ইংল্যান্ডের বর্তমান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিসমূহ আলোচনা কর
ইংল্যান্ডের বর্তমান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিসমূহ আলোচনা কর
প্রশ্ন ২.২৩ | ইংল্যান্ডের বর্তমান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, ইংল্যান্ডে বর্তমান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো বর্ণনা কর ।
উত্তর ভূমিকা : বর্তমান বিশ্বের অন্যতম কল্যাণ রাষ্ট্র ইংল্যান্ড । ইংল্যান্ড কল্যাণ রাষ্ট্রের মর্যাদা অর্জন করতে পেরেছে তার এ ব্যাপক বিস্তৃত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি গ্রহণের কারণে। ইংল্যান্ডের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির প্রাণ বা মেরুদণ্ড বলা হয় বিভারিজ রিপোর্টকে।
বিভারিজ রিপোর্টের সুপারিশের ভিত্তিতে ইংল্যান্ডের বর্তমান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অধিকাংশ গ্রহণ করা হয়। ইংল্যান্ডের বর্তমান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে নাগরিকদের জন্য শিক্ষা, চিকিৎসা, স্বাস্থ্য, বিনোদন এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে নগদ অর্থ প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে।
ইংল্যান্ডের বর্তমান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিসমূহ আলোচনা কর |
● ইংল্যান্ডের বর্তমান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি : নিম্নে ইংল্যান্ডের বর্তমান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো আলোচনা করা হলো-
১. সরকারি সাহায্য কার্যক্রম : ইংল্যান্ডের বর্তমান সামাজিক নিরাপত্তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হচ্ছে সরকারি সাহায্য কার্যক্রম। ১৯৪৮ সালের জাতীয় সাহায্য আইনের মাধ্যমে বিমা সুবিধার বহির্ভূত জনগণের জন্য বিভিন্ন ধরনের কল্যাণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়'। সরকারি সাহায্য কর্মসূচির মাধ্যমে অক্ষম, নির্ভরশীল ব্যক্তিরা তাদের জীবনযাপনের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ সাহায্য পেত। সরকারি সাহায্য কার্যক্রম জাতীয় দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালিত করতো। কিন্তু পরবর্তীতে সময়ের চাহিদা পূরণে বিদ্যমান কর্মসূচি অপর্যাপ্ত হওয়ায় ১৯৬৫ সালের সম্পূরক সুবিধা চালু করা হয়। সম্পূরক সুবিধার আওতায় দুর্বল ও অসচ্ছল পরিবারকে আয় সম্পূরক ভাতা প্রদান করা হতো। পরবর্তী সময়ে ১৯৮৬-৮৭ সালের দিকে সরকারি সাহায্যের পরিমাণ ও পরিধি বাড়ানো হয় ।
২. পারিবারিক ভাতা ও শিশু ভাতা : ইংল্যান্ডের বর্তমান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি হচ্ছে পারিবারিক ভাতা ও শিশু ভাতা। ইংল্যান্ডের বর্তমান সামাজিক নিরাপত্তামূলক এ কর্মসূচিটি বিভারিজ রিপোর্টের সুপারিশের ভিত্তিতে গ্রহণ করা হয়।
শুরুর দিকে পারিবারিক ভাতার আওতায় প্রথম সন্তানের পরবর্তী সব সন্তান ১৬ বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ৯০ পেন্স করে ভাতা দেওয়া হতো। এ ভাতার আওতায় শিক্ষার্থী ও প্রশিক্ষণার্থীরা নগদ টাকা পেতেন।
পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালে পারিবারিক ভাতার নাম পরিবর্তন করে শিশু ভাতা করা হয় এবং নতুন নিয়ম অনুযায়ী পরিবারের সব সন্তানের জন্য এ ভাতা উন্মুক্ত করা হয়। বর্তমানে এ ভাতার আওতায় শিশুদের লালনপালন, শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য নগদ অর্থ প্রদান করা হয় ।
৩. অক্ষমতাজনিত জীবনভাতা : ইংল্যান্ডের বর্তমান সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় অক্ষম ও নির্ভরশীলদের ভরণপোষণের জন্য অক্ষমতাজনিত জীবনভাতা প্রচলিত আছে। অক্ষমদের কল্যাণের জন্য ১৯৮৬ সালে প্রণয়ন করা হয় 'Disabled Person Act বা অক্ষম ব্যক্তি আইন।
পরবর্তীতে অক্ষম ব্যক্তিদের আরও অধিক সুবিধা প্রদানের জন্য প্রণয়ন করা হয় ১৯৯৫ সালের অক্ষমতা বৈষম্য আইন। এ আইনের মাধ্যমে ইংল্যান্ডের অক্ষম জনগণের জন্য শিক্ষা, চিকিৎসা ও পুনর্বাসনমূলক সেবা প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৯২ সালে এর সাথে যোগ করা হয় হাজিরা ভাতা ও মোবিলিটি ভাতা।
