পরিবর্তনশীল সমাজের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর । বাংলাদেশের সমাজ কী পরিবর্তনশীল সমাজ

পরিবর্তনশীল সমাজের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর । বাংলাদেশের সমাজ কী পরিবর্তনশীল সমাজ
পরিবর্তনশীল সমাজের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর । বাংলাদেশের সমাজ কী পরিবর্তনশীল সমাজ

পরিবর্তনশীল সমাজের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর । বাংলাদেশের সমাজ কী পরিবর্তনশীল সমাজ

  • অথবা, রূপান্তরশীল সমাজের মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ যথাযথ উদাহরণসহ ব্যাখ্যা কর।

উত্তর : ভূমিকা : মানুষ ও মানুষের চিন্তাধারা নিয়ত পরিবর্তনশীল। নতুন নতুন চিন্তাচেতনার সাথে নিজেকে মানিয়ে নেবার জন্য মানুষ সর্বদা সচেষ্ট। 

আর এর ফলশ্রুতিতেই সর্বক্ষেত্রে এসেছে গতিশীলতা, গতিময়তা, যার থেকে বাদ পড়ে নি সমাজব্যবস্থা। এ যেন অনেকটা নদীর ধারার মত একের পর এক পরিবর্তিত হচ্ছে সমাজব্যবস্থা।

অতীতের Traditional বা সনাতন সমাজব্যবস্থা বর্তমান Transitiorial বা পরিবর্তনশীল সমাজব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। সর্বোপরি মানুষ এখন পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি সচেতন ও পরিবর্তনে অঙ্গীকারাবদ্ধ।

পরিবর্তনশীল সমাজ (Transitional society) : রূপান্তরশীল সমাজব্যবস্থা বা Transitional society বলতে ঐ সমাজব্যবস্থাকে বুঝানো হয়েছে যে সমাজব্যবস্থা দীর্ঘদিনের অতীত ঐতিহ্য ছেড়ে দিয়ে আধুনিক সমাজব্যবস্থায় প্রবেশ ঠিকই করেছে, কিন্তু আধুনিকীকরণ সম্পন্ন করতে পারে নি বা Modern social status অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। ঐ সমাজব্যবস্থাকে Transitional বা রূপান্তরশীল বা পরিবর্তনশীল সমাজব্যবস্থা বলে।

পরিবর্তনশীল সমাজের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য (Main characteristics of transitional society) : পরিবর্তনশীল সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য নিম্নে আলোচনা করা হল :

১. গতিশীল শক্তির উত্ত (Emergence of moving power) : সামাজিক পরিবর্তন প্রক্রিয়ার কোন কোন ক্ষেত্রে প্রগতি খুব ধীরগতিতে সাধিত হয়। যেমন- বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের প্রাক্কালে যেসব আশ্বাস ও অধীকার দেয়া, হয়েছিল সেসব অনেকাংশে অপূর্ণই থেকে যায়। 

এ কারণে পাশ্চাত্যমনা তরুণ এলিট শ্রেণি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং তাদের দ্বারা এক গতিশীল শক্তি সৃষ্টি হয়।

২. অর্থনৈতিক উন্নয়ন (Economical development) : পরিবর্তনের ফলে এসব অঞ্চলের জনগণ নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সচেষ্ট হয়। গুণাবলি ও দক্ষতা সামাজিক মর্যাদায় পরিণত হওয়ায় জনগণ আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন ও উন্নয়ন ঘটাতে সচেষ্ট থাকে।

৩. সনাতন সমাজের ভাঙন (Breaking of traditional society) : পরিবর্তনশীল সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল এটি সনাতন সমাজের ভাঙন সৃষ্টি করে। উন্নততর সমাজগুলোর সংস্পর্শে আসার ফলে সনাতন সমাজগুলো মানবিক কল্যাণে কি ভূমিকা পালন করতে পারে সে সম্পর্কে ক্রমশ সচেতন হয়ে উঠে। ফলস্বরূপ সনাতন সমাজের ভাঙন ধরে এবং সমাজে শুরু হয় রূপান্তরশীল প্রক্রিয়া।

