সংক্ষেপে বাংলাদেশে সমাজকর্মের বিবর্তন ইতিহাস আলোচনা কর
সংক্ষেপে বাংলাদেশে সমাজকর্মের বিবর্তন ইতিহাস আলোচনা কর
প্রশ্ন ২.৩৯ | বাংলাদেশে সমাজকর্মের উদ্ভব ও বিকাশের বিবরণ দাও ।
অথবা, সংক্ষেপে বাংলাদেশে সমাজকর্মের বিবর্তন ইতিহাস আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশে সমাজকর্মের উদ্ভব ও বিকাশ আলোচনা কর ।
উত্তর ভূমিকা : দানশীলতা দিয়ে সমাজকর্মের সূচনা ঘটলেও কালের পরিক্রমায় সমাজকর্ম আজ একটি স্বীকৃত পেশা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষিতে সময়ের দাবিতে, প্রয়োজন পূরণের নিরিখে সমাজকর্ম তার সম্পূর্ণ পেশাগত অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। দানশীলতাভিত্তিক সমাজসেবা কার্যক্রম দ্রুত শিল্পায়ন ও শহরায়নের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অপর্যাপ্ত বিবেচিত হয়। তাই অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পরিবর্তনশীল সমাজের চাহিদার সাথে সংগতি রেখে সমাজকর্মের পর্যায়ক্রমিক বিকাশ সাধিত হয়
সংক্ষেপে বাংলাদেশে সমাজকর্মের বিবর্তন ইতিহাস আলোচনা কর |
বাংলাদেশে সমাজকর্ম শিক্ষা ও সমাজকর্মের বিকাশ : আমাদের দেশে প্রাতিষ্ঠানিক সমাজকর্মের গোড়াপত্তন হয় ভারত বিভক্তির পর থেকে অর্থাৎ পঞ্চাশের দশক থেকে। নিম্নে বাংলাদেশে সমাজকর্ম শিক্ষা ও সমাজকর্মের বিকাশ আলোচনা করা হলো—
১. জাতিসংঘের সাহায্য কামনা : ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে উদ্ভূত সামাজিক সমস্যা মোকাবিলায় এদেশে পেশাদার সমাজকর্মের যাত্রা শুরু হয়। দেশ বিভক্তির পর এদেশে আর্থসামাজিক সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করলে পাকিস্তান সরকার জাতিসংঘের সাহায্য কামনা করে।
২. জাতিসংঘের কার্যক্রম : ১৯৫২ সালে মুহাজের সমস্যা সমাধানে Dr. James Dumpson এর নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসে। বিশেষজ্ঞ দল উদ্ভূত পরিস্থিতি ও বিরাজমান আর্থসামাজিক অবস্থার ওপর ব্যাপক সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষার পর তারা সমাজকর্ম শিক্ষার প্রবর্তন ও স্বেচ্ছাসেবী সমাজকর্ম সংগঠন প্রতিষ্ঠার জন্য সুপারিশ করেন ।
৩. প্রশিক্ষণ কোর্স : জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞ দলের সুপারিশ মোতাবেক ১৯৫৩ সালে ঢাকায় সমাজকর্মবিষয়ক তিন মাস মেয়াদি প্রথম প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৫৬ সালে এ কোর্সকে নয় মাসে উন্নীত করা হয়।
৪. সমাজকর্ম কলেজ প্রতিষ্ঠা : নয় মাসের কোর্সের সফলতার ভিত্তিতে একটি নিয়মিত কোর্সের প্রস্তাবে ১৯৫৮ সালে ‘কলেজ অব সোশাল ওয়েলফেয়ার এন্ড রিসার্চ সেন্টার' নামক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয় যার বর্তমান নাম সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট। ১৯৫৮-৫৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এই কলেজে স্নাতকোত্তর কোর্স চালুর মাধ্যমে সমাজকর্ম শিক্ষার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। পরবর্তীতে ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ বছর মেয়াদি স্নাতক কোর্স চালু করা হয় ।
৫. বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্ম শিক্ষা : ১৯৭৩ সালে 'College of Social Welfare and Research' কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আনা হয়। উক্ত প্রতিষ্ঠানটি সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্মীকরণ হয়। বর্তমানে এখানে ৪ বছর মেয়াদি অনার্স কোর্স, ১ বছর মেয়াদি স্নাতকোত্তর কোর্স চালু রয়েছে। এছাড়া ১৯৬৪-৬৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৯৩-৯৪ সালে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্ম বিষয়ে স্নাতক কোর্স চালু করে ।
