বিকেন্দ্রীকরণের সুবিধা ও অসুবিধা গুলি আলোচনা করো
বিকেন্দ্রীকরণের সুবিধা ও অসুবিধা গুলি আলোচনা করো |
বিকেন্দ্রীকরণের সুবিধা ও অসুবিধা গুলি আলোচনা করো
- অথবা, বিকেন্দ্রীকরণের সুবিধা ও অসুবিধা আলোচনা কর।
- অথবা, বিকেন্দ্রীকরণের সুবিধা ও অসুবিধাসমূহ আলোচনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : আধুনিক রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক ও জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র। পূর্বের তুলনায় বর্তমানে রাষ্ট্রের কার্যাবলির পরিধি ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে।
এ ব্যাপক ও বহুমুখী কার্যাবলি সুষ্ঠু ও যথাসময়ে সম্পাদন করা কেন্দ্রীয় সরকারের একার পক্ষে সম্ভব না। তাই এসব কার্যাবলি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন ও জনকল্যাণমুখী কাজে গণতন্ত্রের চর্চা নিশ্চিত করতে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন।
মূলত দেশের সার্বিক উন্নয়নে ক্ষমতা ও প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন। বিকেন্দ্রীকরণের অনেক সুবিধা রয়েছে।
প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ/বিকেন্দ্রীকরণের সুবিধা : একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নে বিকেন্দ্রীকরণের পুরুত্ব অনেক। নিম্নে বিকেন্দ্রীকরণের সুবিধাসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. আমলাদের ক্ষমতা হ্রাস : প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের ফলে আমলাদের একচেটিয়া ক্ষমতা হ্রাস হয়। বিকেন্দ্রীকরণের ফলে প্রশাসন জনগণের হাতের নাগালে চলে আসে।
প্রশাসনের সাথে জনগণের একপ্রকার মিথস্ক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ফলে জনগণকে আর আমলাদের ওপর নির্ভর করে থাকতে হয় না।
২. সুদক্ষ প্রশাসন ব্যবস্থা : কেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক ব্যবস্থায় সব কাজ কেন্দ্র সম্পাদন করতে পারে না। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের ফলে এ কাজ প্রশাসনের বিভিজ্ঞ স্তরে ভাগ হয়ে যায়। এর ফলে প্রশাসন আগের চেয়ে সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে পারে এবং প্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধি পায় ।
৩. কার্যভার লাঘব : প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের অতিরিক্ত কাজ বিভিন্ন আঞ্চলিক অফিসে স্থানান্তর করা হয়। এর ফলে কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের কার্যভার লাঘব হয় এবং সুসম উন্নয়ন নিশ্চিত হয়।
৪. গণতন্ত্রের প্রসার : ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের ফলে গণতন্ত্রের প্রসার হয়। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের ফলে প্রশাসনের সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী দ্বারা একটি কার্য সম্পাদিত হয়। এর ফলে সবাই তাদের নিজেদের মতামত প্রকাশ ও অংশগ্রহণের সুযোগ পায়।
এর ফলে গণতন্ত্রের নিশ্চয়তা তৈরি হয়। এছাড়া সবার মতামত দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। তাই গণতন্ত্রের চর্চায় প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের বিকল্প নেই।
৫. সহযোগিতা স্থাপন : প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের ফলে কেন্দ্রীয় প্রশাসন ও আলিক প্রশাসনের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হয় । কেন্দ্র থেকে আঞ্চলিক পর্যায়ে এবং আঞ্চলিক পর্যায় হতে কেন্দ্রে সর্বদা তথ্য-উপাত্ত আদানপ্রদান হয়।
এর ফলে উভয় প্রশাসনের মধ্যে সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়। এছাড়া আঞ্চলিক প্রশাসনগুলো কেন্দ্রের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের লক্ষ্যে কেন্দ্র ও আঞ্চলিক প্রশাসনের মধ্যবর্তী প্রশাসনের সাথেও যোগাযোগ স্থাপন করে। ফলে প্রশাসনের সাথে আঞ্চলিক প্রশাসনের আন্তঃসম্পর্ক বৃদ্ধি পায়।
৫. বাস্তবমুখী উন্নয়ন : কেন্দ্রীয় প্রশাসনের পক্ষে স্থানীয় পর্যায়ের বাস্তবমুখী উন্নয়ন সম্ভব না। কারণ স্থানীয় এলাকা সম্পর্কে কেন্দ্রের নিকট প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত থাকে না।
প্রশাসনিক "বিকেন্দ্রীকরণের ফলে আঞ্চলিক প্রশাসনগুলো স্থানীয় পর্যায়ে চাহিদা ও অভাব অনুযায়ী উন্নয়ন করতে পারে। ফলে দেশে একটি বাস্তবমুখী উন্নয়ন সম্ভব হয় ।
৭. লাল ফিতার দৌরাত্ম্য নিরসন : প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের ফলে কর্ম বিভাজন সৃষ্টি হয়। তাই যেকোনো কাজ অল্প সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা যায়।
একজন কর্মকর্তার টেবিলে কাজের ফাইল স্তূপাকারে থাকে না। তাই প্রশাসনিক কাজের ক্ষেত্রে লাল ফিতার দৌরাত্ম্য দূর করা যায়।
৮. গতিশীলতা আনয়ন : প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের ফলে একটি নির্দিষ্ট আইনের ভিত্তিতে কার্যাবলি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হতে অধস্তন কর্মকর্তার নিকট পৌঁছে যায়। সবাই যার যার দায়িত্বটুকু সম্পাদন করে। ফলে প্রশাসনিক গতিশীলতা আসে ।
৯. কর্মচারীদের মনোবল বৃদ্ধি : প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের ফলে আইনানুগভাবে কার্যাবলি ঊর্ধ্বতন পর্যায় হতে অধস্তন পর্যায়ে বণ্টিত হয়। এর ফলে অধস্তন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কার্যক্ষমতা ও মনোবল বৃদ্ধি পায় । এতে প্রশাসনের কাজের মান বৃদ্ধি পায়।
১০. বিচারব্যবস্থার উন্নয়ন : প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের ফলে বিচারব্যবস্থার উন্নতি ঘটে। আঞ্চলিক প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তা- কর্মচারীর পক্ষে কোনো বিচার চাওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আসার সুযোগ থাকে না। কিন্তু বিকেন্দ্রীকরণের ফলে একজন বিচারপ্রার্থী তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছ থেকে বিচার পেতে পারে।
