সিরাজউদ্দৌলা নাটকের নামকরণের সাফল্য আলোচনা কর

 সিরাজউদ্দৌলা নাটকের নামকরণের সাফল্য আলোচনা কর।
সিরাজউদ্দৌলা নাটকের নামকরণের সাফল্য আলোচনা কর।
 সিরাজউদ্দৌলা নাটকের নামকরণের সাফল্য আলোচনা কর।

উত্তর: বিশ্বের সকল সৃষ্টির মধ্যে বিশেষত্ব ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষার্থে এবং এক জাতীয় বহুর মধ্যে বিশেষভাবে চিহ্নিত করার জন্য নামের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। নাম পদের জাত্যার্থ ব্যক্তার্থ অনেক ক্ষেত্রে রক্ষিত হয় না। যেমন চঞ্চল ছেলের নাম হতে পারে শান্ত । 

কিন্তু শিল্পকর্মের নামকরণ হবে তাৎপর্যবহ ও গুরুত্বপূর্ণ। শিল্পকর্মের নাম দর্পণের মত। তার অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের চোখের সামনে টেনে আনে। শিল্পীর মানস-লালিত মৌলচৈতন্য প্রতিফলিত হয় নামের মধ্যদিয়ে। শিশির বিন্দুতে সূর্য প্রতিবিম্বিত হওয়ার মত শিল্পের মৌল উপজীব্য ধৃত হয় নামের আধারে। তাই নামকরণের ক্ষেত্রে শিল্পীকে বিশেষ প্রযত্নবান হতে হয়।

শিল্পের নামকরণ হয়ে ওঠে কাহিনীর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুসারে, নায়ক-নায়িকা কেন্দ্রীয় চরিত্রের নামানুসারে, স্থান, কাল বা বিষয়ের গুরুত্ব অনুসারে, মূল উপজীব্য বিষয়ের প্রতীকী অনুসারে। যেমন— শেষ প্রশ্ন, নৌকাডুবি, পল্লী সমাজ, দেবদাস, পদ্মানদীর মাঝি, লালসালু ইত্যাদি।

সিকান্দার আবু জাফরের 'সিরাজউদ্দৌলা' ঐতিহাসিক নাটক। 'সিরাজউদ্দৌলা' নাটক রচনার সময় নাট্যকারকে বিশেষ সতর্ক থাকতে হয়েছে সিরাজ চরিত্র নিয়ে। মূলত সিরাজ চরিত্র সম্পর্কে এত বেশি সত্য-মিথ্যার মিশ্রণ ঘটেছে যে, তা থেকে ইতিহাসের প্রকৃত সিরাজকে তুলে আনা কঠিন। নিজেদের স্বার্থে ইংরেজরা সিরাজের নামের সাথে যতদূর সম্ভব পাপ, অনাচার, অত্যাচার এবং চরিত্রহীনতার অভিযোগ লেপন করে প্রচার করেছে। 


তারা বুঝাতে চেয়েছে যে, অযোগ্য, অত্যাচারী, লম্পট সিরাজের হাত হতে দেশের জনগণকে রক্ষা করতে তারা শাসনভার গ্রহণ করেছে। তাই বিভিন্ন নাট্যকারের হাতে সিরাজ চরিত্র ভিন্ন ভিন্ন রূপ পেয়েছে। গিরিশ ঘোষের সিরাজ ভীরু-কাপুরুষ; শচীনসেন গুপ্তের সিরাজ আবেগপ্রবণ; নবীন সেনের সিরাজ ইন্দ্রিয়পরায়ণ। কিন্তু সিকান্দার আবু জাফরের সিরাজ সৎ, মহৎ ও ধার্মিক। তার সিরাজ বিশুদ্ধ, সাহসী, দেশপ্রেমিক ও প্রজাবৎসল বীর।

