চর্যাপদের ভাষা যে বাংলা এ সম্পর্কে পণ্ডিতগণের মতামত আলোচনা কর

চর্যাপদের ভাষা যে বাংলা এ সম্পর্কে পণ্ডিতগণের মতামত আলোচনা কর

অথবা, বিভিন্ন ভাষাভাষীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রমাণ কর যে চর্যাপদের ভাষা বাংলা। 

অথবা, চর্যাপদ বাংলা ব্যতীত অন্য কোন ভাষায় রচিত নয়- এ মন্তব্যের সপক্ষে অথবা বিপক্ষে তোমার মতামত ব্যক্ত কর।

অথবা, ব্যাকরণগত বৈশিষ্ট্য আলোচনা করে প্রমাণ কর যে চর্যাপদের ভাষা বাংলা । অথবা, চর্যাপদের ভাষা শীর্ষক একটি নিবন্ধ রচনা কর

চর্যাপদের ভাষা যে বাংলা এ সম্পর্কে পণ্ডিতগণের মতামত আলোচনা কর
চর্যাপদের ভাষা যে বাংলা এ সম্পর্কে পণ্ডিতগণের মতামত আলোচনা কর

উত্তর ভূমিকা : চর্যাপদের ভাষা বাংলা-- এ কথা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেছেন এমন নয়। কিন্তু ভাষা বিচারের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগ করলে একে বাংলা ছাড়া আর কিছুই বলা যাবে না। এ কথা ঠিক যে, কোনো কোনো চর্যায় এমন কিছু শব্দ বা পদ পাওয়া যায় যা আসামি, উড়িষ্যা বা হিন্দি ভাষার স্মরণ করে দেয়। কিন্তু সেই ধরনের দু'একটি বৈশিষ্ট্য দ্বারা সমগ্র রচনার জাত-বিচার সঙ্গত নয়। 

ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ পণ্ডিতগণ দেখিয়েছেন, চর্যাপদের ভাষা মূলতই বাংলা। তবে ড. শহীদুল্লাহ কেবল শান্তিপাদ ও আর্যদেব সম্পর্কে বলেছেন- তাদের ভাষা যথাক্রমে মৈথিলি ও উড়িষ্যা হতে পারে। কিন্তু অন্য সকল পদকর্তার ভাষা নিঃসন্দেহে বাংলা।মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন যে, তাঁর আবিষ্কৃত পুথিগুলোর ভাষা বাংলা। 

হতে পারে এটি একটি অনুমান মাত্র। পূর্বোক্ত চারটি পুথির মধ্যে 'চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়' ছাড়া বাকি পুথিগুলোর ভাষা যে বাংলা নয় তা প্রমাণিত এবং সর্বসম্মতক্রমে গৃহীত। কোনো কোনো পণ্ডিত চর্যাপদের ভাষাকে বাংলা বলে স্বীকার করেছেন। আবার অনেক পণ্ডিত তা অস্বীকার করেছেন। এখন আমরা এই দ্বন্দ্বের মীমাংসা করার চেষ্টা করব।

ড. বিজয় চন্দ্র মজুমদারের ১৯২০ সালে প্রকাশিত গ্রন্থে চর্যাপদের ভাষাকে বাংলা ভাষা বলে অস্বীকার করেন। তাঁর মতে, চর্যাপদের ভাষা অনেকটা মৈথিলি ভাষার মতো এবং অনেকটা হিন্দি ধ্বনির মতো শব্দাবলি চর্যাপদে ব্যবহৃত হয়েছে। তাঁর মতে, প্রথম চর্যার প্রথম পংক্তিতে 'বি' ও 'পইঠো' হিন্দি শব্দ। 

তাছাড়া ৩৩ নং চর্যায় 'দুহিল দুধু কি বেন্টে সামাই' এ বাক্যের 'সামাই' শব্দটি এককালে বাংলায় থাকলেও বর্তমানে তা শম্বলপুর জেলাতেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু তার এ মন্তব্য ঠিক নয়। কেননা বর্তমানে যশোর জেলায় 'সামাই' শব্দটির প্রচলন রয়েছে। এই শব্দটি ছাড়াও এ বাক্যের 'দুহিল' শব্দটিকে তিনি বিহারি কিংবা উড়িষ্যা শব্দ বলে মনে করেন। তিনি খাঁটি বাংলা “হাড়ীতে ভাত নাহি নিতি আবেশী”- বাক্যটিকে হিন্দি বাক্য বলেছেন।

