সংক্ষেপে ফুল্লরার বারমাস্যার বর্ণনা দাও

সংক্ষেপে ফুল্লরার বারমাস্যার বর্ণনা দাও।
সংক্ষেপে ফুল্লরার বারমাস্যার বর্ণনা দাও।

সংক্ষেপে ফুল্লরার বারমাস্যার বর্ণনা দাও।


উত্তর:বারমাসী দুঃখের বর্ণনা দিতে গিয়ে ফুল্লরার অন্তরে সপত্নী ভীতি ও তীব্র জ্বালা নিয়েও খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে অত্যন্ত নাটকীয় ভঙ্গিমায় দুঃখ ললাটিকা মেয়ের অভিনয় করে সুন্দরী রূপ চণ্ডী দেবীর পাশে বসেছে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য। প্রথমে পর্ণকুটিরের দিকে দেবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করাতে বলেছে—

পাশেতে বসিয়া রামা কহে দুঃখবাণী ।ভাঙ্গা কুড়্যা ঘরখানি পত্রে ছাওনী ভেরেণ্ডার খাম তার আছে মধ্য ঘরে।প্রথম বৈশাখ মাসে নিত্য ভাঙ্গে ঝড়ে।।ফুল্লরার অভিপ্রায় এই জীর্ণ কুটিরে দেবীর মত অনুপমা সুন্দরীকে বেমানান লাগবে এবং এমন ঘরে তার বসবাস সম্ভব হবে না

বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে তাদের যন্ত্রণাদগ্ধ জীবনযাত্রার কথা বলতে গিয়ে বলেছে-“পদ পোড়ে খরতর রবির কিরণ।শিরে দিতে নাহি আঁটে অঙ্গের বসন।। " “পাপিষ্ঠ জ্যৈষ্ঠ মাসে প্রচণ্ড তপন। খরতর পোড়ে অঙ্গ রবির কিরণ।। "

বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে প্রচণ্ড তপন তাপ তাদের জীবনযাত্রাকে অচল করে দেয়। মাংসের পসরা দেবার মত সামান্য ছায়াটুকুও নেই। দারিদ্র্যের কারণে তার পরিধানে পরিমিত বস্ত্রও জুটে না যে, তার আঁচলটা মাথায় টেনে রৌদ্রতাপ থেকে পরিত্রাণ পাবে। পিপাসায় ছাতি ফেটে গেলেও পসরা নামিয়ে একটু জলপানের উপায় নেই, তাহলেই চিলে মাংস অর্ধেক করে ফেলবে । এ গরমে কেউ মাংস কিনতে চায় না, ফলে তাদের রোজগার থাকে না, তাই তখন বেঙচের ফল খেয়ে, কখনো বা উপবাসে দিন কাটাতে হয়।

আষাঢ়ে প্রবল বর্ষণে বড় বড় গৃহস্থও আর্থিক অনটনে পড়ে। ফলে সারাদিন পসরা করে যা হয় তাতে সামান্য খুদকুঁড়া ছাড়া উদরে দেবার মত কোন খাবার জোটে না। শ্রাবণের দুঃখ আরও তীব্র-

আচ্ছাদন নাহি অঙ্গে পড়ে মাংস-জল।কত মাছি খায় অঙ্গে করমের ফল।। অভাগ্য মনে গুণি অভাগ্য মনে গুণি।কত শত খায় জোঁক নাহি খার ফণী ।

বাদল ভরা ভাদরে হাট-মাঠ-ঘাট জলে একাকার, তারা আটকা পড়ে কিরাতপাড়ায়। মুখে দেবার মত একমুঠো আহার জোগাড় করা তাদের দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। এমন কোন বন্ধুজন তাদের জোটে না যে, এই দুঃখে এতটুকু সহায়তা করবে।

