সিকান্দার আবু জাফর রচিত 'সিরাজউদ্দৌলা' নাটকের ঐতিহাসিকতা বিচার কর। অথবা, ঐতিহাসিক নাটক হিসেবে সিকান্দার আবু জাফরের 'সিরাজউদ্দৌলা' কতটা সফল? আলোচনা কর।
সিকান্দার আবু জাফর রচিত 'সিরাজউদ্দৌলা' নাটকের ঐতিহাসিকতা বিচার কর।
অথবা,
ঐতিহাসিক নাটক হিসেবে সিকান্দার আবু জাফরের 'সিরাজউদ্দৌলা' কতটা সফল? আলোচনা কর।
![]() |
সিকান্দার আবু জাফর রচিত 'সিরাজউদ্দৌলা' নাটকের ঐতিহাসিকতা বিচার কর। অথবা, ঐতিহাসিক নাটক হিসেবে সিকান্দার আবু জাফরের 'সিরাজউদ্দৌলা' কতটা সফল? আলোচনা কর। |
উত্তর: ইতিহাসের কোন সুবর্ণময় আলোকিত অধ্যায়, সংঘাতময় ঘটনা বা কোন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বকে অবলম্বন করে ইতিহাসের তথ্যনির্ভর রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পটভূমিতে ইতিহাসকে অবিকৃত রেখে, ইতিহাসের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ না করে নাটকের সর্বৈব বৈশিষ্ট্য সহযোগে (কাহিনী, চরিত্র, সংলাপ) নাটকীয় বিন্যাসে সৃষ্ট শিল্পকর্মকে ঐতিহাসিক নাটক আখ্যা দেওয়া হয়।
এক্ষেত্রে ঐতিহাসিক, অনৈতিহাসিক সব চরিত্রই ইতিহাসের সত্যতাকে পরিণতি দান করতে সচেষ্ট থাকবে। নাটকে ইতিহাসকে অক্ষুণ্ণ রেখে শৈল্পিকভাবে নাট্যকার আপন উপলব্ধি বা জীবনদর্শনের প্রক্ষেপণ করতে পারেন। সর্বোপরি তাকে নাটকের গুণাবলিতে সমৃদ্ধ হতে হবে। এমন নাটক ও ইতিহাসের মেলবন্ধনে রূপায়িত হয় ঐতিহাসিক নাটক।
ইতিহাসের ঘটনার অন্তরালে জীবনের অনাবিষ্কৃত দিকগুলো বিদ্যুৎ চমক দ্বারা আলোকিত করতে পারার মধ্যেই ঐতিহাসিক শিল্পের সার্থকতা। ইতিহাসের বিশেষ সভা ও শিল্পের নিত্য সত্য যদি সমান মর্যাদায় রক্ষিত হয় তবেই কেবল ঐতিহাসিক নাটক হতে পারে।
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের পরাজয় ও পতনকে কেন্দ্র করে সিকান্দার আবু জাফর ১৯৬৫ সালে রচনা করেছেন 'সিরাজউদ্দৌলা' নাটক। ইতিহাসের ধূসর আবর্ত থেকে কাহিনীর মৌল উপাদান গৃহীত হলেও নাট্যকার অত্যন্ত দক্ষতার সাথে আলোচ্য নাটকে বর্তমান কালের জীবন-জিজ্ঞাসাকে ইতিহাসের কাঠামোর মধ্যে প্রতিস্থাপন করেছেন।
তাঁর হাতে পলাশীর ইতিহাস পুনর্জীবন লাভ করেছে। বাঙালির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা আর সংগ্রামশীল সত্তা প্রকাশের আন্তর তাগিদেই নাট্যকারের ইতিহাসের সিরাজউদ্দৌলাকে স্মরণ। এখানেই এ নাটকের ঐতিহাসিক মূল্যমান বিশেষ মাত্রা পেয়েছে।