৪. মূল্যবোধ পরিবর্তন (Change of values) : সনাতন সমাজ ভেঙে পড়ার কারণে পরিবর্তনশীল সমাজে মূল্যবোধের পরিবর্তন হয়। মূল্যবোধের পরিবর্তন পরিবর্তনশীল সমাজের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য।

৫. সামাজিক মর্যাদা (Social status) : আধুনিকতর সমাজের সংস্পর্শে আসার ফলে পরিবর্তনশীল সমাজের সামাজিক মর্যাদা এবং সাধারণভাবে রাজনৈতিক প্রভাবের চূড়ান্ত নির্ধারক হয়ে উঠে গুণাবলি ও দক্ষতা। 

কিছুসংখ্যক ব্যক্তি নতুন নতুন দক্ষতায় প্রশিক্ষণ লাভ করে। সাধারণত এরূপ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ সনাতন সমাজের এলিট শ্রেণির অংশ হিসেবেই ছিলেন।

৬. অধিকার সচেতনতা (Consciousness of right) : অধিকার সচেতনতা পরিবর্তনশীল সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। জনগণ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে অধিকার সচেতন হয়ে পড়ে এবং অধিকার আদায়ের জন্য তারা সংগ্রামে লিপ্ত হয়।

৭. বহুবিধ সামাজিক শ্রেণি (Various social class) : পরিবর্তনশীল সমাজের আরেকটি বৈশিষ্ট হল বহুবিধ সামাজিক শ্রেণির উদ্ভব। সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে নানাবিধ সামাজিক শ্রেণির সৃষ্টি হয়। যেমন- ব্যবসায়ী, স্বেচ্ছাসেবক, পেশাজীবী, শিল্পপতি ইত্যাদি।

৮. সনাতন ব্যবহার প্রতি আকর্ষণ (To attraction of traditional system) : পরিবর্তনশীল সমাজে মানুষ পরিবর্তনের আশা করলেও সনাতন সমাজের প্রতি তাদের আকর্ষণ রয়ে যায়। 

ঐ সমাজে যে অবস্থানে তারা রয়েছিল সেখান থেকে বেরিয়ে আসাটাকে তারা অপরাধ বা অসম্মান বলে মনে করে।

অন্যদিকে, পরিবর্তনশীল সমাজে তাদের ভাগ্যোন্নয়ন ঘটবে, সুযোগ সুবিধা বাড়বে ইত্যাদি ভেবে তারা আশাবাদীও হয়ে উঠে।

৯. আধুনিকতায় উদ্বুদ্ধ (Inspired in modernity) : পরিবর্তনশীল সমাজে জনগণ আধুনিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের দাবিতে সর্বদা অটল থাকে। এছাড়া অন্যান্য সমাজের প্রভাবে তারা আধুনিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়।

১০. উন্নত সমাজের সংস্পর্শ (Concern of great society) : পুরাতন সমাজকাঠামোতে ভাঙনের সৃষ্টি হয়ে রূপান্তর প্রক্রিয়া শুরু হয়। উন্নত সমাজের সংস্পর্শে আসার ফলে সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটতে থাকে।

১১. বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণির ভূমিকা (Role of different social class) : সামাজিক পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় কোন কোন ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর লোকজন অধিক প্রতিপত্তিশালী হয়ে উঠেছে। কোন এক পর্যায়ে বুদ্ধিজীবীরাও পেশাগতভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ কর্তৃক প্রভাব বিস্তার করেছে। 

কখনও কখনও ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিগণ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে এবং কতিপয় ভূস্বামীরা সামাজিক পরিবর্তনের কাজে এগিয়ে এসেছে।

১২. সনাতন সমাজ পরিবর্তন (Change of traditional society) : উন্নত সমাজের সংস্পর্শে আসার ফলে পুরাতন সমাজের কাঠামো ও মূল্যবোধ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। 

শুধু তাই নয়, সনাতন সমাজে ঢুকে পড়ে উন্নত সমাজের দক্ষতা, ভাবধারা, রীতিনীতি ইত্যাদি। ফলে সনাতন সমাজে দেখা দেয় পরিবর্তন।

