চর্যাপদের পদকর্তাদের সম্পর্কে আলোচনা কর
চর্যাপদের পদকর্তাদের সম্পর্কে আলোচনা কর
অথবা, চর্যাপদের প্রধান প্রধান পদকর্তাদের জীবন ও কর্ম সম্বন্ধে আলোচনা কর
![]() |
| চর্যাপদের পদকর্তাদের সম্পর্কে আলোচনা কর |
উত্তর : বাংলা ভাষায় প্রথম কবিতা সংকলন চর্যাপদ। নবম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে সহজিয়া বৌদ্ধদের সাধনসঙ্গীতগুলো রচিত হয়। চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন। এটি বৌদ্ধতান্ত্রিক সহজিয়া ধর্মতত্ত্বের বাহন হলেও চিত্রকল্প, উপমা, রূপক ইত্যাদির আশ্রয়ে চর্যা রচয়িতাগণ যে সৌন্দর্যচিত্র ও জীবনচিত্র এঁকেছেন তা সাধারণ পাঠকের হৃদয়
ছুঁয়ে যায়। এটি একালের পাঠককেও মুগ্ধ করে। কায়বৃক্ষ, নদী পরাপার, হরিণ শিকার, শবর-শবরীর উন্মত্ত উল্লাস, অভাবী নারীর মনোবেদনা, বরযাত্রা, জলদস্যুর আক্রমণ ইত্যাদির মাধ্যমে প্রাচীনকালের মানুষের জীবনচিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদশাস্ত্রী ১৯০৭ সালে নেপাল দরবারের গ্রন্থাগার থেকে বাংলা ভাষার প্রথম বইটি আবিষ্কার করেন। অপর দুটি অপভ্রংশ রচনার সঙ্গে এটি একসঙ্গে গ্রন্থবদ্ধ ছিল। রচনাটির নাম 'চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়'।
সচরাচর চর্যাপদ বা চর্যাগীতি নামে এটি পরিচিত। চর্যার কবিতাগুলোতে সমকালীন জীবনযাত্রার অনেক খণ্ড খণ্ড ছবি ধরা পড়েছে। উচ্চকোটি জীবন নয়-ডোম, শবর, জাতি, মাঝি, ব্যাধ, ধুনুরি প্রভৃতি শ্রমজীবী অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষের কর্মশীল জীবনের ছবিই রূপক হিসেবে বেশি গৃহীত হয়েছে। মোট চব্বিশজন পদকর্তার পদ রয়েছে এই চর্যাপদে। কাহ্নপা সর্বোচ্চ সংখ্যক পদ রচনা করেন। তাঁর রচিত পদের সংখ্যা তেরোটি। এছাড়া ভূসুপার আটটি, সরহপার চারটি কুক্কুরীপার তিনটি লুইপা, শান্তিপা, শবরপা এদের রয়েছে দুটি করে পদ । আলোচ্য প্রবন্ধে চর্যার প্রধান প্রধান পদকর্তার সংক্ষিপ্ত জীবনকর্ম তুলে ধরার প্রয়াস পাব ।
কাহপা : কাহ্নপা চর্যাপদের সর্বোচ্চ সংখ্যক পদের রচয়িতা। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, কাহ্নপা ৬৭৫ থেকে ৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। কারো কারো মতে, তাঁর জীবনকাল ৮৪০ খ্রিষ্টাব্দের কাছাকাছি সময়ের রাজা দেবপালের শাসনামলে। কাহ্নপা ছিলেন কর্ণাটকবাসী। নালন্দায় লেখাপড়া করতে এসে তিনি আর নিজ অঞ্চলে ফিরে যাননি। তিনি বাংলার পাহাড়পুরে অবস্থিত বৌদ্ধবিহারেও বাস করতেন বলে ধারণা করা হয়। নালন্দায় শিক্ষা সমাপন করে তিনি বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে থেকেছেন ও জ্ঞান বিতরণ করেছেন। তিনি ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় জ্ঞানী।
কাহ্নপা বা কানুপা বাংলা ভাষার আদিকবিদের মধ্যে অন্যতম। তিনি তেরোটি পদ রচনা করেছেন। এগুলো সংকলিত আছে বাংলা ভাষার প্রাচীনতম গীতিসংগ্রহ 'চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়'এ। ভণিতায় কাহ্ন, কাহ্নিলা, কাহিল প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন ভাবে তাঁর নামের উল্লেখ আছে। তবে কাহ্ন নামাঙ্কিত গানগুলো সব একই ব্যক্তির রচনা নয় বলে পণ্ডিতদের অভিমত।