ইংরেজ আপন স্বার্থ সংরক্ষণে স্বাধীনতা সংগ্রামের নির্ভীক নায়ক সিরাজ চরিত্রকে নানাভাবে কলঙ্কিত করেছে। ইতিহাসের কৃত্রিম কলঙ্ক মোচন করে জাতীয় চেতনা নতুন খাতে প্রবাহিত। তাই নাট্যকার নতুন মূল্যবোধের তাগিদে ইতিহাসের বিভ্রান্তি এড়িয়ে এবং প্রেরণার উৎস হিসেবে সিরাজকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন।
নাট্যকার নিজেই বলেছেন, “একান্তভাবে প্রকৃতই ইতিহাসের কাছাকাছি থেকে এবং প্রতি পদক্ষেপে ইতিহাসকে অনুসরণ করে আমি সিরাজউদ্দৌলার জীবননাট্য পুনঃনির্মাণ করেছি। ধর্ম এবং নৈতিক আদর্শে সিরাজউদ্দৌলার যে অকৃত্রিম বিশ্বাস, তার চরিত্রের যে দৃঢ়তা এবং মানবীয় সদগুণগুলো চাপা দেবার জন্যে ঔপনিবেশিক চক্রান্তকারী ও তাদের স্বার্থান্ধ স্তাবকেরা অসত্যের পাহাড় জমিয়ে তুলেছিল, এই নাটকে প্রধান সেই আদর্শ এবং মানবীয় গুণগুলোকেই আমি তুলে ধরতে চেয়েছি।” তাই নাট্যকার ইতিহাসকে অবলম্বন করে নতুন ইতিহাস লেখেন নি; বরং নির্মাণ করেছেন কালজয়ী সাহিত্য।
বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার তরুণ নবাব সিরাজউদ্দৌলার রাজ্যশাসনের মোট সময়ের এক বছর ষোল দিনের (১৯ জুন ১৭৫৬ থেকে ২ জুলাই ১৭৫৭) ঘটনার ওপর এ নাটক রচিত। নাটকের ১২টি দৃশ্যে ঘটনার তারিখ উল্লেখ করেছেন নাট্যকার। সংঘটিত ঘটনাগুলো নথিবদ্ধ করা এবং ঘটনাপ্রবাহে একটি গতিসঞ্চার করার জন্য এ আয়োজন- তারিখগুলোকে ইতিহাসের নিরিখে নির্ভুল হতে হবে, এমনটি নয়, কেননা এটি নাটকের ঐতিহাসিকতার বিশেষ গঠনকর্ম মাত্র
এ নাটকের চরিত্রগুলো ইতিহাস থেকে গৃহীত বটে, কিন্তু তারা ইতিহাসের প্রকৃত মানুষের প্রতিবিম্ব নয়, তা সম্ভবও নয়। সিরাজ, মীরজাফর, উমিচাঁদ, জগৎশেঠ, ঘসেটি বেগম, ক্লাইভসহ অন্যরা যে ভাষায় কথা বলত, তাদের নড়ন চড়ন, চলাফেরা এখন কেবল কল্পনাসর্বস্ব মাত্র। বস্তুত লক্ষণীয় যে, এ চরিত্রগুলো ঐতিহাসিক এবং ইতিহাসে এদের
ভূমিকা যা নাটকে তা বিকৃত হচ্ছে কিনা। কেননা, ঐতিহাসিক নাটক নির্ভুল ও কঠোর বাস্তবকে অবিকল গ্রহণ করে না। লেখকের মনোরাজ্যের স্বাধীনতা এখানে গুরুত্ববহ। নাটক ইতিহাস নয়, নাটক সাহিত্য। পলাশীর মূল কাহিনী, জয়-পরাজয় অবিকৃত আছে কিনা সেটাই বিবেচ্য। সাহিত্যের সত্য আর ইতিহাসের সত্য এক নয়। অযোধ্যায় কী ঘটেছিল তা নয়, লেখকের মনরূপ অযোধ্যায় কী ঘটছে সেটাই মুখ্য। মূলত ইতিহাস অর্থ পূর্বে যা সংঘটিত।