চর্যাপদে ব্যবহৃত কইসে, কইসন, তইসো ইত্যাদি শব্দের সমজাতীয় শব্দ শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে রয়েছে তাই শব্দগুলো আদিতে বাংলায় থাকাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। বাহুল সাংকৃত্যায়নও অনেকটা বিজয় চন্দ্র মজুমদারের মতো চর্যাপদের ভাষাকে বাংলা বলে স্বীকার করেননি।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চর্যাপদের ভাষাকে প্রাচীনবঙ্গ কামরূপী ভাষা বলাই সঙ্গত মনে করেছেন। তিনি চর্যাপদের রচনাকাল ও ভাষা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে পদকর্তাদের অবস্থান বা কোন অঞ্চলের লোক তার উপর নির্ভর করেছেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, 'আর্যদেবের ভাষা উড়িয়া ও শান্তিপাদের ভাষা মৈথিলি। 

তাছাড়া বাকি সব পদকর্তারা (কাহ্ন, সরহ, ভুসুকু) প্রাচীন বাংলা বা বঙ্গকামরূপী ভাষায় পন রচনা করেছেন। তিনি এ ভাষাকে জগাখিচুড়ি ভাষা বলে স্বীকার করতে চান না। আর্যদেব ও শাস্তিপান অন্য অঞ্চলের লোক হলেও অন্যান্য সব পদকর্তারা বাঙ্গালা অঞ্চলের অধিবাসী ছিল।

ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় চর্যাপদের ভাষা ও কাল নির্ণয়ে ভাষাতাত্ত্বিক পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহও অনেক ক্ষেত্রে সুনীতিকুমারের মতকেই অনুসরণ করেছেন। এরা মনে করেন চর্যাপদের সময়কাল অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী হওয়া সম্ভব এবং এর ভাষা বাংলা। বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত ঐতিহাসিকগণ সুনীতিকুমারের মতকেই মান্য করেছেন। ভাষাতাত্ত্বিক সুনীতিকুমার তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থে চর্যাপদের ভাষাকে প্রাচীনতম বাংলা হিসেবে প্রমাণ করেছেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহও সুনীতিকুমারের মতের অনুবর্তী। তবে তিনি বিষয়টিকে সাজিয়েছেন এভাবে-

১. এটা কোন ভাষা নয়; একটি কৃত্রিম খিচুড়ি ভাষা,

২. এটা অপভ্রংশ,

৩. এটা হিন্দি,

৪. এটা মৈথিলি,

৫. এটা উড়িয়া,

৬. এটা আসামি,

৭. এটা বাংলা।

অবশেষে সমস্ত বিষয় পর্যালোচনা করে চর্যাপদের ভাষাকে তিনি প্রাচীন 'বঙ্গ কামরূপী' ভাষা বলাই সঙ্গত মনে করেছেন। ড. সুকুমার সেনও বলেছেন, চর্যাপদের উপর “অসমীয়া ভাষীদের দাবি অযৌক্তিক নয়, কেননা ষোড়শ শতাব্দী অবধি দুই ভাষায় বিশেষ তফাৎ ছিল না এবং উড়িয়া ও অসমিয়া বাংলা ভাষার মধ্যে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। 

এই তিনটি ভাষা আদিতেই এক ভাষা ছিল। দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দীর পর হতে মূলধারা হতে উড়িয়া বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।” অতএব ভাষার এক সাধারণ স্তর থেকে এ তিনটি ভাষার জন্য। তাই সুকুমার সেন এর নাম দিয়েছেন “প্রত্ন বাঙালা অসমিয়া উড়িয়া।"

চর্যাপদের ভাষায় অপভ্রংশের প্রকার : চর্যাপদের ভাষা বাংলা বলে প্রমাণিত হলেও তাতে অপভ্রংশের কিছু কিছু নিদর্শন আছে। চর্যাপদ যে সময়ে রচনা তখন বাংলা ভাষা তার পূর্ববর্তী স্তর অপভ্রংশ থেকে নিজস্বরূপ গ্রহণ করলেও একেবারে সম্পর্কহীন হয়ে পড়েনি। চর্যাকারেরা অনেকেই অপভ্রংশে পদ রচনা করেছেন। তাদের বাংলা রচনাতেই তাই প্রাকৃত বা অপভ্রংশের প্রভাব থাকা স্বাভাবিক। অপভ্রংশের প্রভাব লক্ষ করা যায় এসব ক্ষেত্রে আইসন, বৈসন, জিম, তিম, জসু, তসু প্রভৃতি শব্দে ।বিশ্ববিদ্যালয়