৬. ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ প্রদান : বাংলাদেশে সমাজকর্মবিষয়ক উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে তাত্ত্বিক জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি ব্যবহারিক প্রশিক্ষণকে পাঠক্রমের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা ফিল্ড ওয়ার্ক নামে পরিচিত। যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীগণ সমাজকর্মের তাত্ত্বিক জ্ঞান বাস্তবে প্রয়োগের সুযোগ পায় ।
৭. উচ্চ মাধ্যমিক সমাজকর্ম : বাংলাদেশে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কোর্সের পাশাপাশি উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়েও সমাজকর্ম শিক্ষা চালু করা হয়েছে।
৮. চিকিৎসা সমাজকর্ম : চিকিৎসা ক্ষেত্রে রোগীদের সহায়তা করার জন্য সমাজকর্মের ব্যবহারিক ক্ষেত্র চালু হয়। ১৯৫৮ সাল থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে এ কর্মসূচি চালু রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের সব জেনারেল ও ডায়াবেটিক হাসপাতালে এ কর্মসূচি চালু আছে ।
৯. সমাজকর্ম বাস্তবে প্রয়োগ : ১৯৫৮ সালে সংশোধনমূলক কার্যক্রম ও প্রতিবন্ধী কল্যাণ, ১৯৬৯ সালে সংশোধনমূলক কার্যক্রম ও প্রতিবন্ধী কল্যাণ, ১৯৬৯ সালে বিদ্যালয় সমাজকর্ম, ১৯৬৩ সালের আন্তঃসার্ভিস প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রভৃতি ক্ষেত্রে সমাজকর্মের বাস্তব প্রয়োগ সাধিত হয়।
১০. জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদ : ১৯৬৫ সালে বাংলাদেশে প্রাদেশিক সমাজকল্যাণ পরিষদ গঠন করা হয়, যা বর্তমানে সমাজকল্যাণ পরিষদ নামে পরিচিত। এ পরিষদ দেশে বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক কাজ সম্পাদন করে থাকে ।
১১. পেশাগত সংগঠন : পেশার মানোন্নয়ন এবং কর্মীদের সাধারণ স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য পেশাদার সংগঠনের গুরুত্ব অপরিসীম। ১৯৭৫ সালে 'বাংলাদেশ জাতীয় সমাজকর্মী সমিতি' ও ১৯৮৬ সালে 'বাংলাদেশ সমাজকর্ম শিক্ষক পরিষদ' নামে আরেকটি সংগঠন গঠিত হয় । কিন্তু বর্তমানে এদের তৎপরতা নেই।
১২ সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় : ১৯৬১ সালে সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য গঠন করা হয় সমাজকল্যাণ পরিদপ্তর। সমাজকল্যাণ পরিদপ্তরের কর্মতৎপরতায় সাফল্য এবং সমাজকর্মের প্রসারতার লক্ষ্যে স্বাধীনতার পর সমাজকল্যাণ পরিদপ্তরকে সমাজসেবা অধিদপ্তরে রূপান্তর করা হয়। বর্তমানে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বাংলাদেশে সমাজকর্মের বিকাশে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা একটি দৃঢ় পদক্ষেপ ।
১৩. অন্যান্য কর্মসূচি : উল্লিখিত কার্যক্রম ছাড়াও বাংলাদেশে পেশাদার সমাজকর্মের আরও কিছু কর্মসূচি চালু রয়েছে। এগুলো হলো শ্রম কল্যাণ, শিশু কল্যাণ, পরিবার কল্যাণ, নারী কল্যাণ, মাদকাসক্ত পুনর্বাসন, অপরাধ ও ভবঘুরে পুনর্বাসন, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, শহর সমাজসেবা, গ্রামীণ সমাজসেবা প্রভৃতি ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলাদেশে ১৯৪৭ সালে সমাজকর্মের সূচনা ঘটলেও এখনো পেশা হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। বর্তমানে পেশাগত মর্যাদা অর্জনে সমাজকর্ম অগ্রগতি লাভ করছে এবং সমাজকর্ম শিক্ষার বিস্তার ব্যাপকভাবে লাভ করেছে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় এবং ভবিষ্যতে জোরালো কর্মতৎপরতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সমাজকর্ম পেশাগত স্বীকৃতি লাভ করবে বলে আশা করা যায়।