জীবনী সাহিত্য বলতে কি বুঝ

জীবনী সাহিত্য বলতে কি বুঝ 

জীবনী সাহিত্য কী? সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
জীবনী সাহিত্য কী? সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

উত্তর:
কোন ক্ষণজন্মা সৃষ্টিশীল মহৎ মানুষের জীবনকে মুখ্য করে যে সাহিত্য নির্মিত হয়, তাকে জীবনী সাহিত্য বলে। 

সমগ্র মধ্যযুগে কেবল শ্রীচৈতন্যদেবের জীবনকে অবলম্বন করে জীবনী সাহিত্য গড়ে উঠেছে। চৈতন্যদেব যে প্রেমধর্মের প্রতিষ্ঠা করেছেন তাতে মানুষে মানুষে উঁচু-নিচু, হিন্দু-মুসলমানে জাত বিভেদ ভুলে সবাই প্রেম মন্ত্রে উদ্দীপ্ত হয়েছে। 

ফলে তাঁর শিষ্যরা চৈতন্যের প্রেমধর্ম প্রচার করতে গিয়ে চৈতন্যের জীবন কাহিনী আলোচনা করতেন, তা থেকে জীবনী সাহিত্যের সূত্রপাত। চৈতন্যকে অনেকেই অবতার হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন, তাই তাঁর জীবনীকাব্য ভুক্তিকাব্য হয়ে পড়েছে। 

ভক্তের কাছে চৈতন্যছিলেন নররূপী নারায়ণ। চৈতন্যদেবের জীবনী প্রথম রচিত হয় সংস্কৃত ভাষায়। মুরারি গুপ্ত শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্যচরিতামৃত' গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি চৈতন্যদেবের সমসাময়িক বলে প্রত্যক্ষ অনেক ঘটনা এ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে।

অতঃপর বাংলা ভাষায় রচিত চৈতন্যদেবের জীবনী বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা ভাষায় রচিত চৈতন্যজীবনী কাব্যগুলোর মধ্যে বৃন্দাবন দাসের 'চৈতন্যভাগবত' সুপরিচিত, জনপ্রিয় এবং কাব্যগুণান্বিত। 

কাব্যটিতে বৈষ্ণব ধর্মপ্রচারক চৈতন্যদেবের জীবনকে ভক্তি মিশ্রিত করে চিত্রিত করা হয়েছে বলে এটি ভাগবত হিসেবে বিবেচ্য। বাংলাদেশে চৈতন্যদেব সম্বন্ধে যে সমস্ত কাহিনী ও তথ্য লোকের মুখে মুখে ঘোরে, সেগুলোর অধিকাংশই চৈতন্যভাগবত হতেই গৃহীত হয়েছে। 

বৃন্দাবন দাস তাঁর এ গ্রন্থে নিজের সম্পর্কে কেবল বলেছেন যে, চৈতন্যভক্ত শ্রীবাসের ভ্রাতুষ্ঠন্যা নারায়ণীর পুত্র তিনি। ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে তাঁর জন্ম। চৈতন্যভাগবত' রচনার জন্য তিনি বৈষ্ণব সমাজে চৈতন্যলীলার ব্যাস' বলে সম্মানিত হয়েছেন। 

বৃন্দাবন দাস প্রথমে তাঁর এ কাব্যের নাম দিয়েছিলেন চৈতন্যমঙ্গল' কিন্তু একই সময়ে লোচন দাস চৈতন্যমঙ্গল' নামে অপর একটি কাব্য লেখেন। মায়ের নির্দেশে বৃন্দাবন দাস কাব্যের নাম পরিবর্তন করে চৈতন্যভাগবত' রাখেন।

মতান্তরে দেখা যায়, এ গ্রন্থে শ্রীমদ্ভাগবতের লীলা বিন্যাস অনুসৃত হওয়ায় বৃন্দাবনের গোস্বামীরা এ কাব্যের নামকরণ করেন চৈতন্যভাগবত”। এ অনুমানটি যুক্তিসঙ্গত মনে হয়।

'চৈতন্যভাগবতের' রচনাকাল নিয়ে নানা জনে নানা কথা বলেছেন – ১৫৩৩, ১৫৪৮, ১৫৭৪ খ্রিস্টাব্দ ইত্যাদি। 