ইতিহাসের মূল সত্যকে স্থির রেখে নাট্যকার যখন ঐতিহাসিক মানব চরিত্রগুলোর সুখ-দুঃখের জীবনপ্রবাহকে সংলগ্ন করেন তখন তা যথার্থই নাটক হয়ে ওঠে। নাটকের প্রয়োজনে ইতিহাস লঙ্ঘন না করে বা সত্যের কোন অপলাপ অথবা পরিবর্তন না করে ঐতিহাসিক চরিত্রের অনাবিষ্কৃত ও অনুদঘাটিত রহস্য প্রোথিত করা নাট্যকারের বিশেষ কৃতিত্ব ।
নবাব আলিবর্দী খাঁর মৃত্যুর পর তারই নির্দেশ মত বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাবির দায়িত্ব পান তরুণ সিরাজউদ্দৌলা। ক্ষমতালোভী মীরজাফর ও ঘসেটি বেগমের প্রত্যাশা ব্যর্থ হয়। সৎ, কর্তব্যনিষ্ঠ, দেশপ্রেমিক ও প্রজাহিতৈষী সিরাজের কারণে ইংরেজ স্বেচ্ছাচারের পথ বন্ধ হয়, অর্থলোভী উমিচাঁদ, জগৎশেঠ প্রমুখের অবৈধ উপার্জনের পথ বন্ধ হয়। ফলে উপযুক্ত সবার আশাভঙ্গের কারণে তারা সিরাজ পতনে গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।
সিরাজ এদের স্বহস্তে দমনের প্রয়াস পান। ষড়যন্ত্রকারী অমাত্যবর্গকে দেশপ্রেমের দোহাই দেওয়ায় তারা স্ব-স্ব ধর্মগ্রন্থ স্পর্শ করে সিরাজের অনুগত থাকবে বলে কথা দেয় । এ সুযোগে মীরজাফর পলাশী যুদ্ধের সেনাপতিত্বের সুযোগ আদায় করে নেয়। যুদ্ধে মীরজাফর তার বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকে। এতে সিরাজের বিশ্বস্ত কিছু সেনাপতির জীবন যায় এবং পরাজিত হয়। সিরাজ মুর্শিদাবাদ গিয়ে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হন এবং মীরনের নির্দেশে মোহাম্মদী বেগ তাকে হত্যা করে। উপর্যুক্ত ইতিহাসের সত্যকে নাট্যকার তার নাটকের জমিনে বিধৃত করেছেন। চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রেও নাট্যকার দেশপ্রেমিক সিরাজ, মোহনলাল, বস্ত্রে আলী, নৌবেসিং প্রমুখ চরিত্রের বিপরীতে মীরজাফরসহ বেঈমানদের চরিত্র যথাযথ নির্মাণ করেছেন । ঐতিহাসিক নাটকে বিশুদ্ধ ইতিহাস পেতে হবে, এমন কোন কথা নেই।
নাটকের ঘটনা, চরিত্রের প্রবাহ এবং নাট্যিক সৌন্দর্য বিকাশে নাট্যকার ইতিহাসের ভাব সত্যকে গ্রহণ করে সম্ভাব্য সত্যকে আবিষ্কারের প্রয়াস পেয়েছেন। ঘটনার পরিবর্তন, পরিবর্জন করে মূল সত্যকে অধিক উজ্জ্বল করতে প্রয়াস পেয়েছেন।
