পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সমস্যাসমূহ আলোচনা কর

পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সমস্যাসমূহ আলোচনা কর
পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সমস্যাসমূহ আলোচনা কর

পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সমস্যাসমূহ আলোচনা কর

  • অথবা, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সমস্যাসমূহ বর্ণনা কর।
  • অথবা, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সমস্যাসমূহ ব্যাখ্যা কর।

উত্তর : ভূমিকা : ভবিষ্যতে একটি লক্ষ্যার্জনের জন্য কী কী কাজ করতে হবে, কীভাবে, কোথায়, কখন এবং কত সময়ে এ কাজ শেষ করতে হবে ইত্যাদি সম্পর্কে অগ্রিম সিদ্ধান্ত গ্রহণের একটি প্রক্রিয়াই হচ্ছে পরিকল্পনা। 

চাইলে স্বল্প সময়ে ও খুব সহজে একটি আদর্শ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা যায় তবে সেটি বাস্তবায়ন করতে হলে নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। 

সরকারের সীমাবদ্ধতা, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, পরিকল্পনা প্রণয়নকারীর অদূরদর্শিতা ইত্যাদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে সমস্যা তৈরি করে।

পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সমস্যাসমূহ : নিম্নে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সমস্যাসমূহ আলোচনা করা হলো :

১. সঠিক পূর্বানুমানের সমস্যা : পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে মানুষ তার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ঠিক করতে পারে কিন্তু সদাসর্বদা তা পরিকল্পনামাফিক বাস্তবে পরিণত হয় না। কেননা ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত বলে ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা পূর্বে সঠিকভাবে অনুমান করা যায় না। 

পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় আর্থিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার মূল্যায়ন সবসময় সঠিকভাবে করা সম্ভব। হয় না। ফলে পরিকল্পনা তৈরিতে অনিশ্চিত বিষয়গুলো অসুবিধা সৃষ্টি করে ।

২. ঘটনার পৌনঃপুনিকতার অভার : পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে পরিকল্পনা, বিশেষ করে স্থায়ী পরিকল্পনা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে না। 

যেমন- যে বছর বন্যা, খরা, জলাবদ্ধতা, নদী ভাঙন, বজ্রপাত কিংবা ডেঙ্গু মশার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয় তখন সাময়িকভাবে তা নিয়ন্ত্রণের জন্য পরিকল্পনা করা হয়। 

সাময়িক সমাধান হয়ে গেলে পরিকল্পনার পরবর্তী পদক্ষেপ থেমে যায়। এতে করে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সফল হয় না।

৩. অধিক ব্যয়সাধ্য : পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন প্রকার তথ্য সংগ্রহ করতে হয়। এছাড়া সংশ্লিষ্ট সবার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা, পরিকল্পনার খসড়া তৈরি করা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ইত্যাদি কাজের জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। 

রাষ্ট্রীয় কিছু কিছু পরিকল্পনার জন্য বিদেশি পরামর্শক নিয়ে আসা হয়। অনেক ক্ষেত্রে একাধিকবার পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হয়। 

এর ফলে প্রকল্পের বেশিরভাগ অর্থ পরিকল্পনার পিছনে ব্যয় হয়ে যায় এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়। 

৪. অপ্রাসঙ্গিক লক্ষ্য নির্ধারণ : প্রতিষ্ঠানের সাথে সংগতিপূর্ণ নয় এমন লক্ষ্য নির্ধারণ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে আরেকটি বাধা। সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছাতে না পারলে প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা তাদের মনোবল হারিয়ে ফেলে। যা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে একটি বড় সমস্যা।

৫. সময়সাপেক্ষ : প্রয়োজনীয় সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই অনেক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। প্রকল্প দলিলে অনেক সময় খাতভিত্তিক ব্যয়ের পরিকল্পনা থাকে না। 

এর ফলে অনেক সময় নির্দিষ্ট সময়ে ব্যয়ের সীমারেখা মেনে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায় না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ব্যস্ততাজনিত কারণে অধিক সময় দিতে না পারলে পরিকল্পনা কার্যক্রম ব্যাহত হতে বাধ্য। 

৬. ভূমি অধিগ্রহণে সমস্যা : যেকোনো অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের কাজ হয় বিলম্বে। আবার অনেক সময় ভূমি অধিগ্রহণে বাড়তি সময় দরকার হয় মামলার কারণে। 