গবেষক ড. বিমানবিহারী মজুমদার নানা তত্ত্ব তথ্য মিলিয়ে ১৫৪২ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটির রচনা সম্পূর্ণ হয় বলে মনে করেন। এটিই সর্বাপেক্ষা যুক্তিনিষ্ঠ। বৃন্দাবন দাস তাঁর এ জীবনী কাব্যকে মোট একান্ন অধ্যায়ে শেষ করেছেন- 'আদি খণ্ড (১৫ অধ্যায়), মধ্য খণ্ড (২৬ অধ্যায়), অন্ত্য খণ্ড (১০ অধ্যায়)। 

অন্ত্য খণ্ডে চৈতন্যদেবের জীবনকথা বিস্তারিত না বলে হঠাৎ করে থামিয়ে দেওয়াটা এ গ্রন্থের ত্রুটি বলেই মনে হয়।

বৃন্দাবন দাস তাঁর গুরু নিত্যানন্দের কাছে চৈতন্যজীবনীর অধিকাংশ উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন। চৈতন্যের বাল্য-কৈশোর লীলার কথা তিনি সম্ভবত গদাধর ও অদ্বৈত প্রভুর কাছে শুনে থাকবেন। 

তবে অনস্বীকার্য যে, এ কাব্য পরিকল্পনায় তিনি মুরারি গুপ্তের সংস্কৃত কাব্য 'শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্যচরিতামৃতম্' দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাছাড়া ভাগবতের লীলাও কবিকে আকৃষ্ট করেছিল। তাই তিনি নবদ্বীপে গৌরাঙ্গলীলা বর্ণনা প্রসঙ্গে ভাগবত থেকেও উপাদান গ্রহণ করেছিলেন।

সহজ, পরিচ্ছন্ন, সর্বজন চিত্তাকর্ষী জীবনীকাব্য হিসেবে চৈতন্যভাগবতের মূল্য অনস্বীকার্য। অবশ্য কবি অধিকাংশ স্থলে অলৌকিক বাতাবরণের অন্তরাল থেকে চৈতন্যলীলা অনুসরণ করেছেন বলে কোন কোন ক্ষেত্রে কাহিনী ও চরিত্রের ঐতিহাসিকতা ও বাস্তবতা কিছু ক্ষু হয়েছে। 

কিন্তু এটা যুগ ধর্মেরই ফল। কেননা মধ্যযুগের কাব্য ধর্মাশ্রিত। তাছাড়া তখনকার জীবনী রচয়িতাদের উদ্দেশ্য ছিল জীবন কাহিনী বর্ণনার মাধ্যমে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার এবং গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের গৌরব প্রতিষ্ঠা। কবি কখনো কখনো তার কাব্যে চৈতন্যবিরোধীদের প্রতি কটূক্তি করেছেন, এটা কবির তারুণ্যজনিত চঞ্চল আবেগের কারণেই ঘটেছে।

তবে এ জীবনীকাব্যে জীবনকথা, চৈতন্যধর্মসম্প্রদায় ও চৈতন্যপ্রবর্তিত ভক্তির সরল প্রকাশ, চৈতন্যের বাল্য ও কৈশোর লীলা বর্ণনার বাস্তবতা, সরলতা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। শ্রীচৈতন্যের মানব মূর্তি ও ভাগবত মূর্তি সমানভাবে রক্ষিত হয়েছে। 

বর্ণনার পরিচ্ছন্নতা, করুণ বেদনাময় আবেগ ব্যাকুলতা প্রকাশে তাঁর কবিত্বশক্তি প্রশংসনীয়। 'চৈতন্যভাগবত' শুধু মহাপুরুষের ভাগবত জীবনালেখ্য হয়ে ওঠে নি, বরং কবির কলমে সমসাময়িক গৌড়ের সামাজিক, রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক চিত্র জীবন্ত হয়ে উঠেছে। 

সর্বোপরি মানবীয় রস এ কাব্যের স্বতন্ত্র মর্যাদা দিয়েছে। তত্ত্বজিজ্ঞাসু, দার্শনিক ও সাধারণ মানুষ সবাই তাঁর কাব্য থেকে যে বিশেষ রস আস্বাদন করতে পারে এখানেই চৈতন্যভাগবত' জীবনী কাব্যের সর্বৈব সফলতা।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