আশ্বিন মাসে মেষ ও ছাগল বলি দিয়ে ঘরে ঘরে আম্বিকা পূজা করে। তখন সবার ঘরে মাংসের ছড়াছড়ি এবং আনন্দ উল্লাস, অথচ ফুরবার তখন প্রগাঢ় হয়ে ওঠে উদরের চিন্তা । কারণ, কেউ তখন মাংস কিনে না।

“উত্তম বসনে বেশ করয়ে বণিতা।

অভাগী ফুলরা করে উপরের চিন্তা।।”

কার্তিক মাসেতে হয় হিমের প্রকাশ যগজনে করে শীত নিবারণ বাস।।

নিযুক্ত করিলা বিধি সভার কাপড়।

অভাগী ফুচরা পরে হরিণের ছড়।।”

কার্তিকে শীতের কষ্টের সাথে অন্নকষ্টও তার প্রকট। কারণ, এ সময় সবাই নিরামিষ আহার

করে। ফলে মাংসের ব্যবসা তার মন্দা।

সারা বছরের মধ্যে অগ্রহায়ণ মাস ফুরবার জন্য একটু আশার আলো বয়ে আনে। মাস মধ্যে মাসার আপনে ভগবান ।

হাটে মাঠে গৃহে গোঠে সভাকার ধান।

এ মাসে তার অন্নাভাব না থাকলেও বস্ত্রাভাব তার সুখ স্বস্তিকে শুষে নেয়

উদয় পুরিয়া অন্ন দৈবে দিলা যদি।

যম-শম শীত তথি নিরমিলা বিধি।

পৌষের প্রবল শীত ফুরার জীবনকে বড় দুর্বিষহ করে তোলে। কেননা হরিণীর বদলে পাওয়া পুরাতন খোসলা তার এ কমাত্র শীত নিবারণের সম্বল এবং নিশি শেষের বহু কাঙ্ক্ষিত এক ঝলক রৌদ্রই তার শীত নিবারণের একমাত্র উপায়।

মাঘের কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকারে বনের হরিণ কোথায় যে গা ঢাকা দেয় কালকেতু তাদের খুঁজেই পায় না। তাই মাংস ব্যবসা মাঘে তাদের বন্ধ থাকে। আবার এ মাসে বন থেকে শাক তোলা ধর্মীয়ভাবে নিষিদ্ধ। ফলে খাবার কষ্ট এ সময় প্রকটতর হয়।

ফাল্গুন-চৈত্র মাসে প্রকৃতি যখন বসন্তের বিচিত্র সম্ভারে সজ্জিত হয়, তখন প্রকৃতির সাথে সাথে মানব মনেও রঙ ধরে, কিন্তু জনম দুঃখিনী ফুল্লরা সে সুখ থেকেও বঞ্চিতা। কারণ- বণিতা-পুরুষ অঙ্গ পীড়য়ে মদনে।

ফুল্লরার অঙ্গ পুড়ে উদর দহনে ।

সংসার চালাতে তার মাটির পাথর বন্ধক দিতে হয়।

পরিশেষে চরম দুঃখের প্রত্যক্ষ চিত্র তুলে ধরে সে সুন্দরী দেবীকে বলে— ফুল্লরার কত আছে করমের ফল।

মাটিয়া পাথরা বিনে অন্য নাহি স্থল। দুঃখ কর অবধান দুঃখ কর অবধান । আমানি খাবার গর্ত দেখ বিদ্যমান।।

এমন একটা অভাবী সংসারের বধূ হয়ে ফুল্লরা বলেছে- ব্যর্থ মোর বণিতা জনম

ব্যর্থ মোর বণিতা জনম ।

যদিও বারমাসী দুঃখ বর্ণনার মধ্য দিয়ে সুন্দরীরূপী দেবীকে কৌশলে বিতাড়িত করতে চেয়েছেন, তবুও এরই মধ্য দিয়ে শিল্পী নিম্নবিত্ত ব্যাধ জীবনের সারা বছরের দুঃখ দৈন্যের বাস্তব চিত্র নির্মাণের প্রয়াস পেয়েছেন, যা শিল্পীকে জীবনমুখী শিল্পীতে পরিণত করেছে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