৪. চাকরি সন্ধান ভাতা : ইংল্যান্ডের বর্তমান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি হচ্ছে চাকরি ভাতা। বর্তমান চাকরির সন্ধান ভাতার আওতায় যারা সাপ্তাহিক ১৬ ঘণ্টার কম কাজ করে বা কাজ খুঁজে পাচ্ছে না তাদের এ ভাতা প্রদান করা হয় ।
৫. মাতৃত্ব সুবিধা : ইংল্যান্ডের মাতৃত্ব সুবিধার আওতায় ৪ সপ্তাহের জন্য সাপ্তাহিক ভাতা বা ১৮ সপ্তাহের মাতৃত্ব ভাতা দেওয়া হয়। এ কর্মসূচির আওতায় স্বামীর মৃত্যু হলে বিধবা স্ত্রীকে ৩০ সপ্তাহের সামঞ্জস্য ভাতা দেওয়া হয়। নির্ভরশীল শিশুরা এ ব্যবস্থার আওতায় অভিভাবক ভাতা পেয়ে থাকেন ।
৬. মানসিক স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সেবা : ইংল্যান্ডে সামাজিক নিরাপত্তার এ কর্মসূচির আওতায় মানসিক রোগীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এ লক্ষ্যে ১৯৫৯ সালে প্রণয়ন করা মানসিক স্বাস্থ্য আইন। ১৯৮২ ও ১৯৯১ সালে সংশোধন ও আধুনিকায়ন করা হয়।
ইংল্যান্ডের নাগরিকদের মানসিকভাবে সুস্থ ও সক্ষম থেকে সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য চিকিৎসাসেবা, চিকিৎসা ভাতা ও হাসপাতালে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয় ।
৭. সামাজিক বিমার কর্মসূচি : ইংল্যান্ডের বর্তমান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মূল হচ্ছে সামাজিক বিমা কর্মসূচি। সামাজিক বিমায় অবদানের ভিত্তিতে নির্ধারিত সব নাগরিকের ভরণপোষণের পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। বিমা কর্মসূচির আওতায় ইংল্যান্ডে বিদ্যমান কার্যক্রমের অন্যতম হচ্ছে শ্রমিক ক্ষতিপূরণ, বেকারত্ব বিমা, স্বাস্থ্য বিমা, অক্ষমতা বিমা, শ্রমিক ক্ষতিপূরণ, বিবাহ, জন্ম মৃত্যু ইত্যাদি সময়ে নগদ অনুদান ইত্যাদি।
৮. কিশোর-কিশোরীদের ভরণপোষণ : ইংল্যান্ডের বর্তমান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অন্যতম হচ্ছে কিশোর- কিশোরীদের ভরণপোষণের জন্য বিস্তারিত কার্যক্রম গ্রহণ করা। শিশু, কিশোর- কিশোরীদের অপরাধমূলক আচরণ সংশোধন ও নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৮৯ সালে শিশু আইন প্রণয়ন করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে এ আইনের আধুনিকায়ন করে শিশুদের রক্ষণাবেক্ষণের যাবতীয় দায়িত্ব গ্রহণ করা হয়, যা এখনো বিদ্যমান আছে।
৯. স্বাস্থ্যসংক্রান্ত কর্মসূচি : ইংল্যান্ডের বহুমুখী সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অন্যতম হচ্ছে জনস্বাস্থ্যসংক্রান্ত কার্যক্রম। ১৯৪৬ সালের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা আইনের আওতায় ইংল্যান্ডের সব জনগণের জন্য ব্যাপক ও বিস্তৃত জনস্বাস্থ্যসংক্রান্ত কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। এর আওতায় জনগণের বিনা মূল্যে রোগ নির্ণয়, স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও ওষুধ সরবরাহ করা হয়।
১০. অসুস্থতা ভাতা : ইংল্যান্ডের বর্তমান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হচ্ছে অসুস্থতা ভাতা। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে অসুস্থতার ৪র্থ দিন থেকে ৫৯.৫৫ পাউন্ড করে অসুস্থতা ভাতা প্রদান করা হয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ইংল্যান্ডের বর্তমান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ব্যাপক বিস্তৃত ও সুদূরপ্রসারী। এ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ইংল্যান্ডের সব নাগরিকের ভরণপোষণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রয়েছে। ইংল্যান্ডের বর্তমান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মূলভিত্তি হচ্ছে বিভারিজ রিপোর্ট।
বিভারিজ রিপোর্টই ইংল্যান্ডের বর্তমান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মূল কাঠামো দান করেছে। বহুমুখী সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণেই ইংল্যান্ড আজ বিশ্বের অন্যতম কল্যাণ রাষ্ট্র ।