অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে গুণগত যোগ্যতার বিচারে এ পার্থক্যের পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক স্তরবিন্যাসের সৃষ্টি হয়। 

উৎকর্ষে উচ্চতর মানের হওয়ার জন্য সমাজের কিছু মানুষ বাছাই করা শ্রেণি বা সেরা শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।মূল্যমান নিরপেক্ষ ধারণা প্যারেটো 'এলিট' শব্দটি মূল্যমান নিরপেক্ষ (Value free) ভাবে ব্যবহার করেছেন। 

কোন নৈতিক বা সম্মানিক অর্থ তিনি 'এলিট' শব্দের সঙ্গে সংযুক্ত করেন নি। ভালোমন্দ নির্বিশেষে সকল ক্ষেত্রেই সেরাদের তিনি এলিট শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করেছেন। 

অধ্যাপক আশরফ ও শর্মা (Dr. Ali Ashraf and L. N. Sharma) তাঁদের 'Political Sociology' শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন, "Fareto uses the word 'elite' in its etymological and the most capable for good as well as evil" প্যারেটো প্রধানত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক এলিটদের কথা বলেছেন একথা ঠিক। 

তবে তিনি ধর্ম, শিল্প, নৈতিকতা প্রভৃতি ক্ষেত্রেও এলিট শব্দটি প্রয়োগ করেছেন। আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে যারা অতিমাত্রায় পবিত্র তারা ধর্ম বিষয়ে এলিট।

শাসক এলিট ও অশাসক এলিট প্যারেটোর মতানুসারে উচ্চতর স্তরের মধ্যে দু'টি শ্রেণি বর্তমান। অর্থাৎ প্যারেটো এলিটদের দু'টি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। 

এলিটদের এ দু'টি শ্রেণি হল :

১. শাসক এলিট (Governing elite),

২. অশাসক এলিট (Non-governing elite)।

যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রশাসনের সঙ্গে সংযুক্ত, সরকারি ভূমিকা যথেষ্ট পরিমাণে পালন করে বা সরকারের উপর প্রভাব খাটায় তাদের নিয়েই গঠিত হয় শাসক এলিট। 

শাসক এলিটরা সরকারি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। স্বভাবতই শাসক এলিটরা সমাজে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানের অধিকারী। 

আর শাসক এলিটদের বাদ দিলে সকলেই অশাসক এলিট হিসেবে বিবেচিত হয়। এ দ্বিতীয় শ্রেণির এলিট গোষ্ঠী তাদের নিয়েই গঠিত হয় যারা সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রহিত, কিন্তু সমাজে উচ্চতর স্তরের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য কোন না কোনভাবে প্রশাসনকে প্রভাবিত করতে পারে। 

এলিট শ্রেণির সিদ্ধান্তসমূহ এবং এ শ্রেণির মধ্যে সংঘটিত ঘটনাসমূহ মানবসমাজ ও সভ্যতার ইতিহাসকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। 

ঐতিহাসিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এলিট শ্রেণির ভূমিকা সিদ্ধান্তমূলক। সমাজের অন্যান্য শ্রেণির ভূমিকা এক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত গুরুত্বহীন। 

শাসক এলিটের উদাহরণ হিসেবে সাধারণত মন্ত্রী, সিনেটর বা মন্ত্রীদের কথা বলা হয়। এদের অধিকাংশেরই শাসক এলিটের প্রয়োজনীয় গুণাবলি বা যোগ্যতা থাকে। 

তবে এর ব্যতিক্রমও দেখা যায়। আবশ্যক গুণাবলির অধিকারী না হলেও কেউ কেউ শাসক এলিটের তকমা পেয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে প্যারেটো মন্তব্য করেছেন, "The socalled upper classes are also usually the richest."

মৌল বৈশিষ্ট্য : উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এলিটের কতকগুলো মৌলিক বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যায় । যথা : 

প্রথমত, এলিটদের দু'টি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয় (শাসক ও অশাসক এলিট)।

দ্বিতীয়ত, এলিট শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিবর্গ প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্যভাবে এবং নিপুণভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতা পরিচালনা বা ব্যবহার করে।

তৃতীয়ত, এলিট শ্রেণির অস্তিত্ব সর্বজনীন, সকল দেশের সমাজব্যবস্থায় এলিট শ্রেণির অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়।

মৌল মতবাদ : মানুষ মানেই নিজের আচারব্যবহারকে বাস্তববাদী, যুক্তিসঙ্গত ও জনকল্যাণ হিসেবে প্রতিপন্ন করতে চায়। 

প্রত্যেক ব্যক্তি তার ব্যবহারের সঠিক প্রকৃতি প্রসঙ্গে কখনও ভালো করে, কখনও বিশ্লেষণ আবার কখনও পরিবর্তন করে। যেসব উপায়ে বা পথে মানুষ তা করে, প্যারেটোর মতে তা হল মৌল মতবাদ (Derivation).প্যারেটোর 

এলিট মতবাদের সীমাবদ্ধতা : এলিট সম্পর্কিত প্যারেটোর মতবাদ বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানিগণ প্যারেটোর এলিট মতবাদের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করেছেন। যথা :

১. এলিটের গুণাবলি সম্পর্কিত প্যারেটোর ব্যাখ্যা যথেষ্ট বিবেচিত হয় না। অনেক ক্ষেত্রে এ ব্যাখ্যা অবৈজ্ঞানিক ও নি অস্পষ্ট।

২. প্যারেটো অভিজাত সম্প্রদায়ের অবক্ষয় ও অবসানের কথা বলেছেন। কিন্তু তিনি অবক্ষয় প্রক্রিয়ার পরিমাপ সম্পর্কে আলোচনা করেন নি

(sailo gnillust)

৩. আবার এলিট শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত সকলের গুণগত যোগ্যতা অভিন্ন প্রকৃতির নয় । 

৪. প্যারেটোর এলিট তত্ত্বের সিদ্ধান্তসমূহ সর্বক্ষেত্রে ঐতিহাসিকভাবে সমর্থিত নয়। যে কারণে তাঁর মতবাদকে অনৈতিহাসিক বলে চিহ্নিত করা হয়।

উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, মূলত সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে জ্ঞানানুসন্ধানের ক্ষেত্রে প্যারেটো কেবলমাত্র নিজের অভিজ্ঞতা ও প্রত্যক্ষণের উপর নির্ভর করার পক্ষপাতী ছিলেন। প্যারেটোর পরিকল্পার মূলকথা হল উন্নয়ন, দ্বন্দ্ব বা সংঘাত নয়। 

প্যারেটোর এলিটবাদ কিছুটা সমালোচনার সম্মুখীন হলেও তিনি শাসক ও অশাসক এলিটের মধ্যে যে সম্পর্কের কথা বলেছেন তাকে বর্তমান সময়ে একেবারে অস্বীকার করার উপায় নেই। এক্ষেত্রে তার মতবাদের সার্থকতা রয়েছে। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