সমাজসংস্কারে রাজা রামমোহন রায়রে অবদান মূল্যায়ন কর

রাজা রামমোহন রায়ের পরিচয় দাও? সমাজসংস্কারে রাজা রামমোহন রায়রে অবদান মূল্যায়ন কর 

প্রশ্ন ৩.০১ | রাজা রামমোহন রায়ের পরিচয় দাও? সমাজসংস্কারে রাজা রামমোহন রায়রে অবদান মূল্যায়ন কর ।

অথবা, সমাজসংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান বর্ণনা কর।

উত্তর ভূমিকা : রাজা রামমোহন রায় সমাজসংস্কার আন্দোলনের অগ্রদূত । উনিশ শতকের শিল্প, সাহিত্য, ধর্ম ও সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে বাংলায় যারা অসামান্য অবদান রাখেন তাদের মধ্যে রাজা রামমোহন রায় অন্যতম। রাজা রামমোহন রায় সমাজসংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতির মধ্যে নবজাগরণের সৃষ্টি করেন। এজন্য বাংলায় তাকে সমাজসংস্কারের জনক বলা হয় । 

রাজা রামমোহন রায়ের পরিচয় দাও সমাজসংস্কারে রাজা রামমোহন রায়রে অবদান মূল্যায়ন কর
রাজা রামমোহন রায়ের পরিচয় দাও সমাজসংস্কারে রাজা রামমোহন রায়রে অবদান মূল্যায়ন কর 

● রাজা রামমোহন রায়ের পরিচয় : রাজা রামমোহন রায় ১৭৭২ সালের ২ নভেম্বর ভারতের হুগলি জেলার রাধানগর গ্রামে এক রক্ষণশীল হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই রাজা রামমোহন রায় অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। তিনি বিভিন্ন ধর্মের বই পড়াশুনা করতেন এবং আরবি, ফারসি ও ইংরেজি ভাষায় পড়াশুনা করে তিনি প্রগতিশীল চিন্তার অধিকারী হন। রাজা রামমোহন রায় তাঁর নিজ গ্রামেই প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি পাটনায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য গমন করেন। শিক্ষাজীবন শেষে তিনি ব্রিটিশ সরকারের সেরেস্তাদারের চাকরি নেন।

১৮১৫ সাল থেকে তিনি স্থায়ীভাবে কলকাতায় বসবাস করা শুরু করেন। ব্যক্তিগত জীবনে রাজা রামমোহন রায় একজন উদারমনা ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামির প্রতিবাদে ১৮০৩-০৪ সালে 'তুহফাত-উল-মুয়াহিদ্দীন' (একেশ্বরবাদীদের উপহার) নামে বই প্রকাশ করেন। ১৮২১ সালে রাজা রামমোহন রায় তাঁর মতবাদ প্রচারের জন্য 'সংবাদ কৌমুদী' নামক পত্রিকা প্রকাশ করেন । ১৮২২ সালে রাজা রামমোহন রায় "মীরাত-উল- আখবার' (খবরের আয়না) নামক আরেকটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৮৩৩ সালে রাজা রামমোহন রায় মৃত্যুবরণ করেন

সমাজসংস্কারে রাজা রামমোহন রায়রে অবদান : নিম্নে সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান দেওয়া হলো- 

১. সতীদাহ প্রথা রোধ : রাজা রামমোহন রায়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সমাজসংস্কারমূলক কাজ হলো সতীদাহ প্রথা রোধ। তখনকার সময়ে কোনো স্ত্রীর স্বামী মারা গেলে স্ত্রীকেও স্বামীর সাথে একই চিতায় দাহ করা হতো। এ প্রথাকে বলা হতো সতীদাহ প্রথা। রাজা রামমোহন রায় এ জঘন্য প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। অবশেষে তাঁর প্রচেষ্টায় ১৮২৯ সালে সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ আইন পাস হয়।

২. নারীমুক্তি : তৎকালীন নারীরা ছিল পারিবারিক ও সামাজিকভাবে অবহেলিত । রাজা রামমোহন রায় ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করে ঘোষণা করেন যে, নারীনির্যাতন শাস্ত্র বিরোধী। এছাড়াও অন্যান্য ক্ষেত্রে নারীসমাজকে মুক্তি দেওয়ার মাধ্যমে তিনি বাংলার নবজাগরণকে ত্বরান্বিত করেন।

