একটি উত্তম অর্থনৈতিক পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্যসমূহ নিরূপণ কর
একটি উত্তম অর্থনৈতিক পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্যসমূহ নিরূপণ কর |
একটি উত্তম অর্থনৈতিক পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্যসমূহ নিরূপণ কর
- অথবা, একটি উত্তম অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় যেসব বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার তা আলোচনা কর ।
- অথবা, অর্থনৈতিক পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর ।
উত্তর : ভূমিকা : আধুনিক যুগ পরিকল্পনার যুগ। দৈনন্দিন জীবনের কার্যাবলি থেকে শুরু করে সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে মানুষকে পরিকল্পনামাফিক অগ্রসর হতে হয়। পরিকল্পনা মানুষকে সীমিত সম্পদ ও সামর্থ্যের সদ্ব্যবহার করে সর্বোত্তম কল্যাণ অর্জনে সাহায্য করে।
তাই বর্তমান বিশ্বের সকল দেশই তার অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনাকে একটি নির্ভরযোগ্য উপায় হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। সাধারণত রাষ্ট্রের সমৃদ্ধির জন্য সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিত কর্মসূচিই হলো অর্থনৈতিক পরিকল্পনা।
একটি উত্তম অর্থনৈতিক পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য : পরিকল্পনার মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যার্জনের প্রয়াস চালানো হয়। নিম্নে একটি উত্তম অর্থনৈতিক পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্যসমূহ তুলে ধরা হলো :
১. বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রতি গুরুত্বারোপ : একটি উত্তম অর্থনৈতিক পরিকল্পনার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রতি গুরুত্বারোপ করা।
একটি অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বর্তমান সময়ে করা হলেও সুদূর ভবিষ্যতের ওপর এর প্রভাব পড়তে পারে। কেননা সমাজ সর্বদা পরিবর্তনশীল ।
বর্তমানের প্রেক্ষাপট এক নাও হতে পারে। তাই বর্তমান ও ভবিষ্যতের পরিবর্তনের কথা বিবেচনা করেই অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা উচিত ।
2. বিশেষজ্ঞ কর্তৃক পরিকল্পনা প্রণয়ন : অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়ন একটি জটিল কাজ। সাধারণ মানুষের পক্ষে একটি অর্থনীতির সার্বিক দিক বিবেচনা করে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা সম্ভব নয়।
তাই উত্তম অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য বিশেষজ্ঞ কর্তৃপক্ষ থাকে। আর পরিকল্পনা প্রণয়ন বাস্তবায়নের দায়িত্ব ঐ কর্তৃপক্ষের ওপর ন্যস্ত থাকে। তাই বলা যায়, বিশেষজ্ঞ কর্তৃক পরিকল্পনার প্রণয়ন উত্তম পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ।
৩. সুশৃঙ্খল ও ধারাবাহিক হওয়া : কোনো একটি পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জিত হওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম পূর্বশর্ত হলো পরিকল্পনাটি সুশৃঙ্খল ও ধারাবাহিক হওয়া। পরিকল্পনা সুশৃঙ্খল ও ধারাবাহিক না হলে পরিকল্পনা কখনও সফল হয় না।
তাই পরিকল্পনার যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য পরিকল্পনাকে সুশৃঙ্খল ও ধারাবাহিক হওয়া বাঞ্ছনীয়। কেননা শৃঙ্খলতা ও ধারাবাহিকতা পরিকল্পনাকে পূর্ণতা দান করে।
৪. সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য : একটি উত্তম পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট। কেননা পরিকল্পনার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মধ্যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে একটি ধারণা সৃষ্টি হয় এবং তারা সেই লক্ষ্যার্জনের চেষ্টায় নিয়োজিত থাকে। তাই বলা যায়, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য উত্তম অর্থনৈতিক পরিকল্পনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
৫. নির্দিষ্ট সময়সূচি : একটি উত্তম পরিকল্পনা সাধারণত একটি নির্দিষ্ট সময়কালের জন্য প্রণীত হয়। পরিকল্পনা প্রণয়ন বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ কার্যসম্পাদন ও ফলাফল লাভ প্রভৃতি দিক বিবেচনা করে একটি পরিকল্পনার সময়সূচি নির্ধারণ করা হয়।