চর্যাপদ বাংলা ভাষারই প্রাচীনতম নিদর্শন : বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন হিসেবে চর্যাপদের ভাষার ব্যাকরণগত যেসব বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায় তা নিচে আলোচনা করা হলো :

১. চর্যাপদের ভাষার স্বর ও ব্যঞ্জনবর্ণের ধ্বনিগত বিশেষত্ব আধুনিক বাংলার ধ্বনির মতো। সংস্কৃত শব্দের বানানে সর্বত্র এক নিয়ম পালন করা হয়নি। যেমন- সবর, শবর।

২. বর্ণের হ্রস্ব ও দীর্ঘ উচ্চারণ আধুনিক বাংলার মতো চর্যাপদে দেখা যায় না। হ্রস্ব-দীর্ঘ উচ্চারণে কোনো নিয়ম ছিল না। যেমন- পঞ্চ, পাঞ্চ।

৩. চর্যাপদের শ, ষ, স তিনটি বর্ণে পার্থক্য ছিল না। যেমন- শবর, সবর, ষবরালী। তেমনি জ, য এবং ণ, ন এদের মধ্যেও পার্থক্য নেই।

৪. চর্যায় য়-শ্ৰুতি বা ব-শ্রুতি বিদ্যমান ছিল।

৫. চর্যাপদের ভাষায় অপভ্রংশের প্রভাবে পুংলিঙ্গ স্ত্রীলিঙ্গ ব্যবহৃত হতো। তবে ক্লীবলিঙ্গ নেই। বিশেষ্য স্ত্রীলিঙ্গ হলে বিশেষণেও স্ত্রীলিঙ্গ হতো।

৬. চর্যাপদের ভাষায় শব্দ রূপের গঠনে একবচন ও বহুবচনের তফাত নেই। সম্বন্ধ বুঝানো ছাড়া স্ত্রীলিঙ্গ পুংলিঙ্গেও পার্থক্য দেখা যায়নি ।

৭. একবচনে কর্তৃ, কর্ম, করণ ও অধিকরণ কারকে কোনো বিভক্তি ব্যবহৃত হতো না। যেমন- 'সসুরা নিদ গেল বহুড়ী ভাগই।'

৮. শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে এমন কয়েকটি বিশিষ্ট প্রয়োগ এতে লক্ষ করা যায় সেগুলো বাংলা ছাড়া অন্যত্র দেখা যায় না।

৯. আধুনিক বাংলার সন্ধির সূত্র চর্যাপদে প্রযুক্ত হতে দেখা যায়। যেমন- অজরামর (অজর+অমর), ভাবাভাব (ভাব+অভাব) ইত্যাদি ।

১০. আধুনিক বাংলার মতোই চর্যাপদে বহুত্ববাচক প্রত্যয়ের পরিবর্তে বহুত্ববোধক শব্দের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। যেমন- সাল, সমাহিঅ, ছড়গই ইত্যাদি ।

১১. প্রবচন জাতীয় শব্দ সমষ্টি যা বাংলার ঐতিহ্যকে স্মরণ করে দেয় তার প্রচলনও আমরা চর্যাপদে লক্ষ্য করি। যেমন- 'আপনা মাংসে হরিণা বৈরী', 'হাড়ীতে ভাত নাহি নিতি আবেশী' ইত্যাদি ।

১২. কারকভেদে চর্যাপদের মধ্যে বিভিন্ন বিভক্তির দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।

১৩. কাল অনুসারেও ক্রিয়াপদের বিভিন্ন রূপ ছিল। তখন অসমাপিকা ক্রিয়ার ব্যবহার ছিল। সর্বনামের মধ্যেও বিভিন্ন রূপ দেখা যায় ।

উপরের এসব বৈশিষ্ট্যের আলোকে বলা যায় যে, চর্যাপদের ভাষা বাংলা। অন্য কোনো ভাষা চর্যাপদের ভাষাকে স্থায়ীভাবে দাবি করতে পারে না।

উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, চর্যাপদের ভাষা হলো বাংলা। পণ্ডিতদের বিচিত্র মতামতের ভিত্তি ও আলোচনার পর আমরা ড. সুনীতিকুমার ও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতকে গুরুত্ব দেব। চর্যাপদের শব্দ ও অন্যান্য ব্যাকরণগত উপাদানের সহায়তায় সুনীতিকুমার ও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ নিশ্চিত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে চর্যাপদ বাংলা ভাষারই আদিরূপ।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