'সিরাজউদ্দৌলা' নাটক সম্পর্কে নাট্যকার নিজেই বলেছেন—' “জাতীয় চেতনা নতুন খাতে প্রবাহিত হয়েছে। কাজেই নতুন মূল্যবোধের তাগিদে ইতিহাসের বিভ্রান্তি এড়িয়ে ঐতিহ্য এবং প্রেরণার উৎস হিসেবে সিরাজউদ্দৌলাকে আমি নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে আবিষ্কারের চেষ্টা করেছি।

 ধর্ম ও নৈতিক আদর্শে সিরাজউদ্দৌলার যে অকৃত্রিম বিশ্বাস, চরিত্রের যে দৃঢ়তা ও মানবিক গুণ সেগুলোকে চাপা দেবার জন্য ঔপনিবেশিক চক্রান্তকারী ও তাদের স্বার্থান্ধ স্তাবকেরা অসত্যের পাহাড় জমিয়ে তুলেছিল; এ নাটকে প্রধানত সে আদর্শ এবং মানবিক সদগুণগুলোকেই আমি তুলে ধরতে চেয়েছি।' নাট্যকারের স্বীকারোক্তির মধ্যেই এ নাটকের নামকরণের সাফল্য প্রোথিত

বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার তরুণ নবাব সিরাজউদ্দৌলার রাজ্যশাসনের মোট কালের মধ্যে এক বছর ষোল দিনের (১৯ জুন ১৭৫৬ থেকে ২ জুলাই ১৭৫৭) ঘটনার ওপর নাটকটি রচিত। নাটকের শুরুতেই যুদ্ধ। যুদ্ধের সেনাপতি স্বয়ং সিরাজ। কলকাতা আক্রমণ করে তিনিই ইংরেজদের তাড়িয়েছেন। ইংরেজরা প্রাণভয়ে তার কাছে নতজানু। ইংরেজ দুর্গ অধিকার করে সিরাজ সেখানে মসজিদ নির্মাণের আদেশ দিয়েছেন। বন্দীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করেছেন তিনি।

সৎ কর্তব্যপরায়ণ দেশপ্রেমিক প্রজাবৎসল সিরাজ ক্ষমতা নেয়ার পর ইংরেজ কোম্পানি এবং সিরাজের অসৎ অমাত্যবর্গের অবৈধ উপার্জনের পথ বন্ধ হওয়ায় তারা যোথবদ্ধভাবে সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। সিরাজের বড় খালা ঘসেটি বেগমও এ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। সিরাজ খালা ঘসেটি বেগমকে মতিঝিল প্রাসাদের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র থেকে দূরে রাখার জন্য নিজ প্রাসাদে উঠিয়ে এনেছেন। খালাত ভাই এবং রাজদ্রোহী শওকতজঙকে তিনি নিজে পরাজিত ও নিহত করেন। 

সিরাজের চৌদ্দ মাসের শাসনামলে একাধিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। যুদ্ধগুলো সিরাজ নিজেই করেছেন। পলাশী যুদ্ধ প্রান্তরে সিরাজ স্বয়ং উপস্থিত থেকে সেনা সাজিয়েছেন, পরাজয় নেমে এলে নিজে সৈনাপত্য গ্রহণ করতে চেয়েছেন, কিন্তু মোহনলালের পরামর্শে রাজধানীতে ফিরে গিয়ে সৈন্য সংগ্রহের আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের গোপন আগড়ায় নিজে উপস্থিত হয়েছেন। 

প্রজাপীড়নের জন্য কোম্পানি প্রতিনিধি ওয়াটসকে দরবারে ডেকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। তার ষড়যন্ত্রকারী অমাত্যদের কঠোর কথা শুনিয়েছেন। আবার দেশপ্রেমের দোহাই দিয়ে তাদের মুখ সিরাজের দিকে ফেরাতে সচেষ্ট থেকেছেন। সিরাজের কথায় বিগলিত হয়ে তারা ধর্মস্থ স্পর্শ করে সিরাজকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন।

