চর্যাপদে বিধৃত ছন্দ সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা দাও

চর্যাপদে বিধৃত ছন্দ সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা দাও

অথবা, চর্যাপদে কোন ধরনের ছন্দ ব্যবহার করা হয়েছে- আলোচনা কর

চর্যাপদে বিধৃত ছন্দ সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা দাও
চর্যাপদে বিধৃত ছন্দ সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা দাও

উত্তর :বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন হিসেবে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ সালে নেপালের রাজদরবারের পুথিশালা থেকে চর্যাপদ আবিষ্কার করেন এবং ১৯১৬ সালে তা প্রকাশ করেন। চর্যাপদগুলোর রচনাকাল নির্দিষ্টভাবে নির্ণীত না হলেও নানা আলোচনা হতে বিশেষজ্ঞগণ যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন তাতে জানা যায় যে, এগুলো দশম হতে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে রচিত। 

চর্যাগীতিকাগুলো বৌদ্ধ সহজিয়াদের পদ্ধতিমূলক গান; এর উদ্দেশ্য হচ্ছে সন্ধ্যাভাষায় রূপকের মাধ্যমে সাধকদের গূঢ় ধর্মসাধনার কথা প্রচার করা। সাহিত্যের ইতিহাসে চর্যাপদের গুরুত্ব কাব্যসৃষ্টি হিসেবে। তবে তার মধ্যে একটি চমৎকার ধর্মকথাও প্রকাশ পেয়েছে। বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ তাঁদের ধর্মীয় রাজনীতির নিগূঢ় রহস্য রূপায়ণের সময় সত্যিকারের কবি হয়ে উঠেছিলেন। এ কারণে চর্যাপদে একইসাথে কবিতার এবং ধর্মকথার লক্ষ্মণ প্রকাশ পেয়েছে। এতদসত্ত্বেও চর্যাপদের সাহিত্য মূল্য অপরিসীম।

চর্যাপদে যেমন রয়েছে সমাজের বাস্তব চিত্র তেমনি আছে ছন্দ, অলংকারের বহুল প্রয়োগ। নিচে চর্যাপদে বিধৃত ছন্দ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :

চর্যাপদের ছন্দ সম্পর্কে বিভিন্ন জন ভিন্ন ভিন্ন মত দিয়েছেন। কারো মতে, চর্যাপদ চার মাত্রার চালভিত্তিক ষোল মাত্রার পাদাকুলক ছন্দে রচিত। কারো মতে, অপভ্রংশ অবহট্ঠ রচনায় ব্যবহৃত ছন্দের অনুকরণে রচিত। কেউ কেউ বলেন, চর্যাপদ পজঝটিকা ছন্দে রচিত। কেউবা চর্যাপদে পয়ার-ত্রিপদী তথা অক্ষরবৃত্তের প্রবণতা লক্ষ করেছেন।

চর্যাপদের ছন্দে সংস্কৃত পজঝটিকা ছন্দের প্রভাব বিদ্যমান। এ ছন্দের প্রতি চরণ ষোল মাত্রার, এর প্রতি চরণে চার পর্ব এবং চারমাত্রা। কারো মতে, চর্যাপদের ছন্দ মাত্রাবৃত্ত রীতিতে গঠিত হলেও মাত্রাবৃত্তের বর্তমান গঠন বা গণনা রীতি মানা হয়নি। তবে কেউ কেউ বলেন, শৌরসেনী প্রদত্ত মাত্র প্রধান পাদাকুলক ছন্দের সাথে চর্যাপদের ছন্দের মিল আছে। উল্লেখ্য যে, পাদাকুলক ছন্দের প্রতি চরণ ষোল মাত্রার। প্রতি চরণে চার পর্ব এবং প্রতি পর্বে চারমাত্রা রয়েছে। 

তবে চর্যাপদে এ ছন্দের হ্রস্ব বা দীর্ঘ স্বরের মাত্রা গণনার পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি। চর্যাপদের ছন্দ সম্পর্কে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘মাত্রাপ্রধান পাদাকুলক ছন্দের এ অক্ষর অভিমুখিতার ফলেই বাংলা ভাষায় অক্ষরবৃত্ত পয়ার ছন্দের উদ্ভব ঘটেছিল। ষোল মাত্রার ছন্দ ক্রমে চৌদ্দ মাত্রার পয়ার হয়েছে।