যেমন— ২০১০ সালে প্রায় পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে মুন্সিগঞ্জের আড়িয়াল বিলে পঁচিশ হাজার একর জমির ওপর নতুন বিমানবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। 

কিছু স্থানীয় জনগণের বিক্ষোভ ও প্রতিরোধের কারণে ভূমি অধিগ্রহণ বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং পরিকল্পনা স্থগিত করা হয়। 

৭. দ্রুত পরিবর্তনশীলতা : দ্রুত পরিবর্তনশীলতার কারণে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সমস্যা সৃষ্টি হয়। যেমন— একসময়ে বাংলাদেশ ডাকবিভাগের অনেক গুরুত্ব ছিল। ডাকবিভাগকে ঘিরে সরকারের অনেক পরিকল্পনাও ছিল। 

কিন্তু মোবাইল, ইন্টারনেট, ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগে এসে ডাকবিভাগের গুরুত্ব কমেছে, পাশাপাশি পরিকল্পনায়ও অনেক পরিবর্তন আনতে হয়েছে।

৮. সংশোধনে সমস্যা : পরিকল্পনা প্রণয়নে অনেক ক্ষেত্রেই ত্রুটিবিচ্যুতি হয়ে থাকে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, ঘটনাবলি বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নজনিত সমস্যা, তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতার অভাব ইত্যাদি কারণে পরিকল্পনার সঠিক সংশোধন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। ফলে পরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়নও সম্ভব হয় না।

৯. মনস্তাত্ত্বিক প্রতিরোধ : প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিক-কর্মী পুরাতন ও প্রচলিত ধ্যানধারণা ও চিন্তাচেতনায় অভ্যস্ত এবং তা ধরে রাখতেই বেশি উৎসাহী। 

তারা নতুন চিন্তাধারার আলোকে প্রণীত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে অনীহা প্রকাশ করে যা উত্তম পরিকল্পনা বাস্তবায়নে একটি বড় বাধা।

১০. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা : যেকোনো দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিঘ্নের সৃষ্টি করে। এছাড়া দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অবস্থার দ্বারাও পরিকল্পনা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয় ।

১১. রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তন : ক্ষমতায় থাকাকালীন একটি দল যেসব পরিকল্পনা প্রণয়ন করে ক্ষমতার পালাবদলে অন্য দল ক্ষমতায় আসলে পূর্বে নেওয়া অনেক পরিকল্পনা বাতিল করে দেয়। এর ফলে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বাধার সম্মুখীন হয়। 

যেমন— ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে লবণাক্ত পানির ক্ষতিকর প্রভাব এড়াতে আওয়ামী লীগ সরকার গড়াই নদী খননের যে প্রকল্প হাতে নিয়েছিল, ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে সেই প্রকল্প বন্ধ করে দিয়েছিল ।

১২. পরিবর্তনে অনীহা : নতুন দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয় বিধায় প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তাগণ অনেকেই পরিকল্পনার পরিবর্তনে আগ্রহী হন না । ফলে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিভিন্ন প্রকার সমস্যা দেখা দেয় ।

১৩. শ্রমিকসংঘ : শ্রমিকসংঘ অনেক ক্ষেত্রে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নে বাধার সৃষ্টি করে । শ্রমিকদের মজুরি, তাদের কাজের শর্ত এবং বিভিন্ন দাবিদাওয়ার প্রেক্ষিতে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অনেক ক্ষেত্রে কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। 

উল্লিখিত বিষয়গুলো ছাড়া আরও কিছু বিষয় রয়েছে যা পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে । 

এদের মধ্যে দেশের শিল্পনীতি ও বাণিজ্য নীতি, দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ সমস্যা, উদ্যোগ গ্রহণে বাধা ইত্যাদির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায় । 

উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সমস্যাসমূহ দূর করতে না পারলে পরিকল্পনা শুধু কাগজে-কলমেই পড়ে থাকবে। 

বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে এমন অসংখ্য পরিকল্পনা রয়েছে যা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সমস্যার সম্মুখীন হয়ে শুরুতে অথবা মাঝপথে থেমে গিয়েছে। 

বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার ক্ষেত্রেও এরূপ পরিস্থিতি দেখা যায়। একটি পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে উপরে বর্ণিত সমস্যাসমূহের অবশ্যই সমাধান করতে হবে এবং এসব সমস্যা বিবেচনায় রেখে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