১৩. গণতান্ত্রিক ভাবধারার বিকাশ (Development of democratic thought) : পরিবর্তনশীল সমাজে জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক ভাবধারার বিকাশ সাধিত হয়। 

এসব পাশ্চাত্য গণতান্ত্রিক বিপ্লবী ভাবধারাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল আইনের চোখে সকলে সমান, তাদের প্রতিভা বিকশিত করার সময় সুযোগ তাদেরকে প্রদান, এক ব্যক্তি একভোট ইত্যাদি।

১৪. সমাজবাদী ধারণা (Concept of socialist) : পরিবর্তনশীল সমাজে সমাজবাদী ধারণার বিকাশ সাধিত হয়। এসব সমাজবাদী ধারণা রূপান্তরশীল সমাজগুলোতে বিরাট আবেগ সৃষ্টি করে। 

এরূপ সমাজে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলো নিজেদের টিকিয়ে রেখেছে, কিন্তু এলিট হিসেবে তাদের ক্ষমতার অবলুপ্ত হয়েছে।

১৫. গণমাধ্যমের ভূমিকা : রূপান্তরশীল সমাজব্যবস্থাতে গণমাধ্যমগুলো সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। এখানে স্বায়ত্তশাসনের সুযোগ কম। অর্থাৎ গণমাধ্যমগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না বললেই চলে।

১৬. রাজনৈতিক সংস্কৃতি : রূপান্তরশীল বা Transitional society তে অনুন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতি, আন্তঃদলীয় কোন্দল, বৈধতার সংকট, সামরিক হস্তক্ষেপ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাব ইত্যাদি কারণে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করে।

বাংলাদেশ কী পরিবর্তনশীল সমাজ : সমাজের প্রতিটি স্তরে দেখা যায় যে, যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে সমাজকাঠামোরও পরিবর্তন ঘটে। প্রচলিত রীতিনীতি ও ধ্যানধারণা পুনর্বিন্যস্ত ও পুনর্গঠন করা হয়। 

ব্যক্তি ভিন্ন তথা নতুন ভাবধারায় অবতীর্ণ হয়। উৎপাদন ব্যবস্থায় গতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। এ সমাজের সকল বৈশিষ্ট্য বিচার করলে একথা বলা যায় যে, বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থা একটি পরিবর্তনশীল সমাজের বিশেষ দৃষ্টান্ত। 

এ দেশের কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় জনগণ এখনও সনাতন মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত হয়। এখানে রক্তের বন্ধন অত্যন্ত প্রবল। এখানে কৃষ্টিভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব ও অত্যন্ত প্রকট। 

এখানে শিক্ষার প্রসার হয়েছে সমাজের একটি ক্ষুদ্র শ্রেণির মধ্যে। সমাজব্যবস্থা ধর্মভিত্তিক হওয়ার ফলে ধর্মনিরপেক্ষ চেতনাও অত্যন্ত গভীর।

তাছাড়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রক্রিয়াও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। পাকিস্তানি শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এখানে একটা ভাষাভিত্তিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চেতনা গড়ে উঠেছিল। 

তা সত্ত্বেও এখানকার রাজনৈতিক কৃষ্টির উন্নয়ন ঘটে নি। এর কারণ হল এখানে জনসাধারণের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের হার অত্যন্ত কম এবং রাজনৈতিক কৃষ্টিও বেশ নিম্নমানের। 

সামগ্রিক রাজনৈতিক কার্যকলাপে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং উপরিউক্ত সংক্ষিপ্ত আলোচনা শেষে একথা বলা যায় যে, বাংলাদেশ একটি পরিবর্তনশীল সমাজের প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।

উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এ কথা বলা যায় যে, পরিবর্তনশীল সমাজ এমন একটা সমাজ যেখানে মানুষ মানসিক দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করে। সে সনাতন ব্যবস্থার প্রতি আকর্ষণবোধ করে। 

আবার নতুন পরিবেশের জন্যও আগ্রহী থাকে। তবে মানুষের মধ্যে সর্বদা একটা সংস্কারভাব কাজ করে। বলা যায় পরিবর্তনশীল সমাজব্যবস্থা হচ্ছে সনাতন ও আধুনিক সমাজব্যবস্থা। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