পরিকল্পনার বাস্তবায়নের সময়সূচি নির্দিষ্ট সময়ে কাজ সম্পাদনের তাগিদ দেয় বলে পরিকল্পনার বাস্তবায়ন দ্রুত হয়। তাই বলা যায়, একটি আদর্শ পরিকল্পনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো নির্দিষ্ট সময়সূচি।
৬. সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার : সকল প্রাকৃতিক ও মানবিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার উত্তম পরিকল্পনার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য । কোনো একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য তার সকল সম্পদের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন।
একটি আদর্শ অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় চরম মিতব্যয়িতার সাথে সকল সম্পদের সদ্ব্যবহার করা হয় বলে অপচয় হ্রাস পায় এবং উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
৭. বিভিন্ন শাখার সমন্বয়সাধন : একটি উত্তম পরিকল্পনার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো এখানে বিভিন্ন শাখার মধ্যে সমন্বয়সাধন করা হয়। একটি অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় অর্থনীতির বিভিন্ন শাখার মধ্যে সমন্বয়সাধন করা একান্ত প্রয়োজন। পরিকল্পনায় সমন্বয় সাধিত হলে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সহজসাধ্য হয় এবং পরিকল্পনায় সফলতা আসে।
৮. দায়িত্ব ও কর্তব্য বণ্টন : একটি উত্তম পরিকল্পনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো দায়িত্ব ও কর্তব্যের যথাযথ বণ্টন। উৎপাদন ব্যবস্থা বা প্রশাসনিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সুষ্ঠু শ্রমবিভাজন কেবলমাত্র সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমেই করা সম্ভব।
পরিকল্পনা বাস্তবায়ন একটি ধারাবাহিক ব্যবস্থা। এখানে কোথায় কার কতটুকু দায়িত্ব, কে কতটুকু কাজ করবে, কে কোন কাজ করবে সবকিছুই পরিকল্পনার মাধ্যমে নির্ধারিত হয়।
৯. উপযুক্ত পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া নির্ধারণ : একটি উত্তম পরিকল্পনায় লক্ষ্যার্জনের উদ্দেশ্য উপযুক্ত কার্য পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া নির্ধারণ করা হয়। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কাজ কীভাবে, কখন এবং কতটুকু সময়ের মধ্যে সম্পাদন করতে হবে তার ভিত্তিতে কার্যপদ্ধতি ও প্রক্রিয়া নির্ধারিত হয়ে থাকে।
১০. কর্মমুখী হওয়া : কর্মমুখিতা উত্তম পরিকল্পনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পরিকল্পনা মূলত কতিপয় উদ্দেশ্য ও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যার্জনের হাতিয়ার। কাজেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য পরিকল্পনা কর্মমুখী হওয়া আবশ্যক।
১১. গতিশীলতা : একটি উত্তম পরিকল্পনার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো এর গতিশীলতা। অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণীত হয় মূলত অর্থনৈতিক গতিশীলতা অর্জনের জন্য।
অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক গতিশীলতার দ্বার উন্মোচিত হয়। সেজন্য পরিকল্পনা গতিশীল হওয়া বাঞ্ছনীয়। -
১২. সর্বাধিক জনকল্যাণ : একটি উত্তম পরিকল্পিত ব্যবস্থার মাধ্যমেই কেবল সর্বাধিক জনকল্যাণ সম্ভব। দেশের মানুষের প্রয়োজন কী, কোথায় ত্রুটি রয়েছে, কীভাবে ত্রুটি দূর করা যায় প্রভৃতি বিষয় বিবেচনা করে পরিকল্পনা গৃহীত হলে সর্বাধিক জনকল্যাণ নিশ্চিত হয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, একটি উত্তম পরিকল্পনায় অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বস্তুত সীমিত সম্পদ ও সামর্থ্যের মাধ্যমে মানুষের চাহিদা ও অভাব পূরণ করে সর্বাধিক জনকল্যাণ করা অত্যন্ত জটিল কাজ।।
আর এসব কাজের জন্য দরকার উত্তম পরিকল্পনা। কেননা বিশেষজ্ঞদের প্রণীত উত্তম পরিকল্পনাই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের একমাত্র উপায় ।