৩. বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ রোধ : তৎকালীন সমাজে বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ প্রচলিত ছিল। যা ছিল এদেশের নবজাগরণের পথে অন্তরায় । রাজা রামমোহন রায় বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের বিরোধী আন্দোলন শুরু করলে বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ সমাজ থেকে অনেকাংশে হ্রাস পায় এবং বাংলার নবজাগরণের পথ সুগম হয় । 

৪. জাতিভেদ ও কৌলীন্য প্রথার বিরোধিতা : তৎকালীন ভারতবর্ষে বিশেষ করে হিন্দুসমাজে জাতিভেদ ও কৌলীন্য প্রথা প্রচলিত ছিল এবং এটি ছিল এদেশের নবজাগরণের ক্ষেত্রে অন্যতম অন্তরায়। রাজা রামমোহন রায়ের প্রচেষ্টায় সমাজ থেকে জাতিভেদ ও কৌলীন্য প্রথা অনেকাংশে হ্রাস পায়। এর মাধ্যমে যেমন সামাজিক সমতা ফিরে আসে তেমনি নবজাগরণের পথ প্রসারিত হয় ।

৫. ধর্মীয় সংস্কার ক্ষেত্রে : রাজা রামমোহন রায় ১৮০৩-০৪ সালে একেশ্বরবাদীদের প্রতি উপহার ও মানজারাতুল আধিয়ান' (বিভিন্ন ধর্মের ওপর আলোচনা) নামক ধর্মীয় গ্রন্থ প্রকাশ করেন যা ধর্মীয় সংস্কারে অশেষ অবদান রাখে। এছাড়াও ধর্মীয় কুসংস্কার দূরীকরণের জন্য তিনি 'আত্মীয় সভা' গঠন করেন । 

৬. শিক্ষাক্ষেত্রে : শিক্ষাবিস্তারের মাধ্যমেও রাজা রামমোহন রায় বাংলার নবজাগরণে অংশ নেন। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় 'অ্যাংলো হিন্দু স্কুল' প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়াও তিনি ১৮২৬ সালে 'বেদান্ত কলেজ' স্থাপন করেন। রাজা রামমোহন রায় বেশ কয়েকটি ইংরেজি স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেন ।

৭. রাজনৈতিক চেতনা সৃষ্টি : রাজা রামমোহন রায় ১৮২১ সালে ‘সংবাদ কৌমুদী' ও ১৮২২ সালে ‘মীরাত-উল-আখবার' নামে পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে জনগণকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তোলেন । এসব প্রকাশনায় লেখনীর মাধ্যমে তিনি বাংলার নবজাগরণে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখেন।

৮. নাগরিক অধিকার আদায় : বাংলার নবজাগরণের অগ্রদূত রাজা রামমোহন রায় ছিলেন নাগরিক অধিকার আদায়ে অত্যন্ত সোচ্চার। তৎকালীন জমিদারদের অত্যাচার থেকে কৃষকসমাজকে রক্ষা করার জন্য এবং তাদের অধিকার আদায়ের জন্য তিনি আন্দোলন করেছিলেন। তিনি মানুষের অধিকার আদায়ে শুধু সামাজিকভাবেই আন্দোলন করেননি; বরং তিনি এদেশীয় মানুষের দাবিদাওয়া ব্রিটিশ পার্লামেন্টে তুলে ধরেন। এছাড়াও ভারতীয়দের সরকারি উচ্চপদে নিয়োগের জন্যও তিনি দাবি জানান। তার এসব কর্মকাণ্ডের ফলে মানুষ সচেতন হয়, যার মাধ্যমে বাংলার নবজাগরণ ত্বরান্বিত হয়।

উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, রাজা রামমোহন রায় ভারতীয় উপমহাদেশের নবজাগরণ আন্দোলন আকাশের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। তৎকালীন এদেশের সমাজব্যবস্থা ছিল ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারে আচ্ছন্ন এবং মানুষের জীবন ছিল গোঁড়ামিতায় ভরপুর। রাজা রামমোহন রায় বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়ন করে বুদ্ধি, বিবেচনা, অগাধ পাণ্ডিত্য লাভ করেন এবং এদেশের নবজাগরণের জন্য তাঁর জীবনকে নিয়োজিত করেন।


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