চর্যাপদগুলো গীতাকারে রচিত। প্রত্যেক পদের শেষে রাগের উল্লেখ আছে। কাহ্নপার তেরোটি পদে মোট ছুটিতে বিভিন্ন রাগের নাম আছে, যথা: পটমঞ্জরী, দেশাখ, ভৈরবী, কামোদ, গউড়া, মালনী, গবুড়া। সংস্কৃত সংগীতশাস্ত্রে রাগগুলোর বিবরণ আছে। কেবল গউড়া দেশি রাগ হতে পারে। কাহ্নপা যে সংগীত বিশারদ ছিলেন, এতে তাই প্রমাণিত হয়।
জ্ঞানমার্গীয় সহজ সাধনা সিদ্ধাচার্যদের লক্ষ্য ছিল। এ ব্যাপারে চর্যাগীতি ও দোহাকোষে কবির একই মনোভাব ব্যক্ত হয়েছে। সুতরাং উভয় রচনা একই কবির হওয়া সম্ভব। কাহ্নিপাদ দোহার টীকাভাষ্য নিজেই লিখেছেন। চর্যাগীতি ও দোহাকোষের কাহ্নপাদ একই ব্যক্তি হলে তিনি সংস্কৃত, অপভ্রংশ ও বাংলা তিনটি ভাষায় দক্ষ ছিলেন। এখানে কাহ্নপার পদের নমুনা দেওয়া হলো :
১. নগর বাহিরি রে ডোম্বি তোহোরি কুড়িআ।
ছোই ছোই জাসি বামহণ নাড়িআ
২. আলো ডোম্বি তোএ সম করিব মই সাঙ্গ।
নিখিণ কাহ্ন কাপালি জোই লাঙ্গ
৩. এক সো পদমা চট্টসী পাখুড়ি।
তাই চড়ি নাচই ডোম্বি বাপুড়ি
(চর্যা-১০)
চর্যার কৃষ্ণপাদ গৌড়ীয় অপভ্রংশে দোহা লিখতেন। গবেষকদের ধারণা দোহার রচয়িতা কৃষ্ণপাদ আর চর্যার কৃষ্ণপাদ একই ব্যক্তি। কাহ্নপার অন্য নাম ছিল কৃষ্ণপা বা কৃষ্ণাচার্য ।
লুইপা: 'চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়' এর প্রথম কবি লুইপা। তিব্বতি ঐতিহ্যে প্রাপ্ত চুরাশি জন সিদ্ধাচার্যের নামের তালিকায় লুইয়ের নাম আদিমতম। অনেক পণ্ডিত লুইপাকে প্রথম চর্যাগীতি রচয়িতা বলে মনে করেন। তাঁর জীবনকাল ৭৩০-৮১০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে। সে সময় রাজ্য ছিল রাজা ধর্মপালের রাজত্বকাল। হিন্দিভাষীরা লুইপাকে মগধ বা বিহারের অধিবাসী বলে দাবি করে।
যোগতন্ত্রশাস্ত্রেও লুইপার উল্লেখ রয়েছে। তন্ত্রশাস্ত্রের লুইপার অন্য নাম মীননাথ বা মৎসেস্যন্দ্রনাথ। মৎস্যের সঙ্গে নামের মিল থাকায় কোনো কোনো পণ্ডিত লুইকে সবরপা এর শিষ্য ও ধীবর সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত বলে উল্লেখ করেন। এ লুইপা আদি সিদ্ধাচার্য বলে অনেকের ধারণা। চর্যাগীতির লুইপা আর তন্ত্র শাস্ত্রের লুইপা অভিন্ন নয় বলেই মনে করা হয়। কেননা বলা হয়েছে, লুইপা ছিলেন গৌড় অঞ্চলের অধিবাসী। আর তন্ত্রশাস্ত্রের মীননাথ বা মৎস্যেন্দ্রনাথের বাড়ি দক্ষিণবঙ্গে। তিনি ছিলেন গোরক্ষনাথের শুরু। 'চর্যাপদ' গ্রন্থে তাঁর রচিত পদের সংখ্যা দুইটি। তাঁর রচিত একটি পদের নমুনা দেওয়া হলো
“১. কায়া তরুবর পাঞ্জাবি ভাল। চঞ্চল চীএ পইঠা কাল
২. দিয় করিঅ মহাসুহ পরিমাণ।
লুই ভণই গুরু পাচ্ছিঅ জাণ চর্যা-১
ভুসুকুপা : ভুসুকুপা বর্তমান ছিলেন ধর্মপাল ও দেবপালের (৭৭০-৮৫০) রাজত্বকালে। তিনি ছিলেন অশ্বারোহী যুদ্ধ ব্যবসায়ীর সন্তান।
এ নামটি তাঁর ছদ্ম নাম বলে ধারণা করা হয়। প্রব্রজ্যা গ্রহণকালে তিনি নতুন নাম নিয়ে থাকতে পারেন বলে অনেক পণ্ডিতের ধারণা। ভুসুকু তার বিভিন্ন পদে বাংলাদেশের পদ্মা নদী ও বাংলার পরিবেশের বর্ণনা নিয়েছেন। একটি পদে তিনি লিখেছেন: 'আজ ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী'।
এ থেকে অনুমান করা হয়, তুসুকু বাঙালি ছিলেন এবং বাংলার অধিবাসী ছিলেন। ধারণা করা হয়, তিনি নালন্দার শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু হিন্দিভাষীরা ভুসুকুকে বিহারের লোক বলে দাবি করেন। ভুসুকু চর্যাপদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদকর্তা। তাঁর রচিত পদের সংখ্যা আটটি। তাঁর রচিত একটি পদের নমুনা।