১১. বিবিধ : প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের আলোচ্য সুবিধা ছাড়াও আরও অনেক সুবিধা রয়েছে। যেমন— কাজের গুণগতমান বৃদ্ধি, জবাবদিহিতা, অবকাঠামো উন্নয়ন, দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সৃজনশীল প্রশাসন, অভ্যন্তরীণ সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ইত্যাদি।
প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের অসুবিধা : বিকেন্দ্রীকরণ প্রশাসনিক কার্যাবলিতে সবার মতামত প্রদান করার সুযোগ করে দেয় যা পণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা রাখে।
কিন্তু ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণেও অনেক অসুবিধা রয়েছে। নিম্নে বিকেন্দ্রীকরণের অসুবিধাসমূহ আলোচনা করা হে
১. অতিমাত্রায় গণতন্ত্র : গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে জনপ্রিয় শাসনব্যবস্থা হলেও এটি অনেক ক্ষেত্রে শাসনব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করে। প্রশাসনে অহেতুক জনগণের হস্তক্ষেপের জন্য প্রশাসন তার স্বকীয়তা হারায় এবং একটি বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
২. ক্ষমতার অপব্যবহার : ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের ফলে শাসন ও প্রশাসনের ক্ষমতা সব স্তরে ভাগ করে দেওয়া হয়। ফলে অনেকেই ক্ষমতা লাভ করে।
এর ফলে ক্ষমতার অপব্যবহার বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকে । উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশে শাসনতান্ত্রিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতির চিত্র ক্ষমতার অপব্যবহার প্রমাণ করে।
৩. জরুরি সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধা : প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বিকেন্দ্রীকরণের ফলে একটি কাজের সিদ্ধান্ত নিতে অনেকগুলো পর্যায় পার হতে হয়।
ফলে জরুরি কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধা সৃষ্টি হয়। জরুরি সিদ্ধান্ত গ্রহণে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের কোনো বিকল্প নেই।
৪. সমন্বয় ও ঐক্যের অভাব : প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের ফলে প্রশাসনের আকৃতি বিশালাকার ধারণ করে। ফলে এ বিশালাকার প্রশাসনে সমন্বয়সাধন করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। এছাড়া এ বিশালাকার প্রশাসনে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ঐবন তৈরি হওয়া অসম্ভব।
৫. দক্ষ নেতৃত্বের অভাব : ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের বিকেন্দ্রীকরণের জন্য সব পর্যায়ে দক্ষ ও যোগ্য নেতৃত্বের প্রয়োজন। কিন্তু সব পর্যায়েই যোগ্য ও দক্ষ নেতৃত্ব পাওয়া অসম্ভব। ফলে দক্ষ ও যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে প্রশাসন ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে যেতে পারে।
৬. বায়বহুল প্রশাসন : প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়াটি একটি ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া। তাই অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের জন্য প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ হিতে বিপরীত ফলাফল নিয়ে আসে।
৭. সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি : প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের ফলে প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভিতরে সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পায়। কারণ তারা তখন জাতীয় স্বার্থের কথা চিন্তা না করে আঞ্চলিক বা স্থানীয় স্বার্থকে বড় করে দেখে। এ সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে প্রশাসনিক ব্যবস্থা দুর্বল ও অকার্যকর হয়ে যেতে পারে
৮. নিয়মনীতি ও পদ্ধতির ভিন্নতা : প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের তার বিভিন্ন ব্যক্তির নিকট অর্পিত হয়। কিন্তু বিভিন্ন ব্যক্তি একই কাজ বিভিন্ন নিয়ম ও পদ্ধতিতে করতে চায় বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াটি বাধাগ্রস্ত হয়, যা প্রশাসনিক স্থবিরতা নিয়ে আসে।
৯. স্বজনপ্রীতি : কেন্দ্রীয় প্রশাসন থেকে সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে স্বজনপ্রীতির আশঙ্কা অনেক কম থাকে। কিন্তু ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের ফলে স্বজনপ্রীতি বেড়ে যায়। একই প্রক্রিয়ায় দুর্নীতিও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
১০. প্রভাবশালী গোষ্ঠীর উত্থান : ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের ফলে আঞ্চলিক পর্যায়ে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উত্থান হয়, যারা প্রশাসনকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে তৎপর থাকে ।
১১. বিচারের নামে প্রহসন : বিকেন্দ্রীকরণের ফলে আঞ্চলিক বা স্থানীয় প্রশাসন বিচার করার অধিকার লাভ করে। এর ফলে অনেক সময় বিচারের নামে অবিচার দেখা যায়।
উপসংহার : উপযুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের ফলে প্রশাসন বিশাল আকার ধারণ করে।
তবে সব ব্যবস্থায় সুবিধা অসুবিধা থাকবে এটিই স্বাভাবিক বিকেন্দ্রীকরণের এসব অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণই কাম্য।
তাই অসুবিধাগুলো দূর করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। আর তাহলেই আমরা প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের সুবিধা ভোগ করতে পারব।