ঐতিহাসিক নাটকের সংলাপের ভাষা হতে হয় দৃঢ়, সমৃদ্ধ, অলঙ্কৃত ও অতিকথনমুক্ত। সুদূর রহস্যাবৃত অস্পষ্ট জগতকে প্রত্যক্ষ ও প্রকটিত করতে নাট্যকার এ নাটকের সংলাপের ভঙ্গি বলিষ্ঠ ও গম্ভীর করেছেন।
উমিচাদ ও বৃটিশ সিংহ ভয়ে লেজ গুটিয়ে নিলেন এ বড় লজ্জার কথা। [১ম অংক, ১ম দৃশ্য।
উঁমিচাদ : দণ্ডলৎ আমার কাছে ভগবানের দাদামশায়ের চেয়েও বড়। [১ম অংক, ৩য় দৃশ্য সিরাজ : আমার নালিশ আজ আমার নিজের বিরুদ্ধে।। ২য় অংক, ১ম দৃশ্য।
সিরাজ : ওই একটি পথ সিপাহসালার দেশের কল্যাণ, দেশবাসীর কল্যাণ। শুধু ওই একটি পথেই আবার আমরা উভয়ে উভয়ের কাছাকাছি আসতে পারি। (২য় অংক, ১ম দৃশ্য]
মীরজাফর ঃ নবাব আলিবর্দীর আমলে, উদ্ধৃত সিরাজের আমলে মসনদের পাশে অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে আমি এই কথাই শুধু ভেবেছি, একটা দিন মাত্র, একটা দিনও যদি ওই মসনদে মাথা উঁচু করে আমি বসতে পারতাম। [২য় অংক, ২য় দৃশ্য)
ক্লাইভ ঃ আমরা এমন কিছু করলাম যা ইতিহাস হবে ।। ২য় অংক, ৩য় দৃশ্য।
সিরাজ ঃ আমার সারা অস্তিত্ব জুড়ে কেবল যেন দেয়ালের ভিড়।... আমার চিন্তা আর কাজের মাঝখানে, আমার স্বপ্ন আর বাস্তবের মাঝখানে, আমার অদৃষ্ট আর কল্যাণের মাঝখানে শুধু দেয়াল আর দেয়াল। [৩য় অংক, ১ম দৃশ্য ]
সিরাজ ঃ তোমাদের প্রাণ বিপন্ন হবে অথচ স্বাধীনতা রক্ষা হবে না, এই চিন্তাটাই আজ বেশি করে পীড়া দিচ্ছে। [৩য় অংক, ২য় দৃশ্য)
মোহনলাল ঃ আমার শেষ যুদ্ধ পলাশীতেই। [৩য় অংক, ৩য় দৃশ্য
সিরাজ : ভীরু প্রতারকের দল চিরকালই পালায়। [৩য় অংক, ৪র্থ দৃশ্য।
উপর্যুক্ত সংলাপগুলোর ভাষা যেমন সংযত তেমনি ঐশ্বর্যমণ্ডিত। সংলাপের মধ্যদিয়ে চরিত্রগুলো স্ব-স্ব ক্ষেত্রে ভাষর হয়ে উঠেছে। চিত্রধর্মী ও অলঙ্কৃত ভাষাগুণে অতীত কাহিনী হয়ে উঠেছে আলোকিত। এ নাটকে ব্যবহৃত ঐতিহাসিক উপাদান নাটকে ঐতিহাসিক রস সৃষ্টি করেছে। সিরাজের দ্বন্দ্ব-বিক্ষুব্ধ চিত্ত, মীরজাফরদের সক্রিয়তা নাট্যকার দর্শকচিত্তে সঞ্চারিত করতে সক্ষম হয়েছেন। ইতিহাসের সত্যতার সাথে মানবহৃদয়ের শাশ্বত অনুভূতি নাটকে উচ্চকিত হয়েছে।
উপর্যুক্ত আলোচনার ভিত্তিতে বলা যায়, কাহিনী, চরিত্র, সংলাপের সাথে সাথে সিরাজের ব্যক্তিজীবনের বেদনার বৃত্তান্ত ইতিহাসের সত্যতার সাথে চিরন্তন মানবীয় সত্যতার সংমিশ্রণে 'সিরাজউদ্দৌলা' হয়ে উঠেছে সার্থক ঐতিহাসিক নাটক।
.png)