“১. কাহেরে যিনি মেলি আছ কীস।
বেঢ়িল হাক পড়ই চৌদিস
২. আপনা মাংসে হরিণা বৈরী।
খনহ ন ছাড়ই ভুসুকু অহেরীঃ
৩. তিগ ন খুবই হরিণা পিবই ন পাণী।
হরিণা হরিণির নিলঅ জাণী ॥" চর্যা-৬
সরহপা : অসাধারণ প্রজ্ঞা ও পাণ্ডিত্যের অধিকারী সরহপা রাজা গোপাল (৭৫০-৭৭০) ও ধর্মপালের রাজত্বকালে (৭৭০-৮০৯) বর্তমান ছিলেন। সরহপার রচিত পদের সংখ্যা চারটি। প্রথম জীবনে তিনি ব্রাহ্মণ ছিলেন। পরবর্তীতে বৌদ্ধধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন। সরহপা মগধের অধিবাসী ছিলেন। সরহের নামে দোহাকোষ ছাড়াও বেশ কিছু সংস্কৃত রচনার সন্ধান পাওয়া যায়। তাঁর রচিত পদের নমুনা
১. আপণে রচি রচি ভব নিব্বাণা । মিছে লোঅ বন্ধাবই আপণাঃ চর্যা-২২
কুকুরীপা : কুক্কুরীপা চর্যাগীতির তিনটি গানের রচয়িতা। তিনি ৮৪০ খ্রিষ্টাব্দে জীবিত ছিলেন। সে সময় বাংলার শাসনকর্তা ছিলেন দেবপাল। কুক্কুরীপা উচ্চবংশীয় ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। তাঁর চর্যার ভাষা সে ইঙ্গিত বহন করে। তাঁর রচিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে 'যোগভাবনা প্রদেশ', 'ধ্রুবপরিচ্ছদ'।
কুক্কুরীপা তান্ত্রিক নাম কিংবা ছদ্মনাম। কুলীন বা উচ্চবংশীয় হলেও কাব্যমূর্তির তান্ত্রিকতার আকর্ষণে তিনি এ নাম ব্যবহার করে থাকতে পারেন বলে ধারণা করা হয়। নামের সঙ্গে 'পা' যুক্ত থাকায় কেউ কেউ একে গুরুর প্রতি শ্রদ্ধাসূচক ছদ্মনাম বলে মনে করেন। তারানাথের মতে, সঙ্গে সবসময় একটি কুকুরী থাকত বলে তাঁর নামকরণ হয়েছে কুক্কুরীপা ।
কুক্কুরীপা বাংলার উত্তরখণ্ডের অধিবাসী ছিলেন ধারণা করা হয়। অবশ্য হিন্দিভাষীরা তাঁকে কপিলাবস্তু বা বুদ্ধের জন্মস্থান নেপালের লোক বলেছেন। সংস্কৃত রচনা 'মহামায়াসাধন'-এর রচয়িতা হিসেবে কুক্কুরীপার নাম পাওয়া গেছে। এ থেকে অনুমিত হয়, তিনি মহামায়ার উপাসক ছিলেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, কুক্কুরীপা চর্যাগীতি রচনা করেন ৭৪০ খ্রিষ্টাব্দে। ধারণা করা হয়, ৮০৯ খ্রিষ্টাব্দে রাজা, ধর্মপালের শাসনামলে কুক্কুরীপা তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন। তাঁর রচিত পদের নমুনা
“১. দুলি দুহি পীঢ়া ধরণ ন জাই।
রুখের তেন্তলী কুম্ভীরে খাই ॥” চর্যা-২
সিদ্ধাচার্যরা সকলেই মোটামুটি বৌদ্ধধর্ম প্রদর্শিত আচার আচরণ, পথ ও সাধনাকেই জীবনচর্চা হিসেবে গ্রহণ করতে এবং সেই অনুযায়ী জীবনকে পরিচালিত করতে দৃঢ়সংকল্প ছিলেন। পদকর্তাগণ উপমা রূপকের সাহায্যে প্রাচীনকালের জীবনচিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। অসংখ্য উপমা, রূপক ব্যবহৃত হলেও সেই রূপকগুলো এক ধরনের জিনিস বুঝাতেই ব্যবহৃত হয়েছে।
চর্যাপদের রচয়িতা সিদ্ধাচার্যরা অতি দুরূহ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রশংসার বিষয় হচ্ছে, এই দুরূহ বিষয়কে দুরূহতর করার জন্য তাঁরা অপরিচিত বস্তুকে অবলম্বন করেননি। তাঁদের পরিচিত জগতের ছোটো ছোটো জিনিসগুলোই বেছে নিয়েছেন। চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের হাজার বছরের পুরাতন ইতিহাস ঐতিহ্যকে ধারণ করে। চর্যাপদের সংরক্ষণ ও পরিচর্যা তাই জরুরি।
