সুবাদার মীর জুমলার আসাম ও কুচবিহার অভিযানের বর্ণনা দাও

সুবাদার মীর জুমলার আসাম ও কুচবিহার অভিযানের বর্ণনা দাও
সুবাদার মীর জুমলার আসাম ও কুচবিহার অভিযানের বর্ণনা দাও

সুবাদার মীর জুমলার আসাম ও কুচবিহার অভিযানের বর্ণনা দাও

  • অথবা, সুবাদার মীর জুমলা কর্তৃক আসাম ও কুচবিহার বিজয়ের বিবরণ দাও ।

উত্তর : ভূমিকা : সুবা বাংলার ইতিহাসে মীর জুমলা একটি অবিস্মরণীয় নাম। অতি সাধারণ অবস্থা থেকে স্বীয় যোগ্যতা ও মেধাবলে তিনি ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আওরঙ্গজেব কর্তৃক বাংলার সুবাদারি পদ লাভ করেন। 

তিনি ১৬৬০-৬৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মোট বছর বাংলার সুবাদার ছিলেন। সুবাদার হিসেবে তিনি বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল জয় করে তথায় মুঘল আধিপত্য বিস্তার করে মুঘল শাসনব্যবস্থা কায়েম করেন। 

তার সুবাদারির অধিকাংশ সময় আসাম ও কুচবিহার অভিযানে ব্যয় হয়। রাজা অভিযান, সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন প্রভৃতি ক্ষেত্রে সুবাদার মীর জুমলা কৃতিত্বের পরিচয় দেন।

মীর জুমলার আসাম ও কুচবিহার অভিযান : সুবাদার মীর জুমলা তার বছরের শাসনামলের ২ বছরই সামরিক অভিযানে ব্যয় করেন। নিচে মীর জুমলার আসাম ও কুচবিহার অভিযান সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

১. আসাম অভিযান : মীর জুমলার আসাম অভিযান ল বাংলার ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। মীর জুমলা কুচবিহার অধিকারের পর সেখানে কিছু সৈন্য রেখে ১৬৬২ সালের ৪ জানুয়ারি সৈন্যদল ও নৌবাহিনী নিয়ে আসামের দিকে অগ্রসর হন। 

তার আসাম জয়ের উদ্দেশ্য ছিল কামরূপ ও আসাম জায় করে অহোমরাজাকে শাস্তি প্রদান করা। এ উদ্দেশ্যে তিনি সৈন্যবাহিনী নিয়ে কামরূপ প্রবেশ করলে একটি বড় নৌযুদ্ধ সংঘটিত হয়। 

এ যুদ্ধে অহোমদের নৌশক্তি পরাজিত হয়। তাদের ৩০০ রণতরী মুঘলদের হস্তগত হয়। ফলে অহোমরা গোহাটি ও অন্যান্য স্থান থেকে সরে পড়লে কামরূপে পুনরায় মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।

কামরূপ দখলের পর মীর জুমলা তার অ্যাপতি অব্যাহত রাখেন। নদনদী বহুল, জঙ্গলাকীর্ণ ও পার্বত্যময় আসামের নানারূপ অসুবিধা উপেক্ষা করে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে মীর জুমলা অহোমরাজের রাজধানী ঝাড়গাওয়ের দিকে অগ্রসর হন। 

ফলে অহোমরাজ জয়ধ্বজ রাজধানী পরিত্যাগ করে দূর্ভেদা অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করে। অতঃপর মীর জুমলা ঝাড়গাগুয়ে প্রবেশ করে। 

প্রচুর অস্ত্র-শস্ত্র, বহু রণতরী ও ৮২টি হাতি হস্তগত করেন। অহোম রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে মুঘল শিবির স্থাপন করে মীর জুমলা বর্ষার আগমনের কারণে সেখানে অবস্থান করতে থাকেন। 

কিন্তু অচিরেই বর্ষা ও প্লাবণে মুঘল শিবিরগুলো পরস্পরের নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এছাড়া স্থানীয় জনসাধারণের অসহযোগিতার কারণে মুঘল সৈন্যবাহিনীর পক্ষে খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়ে। 

ফলশ্রুতিতে খাদ্যাভাবে ও অসুস্থ হয়ে বহু মুঘল সৈনা মৃত্যুবরণ করে। এই সুযোগে অহোমরা, তাদের গোপন আশ্রয়স্থল হতে বের হয়ে চারদিক থেকে মুঘল শিবিরে আক্রমণ করতে থাকে। 

এ পরিস্থিতিতে মীর জুমলা স্বীয় ব্যক্তিত্বের বলে সৈন্যদে মনোবল অটুট রাখেন। বর্ষা শেষে মীর জুমলা পুনরায় সৈন্যদল পরিচালনা করে অহোমদের উপর আক্রমণ শুরু করলে অহোমরাজ পুনরায় পার্বত্যাঞ্চলে পলায়ন করেন। 

