চর্যাপদের ভাষা বাংলা এই উক্তি কতদূর সত্য আলোচনা কর চর্যার ভাষা বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন এই মন্তব্যের পক্ষে ও বিপক্ষে যেসব ভাষাতাত্ত্বিক যুক্তি আছে সেসব আলোচনা করে তোমার মতামত ব্যক্ত কর
“চর্যাপদের ভাষা বাংলা "এই উক্তি কতদূর সত্য আলোচনা কর । “চর্যার ভাষা বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন।"—এই মন্তব্যের পক্ষে ও বিপক্ষে যেসব ভাষাতাত্ত্বিক যুক্তি আছে সেসব আলোচনা করে তোমার মতামত ব্যক্ত কর।
![]() |
| চর্যাপদের ভাষা বাংলা এই উক্তি কতদূর সত্য আলোচনা কর চর্যার ভাষা বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন এই মন্তব্যের পক্ষে ও বিপক্ষে যেসব ভাষাতাত্ত্বিক যুক্তি আছে সেসব আলোচনা করে তোমার মতামত ব্যক্ত কর |
চর্যার প্রাপ্ত পুঁথির লিপি বাঙলা। নব্য ভারতীয় আর্য ভাষাসমূহের বিবর্তন ধারায় বাংলা প্রাদেশিক ভাষানিচয়ের মধ্যে অর্বাচীন নয়।
পাঞ্জাবের মহারাজা রণজিৎ সিংহের পুরোহিত পুত্র রাধাকিষণ ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতের সকল ভাষার পুঁথি সংরক্ষণের জন্য লর্ড লরেন্সকে অনুরোধ জানায়। লরেন্স প্রাদেশিক গভর্নরদের সাথে পরামর্শ করে পুঁথি সংগ্রহের ব্যবস্থা করেন। বংগীয় এশিয়াটিক সোসাইটি ড. রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সাহায্যে পুঁথি সংগ্রহের কাজ শুরু করে। তাঁর মৃত্যুতে ১৮৯১-এ মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর উপর এ কাজের ভার পড়ে। তিনি বেশ কিছু পুঁথি আবিষ্কার করেন, যেমন- ধর্মমঙ্গল, শূন্যপুরাণ।
বংগীয় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রদত্ত দায়িত্ব পেয়ে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ধর্মমঙ্গল, শূন্যপুরাণের মত কিছু পুঁথি সংগ্রহ করেন। বৌদ্ধ ধর্ম ও বাঙলার বৌদ্ধ সাহিত্য সম্পর্কে তার জানার আগ্রহের কারণে তিনি নেপাল যান ১৮৯৭ ও ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে। ডাকার্নব সুভাষিত 'সংগ্রহ' দোহাকোষ পঞ্জিকা ইত্যাদি নকল তিনি নেপাল থেকে সংগ্রহ করেন। ১৯০৭ সালে আবার নেপাল যান। সেখানে 'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়' দোহাকোষ ইত্যাদির নকল নিয়ে আসেন।
১৯১৬ সালে তাঁরই সম্পাদনায় “হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা” নামে গ্রন্থ বের করেন। এ গ্রন্থের অন্তর্গত সকল গ্রন্থেরই ভাষা বাঙলা নয়, একমাত্র চর্যাপদ-এর ভাষা বাংলা। চর্যাপদ আবিষ্কারের পর পণ্ডিতদের মধ্যে এর ভাষা নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সংকলিত চারটি গ্রন্থই হাজার বছরের পুরাণ বাংলায় রচিত বলে অভিমত দেন। তিনি ভাষাতাত্ত্বিক নন, ভাষাবিদদের দৃষ্টিতেও তিনি সংকলনটি বিচার করেন নি। তবে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ Outlines of An Historical Grammar of the Bengali Language শীর্ষক বক্তৃতায় বাংলা ভাষার আমি, তুমি, তুই, আপনি, কাণ্ডারি, কেডুয়াল ও করিস শব্দসমূহের প্রাচীন রূপ চর্যায় প্রদর্শন করেন।
বাংলা সাহিত্যে এসব শব্দের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতাও দেখানো হয়, তবে বিজয়চন্দ্র মজুমদার চর্যার ভাষাকে খিচুড়ি ভাষার সমষ্টি বলে মত প্রকাশ করেন। তবে সেখানে হিন্দির প্রাধান্য বেশি বলে তিনি মনে করেন।