নাটকের ১২টি দৃশ্যের ৮টি দৃশ্যে সিরাজ সক্রিয়। ৬টি দৃশ্যে তিনি যুদ্ধ করেছেন প্রতিকূল ও বিরুদ্ধশক্তির বিরুদ্ধে। তার চারদিকে বিশ্বাসঘাতকতার, লোভের পাঠ্যের ও ষড়যন্ত্রের যে দেয়ালের পর দেয়াল তা তিনি চূর্ণ করেছেন স্বহস্তে।

সিরাজ ও তার দারুণ দুর্ভাগ্য, তার সক্রিয়তা-করুণ পরিণতি নাটকের ভিত্তিভূমি নির্মাণ করেছে। তার কীর্তি ও হতভাগ্যতা যুগপৎ নাটকের মৌল উপজীব্য। নাটকের ঘটনা স্রোত, দ্বন্দ্ব-সংঘাত আবর্তিত হয়েছে সিরাজকে কেন্দ্র করে। সিরাজের ভাগ্যই এ নাটকে অবিচ্ছিন্ন ডোররূপে অনুস্যূত। সিরাজের বিশাল বক্ষ হয়েছে ক্ষত-বিক্ষত। 

সকল বিধ্বংসী দুরূহ কামনার মানস বিগ্রহের আধার সিরাজ। সকল ভার সিরাজের স্কন্ধে। সকল শোভা, সব আলো নিভে গেলে স্তব্ধ গম্ভীর অন্ধকারে সিরাজ চেয়ে থাকে বিশাল ছায়াপথে। সিরাজই সকল ঐশ্বর্যের অধিকারী, জয়-পরাজয়, কীর্তি-অকীর্তির ভোক্তা। পরিণাম সিরাজেরই। এ নাটকে ক্লান্তিহীন সংগ্রাম ও অন্তহীন যন্ত্রণার মধ্যে সিরাজ জয় করতে চেয়েছে প্রতিটি অধিকার। 

নাট্যকার এক এক করে উন্মোচন করেছেন সিরাজের সকল অশান্ততা, বিক্ষুব্ধতা। সিরাজের পরাজয় দশদিকের অন্ধকার। শ্মশানভূমির মত নিঃসঙ্গ, অনিকেত। এ নাটকে সিরাজের ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত পরিচয় ফুটে উঠেছে। সিরাজের অন্তর্লোকে যে সমুদ্র মন্থন চলেছে, তার ওগরানো বিষ তাকেই পান করে নীলকণ্ঠ হতে হয়েছে।

এ নাটকে ট্র্যাজেডি যা, তা ভোগ করতে হয়েছে সিরাজকে। মৃত্যু হয়েছে তার আপন প্রাণের হরিণ শিশুর। যুদ্ধ, মৃত্যু, অকল্যাণ সিরাজকে কঠিন জীবন-জিজ্ঞাসার সম্মুখীন করেছে। পরাজয়ের জ্বালা ভোগ করতে হয়েছে সিরাজকে। সিরাজের জীবনে এক ঢেউয়ের পরে সৃষ্টি হয়েছে আরেক ঢেউয়ের। 

নাট্যকার সিরাজকে সর্বৈব মর্যাদায় মণ্ডিত করেছেন- জনহিতৈষী নবাব, দেশপ্রেমিক, স্নেহময় পিতা, যোগ্য স্বামী, বিজ্ঞ যোদ্ধা, সরল স্বভাব ভক্ত— কোথাও নীচতা বা কপটতা নেই। তবুও পরাজয়ের মালা পরে শেষ পর্যন্ত জীবন দিতে হয়েছে সিরাজকে। সিরাজের পরিণতি আমাদের বেদনার্ত করে। তবে সিরাজের সংগ্রামশীলতা, প্রতিরোধ, শিক্ষা আমাদের পথপ্রদর্শক। সুতরাং 'সিরাজউদ্দৌলা' নাটকের নামকরণ নিঃসন্দেহে যথোপযুক্ত হয়েছে

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