কিন্তু মুঘলদের সাফল্যে বিচলিত হয়ে অহোমরাজ জয়ধ্বজ সন্ধির জন্য আবেদন করেন। এ সময় মীর জুমলা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি অহোমরাজের সন্ধি প্রস্তাবে রাজি হন। 

১৬৬৩ সালের জানুয়ারি মাসে অহোমরাজ ও মীর জুমলার মাঝে কতকগুলো শর্তসাপেক্ষ সন্ধি স্থাপিত হয়। 

শর্তগুলো হলো :

(ক) অহোমরাজ যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ মুঘলদের ২০,০০০ তোলা সোনা, ১,২০,০০০ তোলা রূপা ও ৪০টি হাতি দিতে স্বীকৃত হয়।

(খ) পরবর্তী ১২ মাসে অহোমরাজ ৩ লক্ষ তোলা সোনা এবং ৯০টি হাতি কিস্তিতে দিতে স্বীকৃত হয়।

(গ) ভারলি নদীর পশ্চিম, ব্রহ্মপুত্র নদীর উত্তর এবং কালং নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত আসামের অর্ধেকের বেশি ভূভাগ মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। অহমরাজ তার এক কন্যাকে দিল্লিতে প্রেরণ করেন এবং শাহজাদা আজমের সাথে তার বিবাহ হয়।

(ঘ) সন্ধির ২য় বছর থেকে অহোমরাজ করস্বরূপ প্রতি বছর মুঘলদের ২০টি হাতি দিতে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়।

(ঙ) বন্দি সকল মুঘলদের ক্ষতিপূরণ দিতে অহোমরাজ স্বীকৃত হয় ।

অহোমরাজাকে এভাবে অপমানজনক সন্ধি শর্তে আবদ্ধ করে মীর জুমলা আসামের উপর মুঘল অধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন ।

২. কুচবিহার অভিযান : কুচবিহার রাজপরিবারে ১৫৮১ সালে অন্তর্বিপ্লবের ফলে কামরূপ, কুচবিহার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বতন্ত্র রাজ্যে পরিণত হয়। ১৬১৩ সালে কামরূপ মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। কিন্তু কুচবিহার রাজা প্রাণনারায়ণ - পুনরায় কামরূপ স্বরাজ্যভুক্ত করতে যত্নবান হন। 

শাহজাদা সুজা যখন উত্তরাধিকার যুদ্ধে লিপ্ত তখন যুযোগ বুঝে কুচবিহারের রাজা প্রাণনারায়ণ মুঘল সম্রাটে আনুগত্য অস্বীকার করে এবং মুঘল অধিকৃত কামরূপ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন, এ সময় আসামের রাজা জয়ধজও মুঘল সাম্রাজ্যের সাথে শত্রুতা করতে শুরু করেন। 

তিনি এক বিরাট বাহিনী কামরূপ আক্রমণের জন্য প্রেরণ করেন। কামরূপের মুঘল ফৌজদার লুৎফুরা তাদের মোকাবিলা করতে অসমর্থ হয়ে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করলে অহোম বাহিনী ১৬৬০ সালের মার্চ মাসে সমগ্র কামরূপ দখল করে নেয়। 

এ সময় বাংলার শাসনভার গ্রহণ করে মীর জুমলা ১২,০০০ অশ্বারোহী, ৩০,০০০ পদাতিক এবং বিরাট নৌবরে নিয়ে কুচবিহার অভিযান করেন। রাজা প্রাণনারায়ণ রাজধানী থেকে পলায়ন করেন। 

মীর জুমলা কুচ রাজধানী অধিকার করে তার নামকরণ করেন আলমগীরনগর। এভাবে মীর জুমলার কৌশল ও রণনৈপূণ্যে কুচবিহার মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মীর জুমলা ছিলেন একজন দুর্ধর্ষ সেনানায়ক, দক্ষ শাসক এবং বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ । তার আসামান্য প্রতিভাই তাকে সাধারণ অবস্থা থেকে শাসকের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে। 

সুবাদার হিসেবে ক্ষমতাগ্রহণের পর তিনি সাময়িক কালের জন্য কুচবিহার ও আসামকে মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। তার মৃত্যুর পরই কুচবিহার ও আসামে মুঘল আধিপত্য খর্ব হয়। 

ঐতিহাসিক মুহাম্মদ তালিশ যথার্থই চলেছেন, “তার জীবন মানুষকে সমস্ত পার্থিব কীর্তি ও গৌরবের অসারতা সম্বন্ধে অবহিত করে।”

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