১৯২৬ সালে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তার 'বাঙলা ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশ' বিষয়ক গবেষণা গ্রন্থে চর্যাপদ বাংলা ভাষায় রচিত বলে প্রমাণ দেন। অতঃপর ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চর্যার ভাষা সম্পর্কে স্বমত ব্যক্ত করেন।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর বিশ্বাস যাঁরা এ পদগুলো লিখেছেন তারা বাঙালি। যদিও অনেকের ভাষার একটু একটু প্রভেদ আছে, তবুও চর্যাপদ বাঙলা ভাষায় রচিত। মূলত ব্যাকরণে তাঁর এমন বুৎপত্তি ছিল না, ফলে বিভিন্ন ভাষার রচয়িতার স্থান ও কিছু সংখ্যক শব্দ দেখে কোন রচনার জাত নির্ণয় সঠিক হয় না।
বিজয়চন্দ্র মজুমদার বলেছেন- চর্যার ভাষার সাথে উড়িয়া ও মৈথিলা ভাষার মিশ্রণ লক্ষণীয় ১ নং চর্যায় বি, পইঠো- হিন্দি শব্দ। হাঁড়িতে ভাত নাই- এই খাঁটি বাংলা বাক্যটি উড়িয়া বা হিন্দি বাক্যের অন্তর্গত। 'দুহিল দুধ' কথাটি হয় উড়িয়া বা বিহারী, কইসে / কইসন, জইসা, তইসে প্রভৃতি উড়িয়া, জহি তাহ এই প্রভৃতি উড়িয়া ভাষারই রূপ। বিজয় মজুমদার এমনি কিছু শব্দ ধরে দেখিয়েছেন, চর্যার উপর হিন্দি ও উড়িয়া ভাষার প্রভাব বেশি।
বিজয়চন্দ্র ভাষার ব্যাকরণ না ধরে বিচ্ছিন্ন শব্দ ধরে প্রমাণে অগ্রসর হয়েছেন। নব্য ভারতীয় আর্য ভাষার প্রথম স্তরের অন্তর্গত উপভাষাসমূহের রূপ মোটামুটি এক ছিল। একে অপভ্রংশ স্তর বলা হয়। বাংলা, আসামি, উড়িয়া, মগধী, মৈথিলী ভোজপুরিয়া এ স্তরের অন্তর্ভুক্ত।
ফলে শুধু শব্দ নিয়ে প্রথম স্তরের যে কোন ভাষাকে অন্য ভাষা বলে দেখানো সহজ। শুধুমাত্র দু'চারটে শব্দ ধরেই হিন্দি, উড়িয়া বলা যাবে না। কারণ এদের মূল যেহেতু সংস্কৃত, ফলে এসব শব্দের বাংলায় প্রবেশ করাও অসম্ভব নয়। ফলে বিজয়চন্দ্র মজুমদারের সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক।
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় চর্যার ভাষা নিয়ে বাঙলা ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশ বিষয়ক গবেষণা গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে চর্যাপদের ভাষা প্রাচীন বাংলা। চর্যার ভাষার মধ্যে বাংলার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। যেমন-
সম্বন্ধ পদে এর, অর, সম্প্রদান কারকে রে, অধিকরণে তে, অতীত এবং ভবিষ্যৎ কালের ইল বা ইব, অল এবং অব বিহারী রূপ নয়, বর্তমানে ক্রিয়া নির্দেশক অন্ত, সংযোজক অব্যয়ে ইঅ, শর্তযুক্ত সংযোজক অব্যয়ে ইলে, অকর্মক ধাতুতে ইঅ মধ্যযুগের বাংলাতেও যার অবশেষ বিদ্যমান। বিশেষ্যবাচক ধাতুরূপে আছ এবং থাক, মৈথিলীর থিক বা উড়িয়ার থা নয়, আরও বহু সংখ্যক বাংলা প্রবচন। চর্যাপদের ভাষার ভিত্তি মূল বাংলাদেশেরই নিজস্ব ভাষায়।
চর্যার ভাষা নব্য ভারতীয় স্তরের। শব্দরূপ নব্য ভারতীয় আর্য ভাষাস্তর অপেক্ষা মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষান্তরের বেশি নিকটবর্তী, যদিও নব্য ভারতীয় আর্য ভাষার পূর্ববর্তী অবস্থার সাক্ষাৎ চর্যাপদে পাওয়া যায়।
তবে তিনি বলেছেন চর্যার ভাষার উপর শৌরসেনী অপভ্রংশের সামান্য প্রভাব আছে। তবে তিনি দৃঢ়তার সাথে চর্যাপদকে বাংলা ভাষায় রচিত বলে নির্দেশ করেছেন। ১৯২০ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ চর্যাপদ বাংলা ভাষায় রচিত বলে অভিমত দেন। কিন্তু বিজয়চন্দ্র মজুমদার ও সুনীতিকুমারের আলোচনা প্রকাশিত হলে বাংলার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের অধিবাসী চর্যাপদকে তাদের স্ব স্ব ভাষায় রচিত বলে দাবি করেন।
ড. সুকুমার সেন বলেছেন, “সুনীতি বাবুর ইঙ্গিত বুঝিতে না পারিয়া এবং নিজ নিজ প্রাদেশিক ভাষায় গৌরব বাড়াইতে গিয়া বাংলার প্রতিবেশীরা এখন চর্যাগীতি লইয়া রীতিমত মামলা বাধাইয়াছেন। হিন্দি ভাষী, মৈথিলী ভাষী, উড়িয়া ভাষী, আসামি ভাষী, চর্যাপদ তাদের নিজ নিজ ভাষায় রচিত বলে দাবি করছে।"
ফলে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চর্যার ভাষাবিষয়ক বিতর্ককে সাতটি শ্রেণীতে সজ্জিত করে : বিচার করেছেন।
.png)