চর্যাপদের ছন্দে মাত্রাসমতা নিয়ে কিছু বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। এতে পয়ার এবং ত্রিপদীর সুর প্রতিফলিত হয়েছে এভাবে-  কাআ তরু বর/পঞ্চবি ডাল । চঞ্চল চীএ পইঠা কাল

চর্যাপদের ছন্দে চরণের শেষ পর্ব দীর্ঘমাত্রার দুটি অক্ষর হিসেবে প্রতীয়মান হয়। তবে কোথাও কোথাও শেষ অক্ষরটি পুরো দ্বিমাত্রিক হয়নি। চর্যার পদকর্তারা ছন্দ রচনার চেয়ে তত্ত্বকথা প্রচারে বিশেষ মনোনিবেশ করেছিলেন। চর্যাপদ পদাবলির ন্যায় গীত হতো বলে পদকর্তারা অক্ষর গণনার প্রতি মনোনিবেশ করতেন না। এ প্রসঙ্গে ড. সুকুমার সেনের মতটি প্রণিধানযোগ্য- “চর্যাগীতির ছন্দ একদিকে অবহট্ঠ, ছন্দ আর একদিকে বিশুদ্ধ বাংলা ছন্দ, এ দুইয়ের মাঝামাঝি ।”

চর্যাপদের সাহিত্যিক মূল্য অপরিসীম। চর্যার সাহিত্য প্রসঙ্গে ড. সুকুমার সেন বলেন, “চর্যাগীতিকাগুলো বৈষ্ণব পদাবলির পূর্বরূপ। পদাবলির মতো এতে রাগরাগিণীর উল্লেখ আছে। কবির ভণিতা আছে। ভাবের দিক থেকে বিচার করলে বৈষ্ণব সহজিয়া সাধকদের রাগাত্মিকা পদের সঙ্গে চর্যাপদের মিল খুঁজে পাওয়া যায়।”

সুতরাং কাব্যবিচারের মাপকাঠিতে চর্যার কাব্যধর্ম আলংকারিক বা পারিভাষিক রীতিতে নির্ণয় করা যেতে পারে। তবে চর্যাপদে অনুপ্রাস এবং অন্ত্যানুপ্রাসের বহুল ব্যবহার লক্ষ করা যায়। অন্ত্যানুপ্রাস চর্যাপদের সর্বত্র। চর্যার ১৪ সংখ্যক পদে অনুপ্রাসের ব্যবহার হয়েছে এভাবে-

'বাহ তু ডোম্বী বাহ লো ডোম্বী বাটত ভইল উছারা।'

এভাবে চর্যাপদে অলংকারের বহুল প্রয়োগ লক্ষণীয়। পরবর্তীকালে এগুলো অবলম্বন করেই বাংলা ছন্দের একাবলী, পয়ার ত্রিপদী ছাড়াও জয়দেবের গীতিগোবিন্দ কাব্যেও চর্যাপদের ছন্দের ব্যবহার দেখা যায়। চর্যাপদ থেকে উদাহরণ-

ক. কমল কুলিশ ঘান্টি/ করহু বিআলী= ৮+৬

খ. তরঙ্গেতে হলিনাত / খুর ন দীসই= ৮+৬

গ. অবণা পৰণে কাহ্ন/ বিমণা ভইলা= ৮+৬

পরিশেষে বলা যায় যে, চর্যাপদের ছন্দে সংস্কৃত পুজঝটিকা ছন্দের প্রভাব রয়েছে— তাছাড়া চর্যার ছন্দ মূলত মাত্রাপ্রধান ছন্দ। তবে এতে ছন্দ-অলংকারের বিচারই বড়ো কথা নয়, এতে আছে মানবতাবোধের নির্মল অনুভূতিপ্রবণ নির্ঝর এবং প্রেমভক্তি। তাই চর্যাপদ শুধু জ্ঞানের বিষয় নয়, ভাবের বিষয়ও বটে। যা উপর্যুক্ত শিল্প মাধ্যমে রূপায়িত ।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