সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী কার লেখা


সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী কার লেখা

সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী সম্পর্কে লেখ।
সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী সম্পর্কে লেখ।

উত্তর: লোকগাথা হিসেবে ভারতের বিভিন্ন স্থানে সতীময়না ও লোরচন্দ্রানীর কাহিনী প্রচলিত ছিল। এই লোকগাথা অবলম্বন করে হিদি কবি সাধন ‘মৈনসত' নামে একটি কাব্য লেখেন।

চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার সুলতানপুর গ্রামের দৌলত কাজী অল্প বয়সে নানা বিদ্যা অর্জন করেন। কিন্তু বয়সের স্বল্পতাহেতু নিজ দেশে স্বীকৃতি মেলে নি বলে তিনি আরাকান রাজসভায় আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং সেখানে যথার্থ মর্যাদা লাভে সমর্থ হন। 

আরাকানের লস্কর উজির আশরাফ খানের অনুরোধে দৌলত কাজী 'সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী' কাব্য রচনা করেন। কাব্যটি সংক্ষেপে সতীময়না বা লোরচন্দ্রানী নামে পরিচিত। কাব্যটির রচনাকাল সঠিক জানা যায় না। 

অনুমান করা হয় ১৬২২ খ্রিঃ থেকে ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কাব্যটি রচিত হয়েছিল। কাব্যটি শেষ না হতেই কবি দৌলত কাজীর মৃত্যু হয়। কবির মৃত্যুর বিশ বছর পর ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে কবি আলাওল কাব্যের শেষাংশ রচনা করে কাব্যটিকে সম্পূর্ণ করেন।

কাব্যটি 'মৈনসত' অবলম্বনে রচিত বলে কাব্যের কথাবস্তুতে হিন্দি প্রণয়কথা থাকলেও রূপে ও ভাবে তা বিদগ্ধ ও বিশুদ্ধ বাংলা কবিতা। কবি কাব্যের প্রথমে আল্লাহ রসুলের বন্দনা করেছেন। বন্দনার উদারতা ও অসাম্প্রদায়িকতায় এটি সর্বজনীনতা পেয়েছে। 

তৎকালীন আরাকান রাজ শ্রীসুধর্মা ও লক্ষর উজির আশরাফ খানের প্রশংসা, রাজার বিহার ও আশরাফ খানের দ্বারা কাব্য রচনার নির্দেশের কথা বলে কবি কাব্যের কাহিনী শুরু করেছেন।

দৌলত কাজী তাঁর কাব্যের কাহিনী নির্বাচনে এবং তার বিস্তারিত রূপায়ণে গতানুগতিকতাকে অনুসরণ না করে স্বাধীন চিন্তা ও অপূর্ব কলাকৌশলের পরিচয় দিয়েছেন। চরিত্র চিত্রণেও কবি যথেষ্ট কৃতিত্বের নিদর্শন দেখিয়েছেন। 

ময়না ও চন্দ্রানী চরিত্রের মাধ্যমে কবি আদর্শবাদ ও ভোগবাদ, সংযম ও স্বৈরাচার, সতীত্ব ও নারীত্ব, মর্যাদা ও লালসা, ত্যাগ ও ভোগ, ক্ষোভ ও তিতিক্ষা প্রভৃতির দ্বন্ধু সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। বারমাসি রচনায় তাঁর দক্ষতা অতুলনীয়। 

কবির কবিত্বশক্তি ছিল অতুলনীয় এবং তাঁর শিল্প ও সৌন্দর্যবোধ ছিল তীক্ষ্ণ ও হৃদয়গ্রাহী। তিনি এ কাব্যে ব্রজবুলি ভাষার ব্যবহার করে

প্রমাণ করেছেন যে, রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক কাহিনী ছাড়াও ব্রজবুলি ব্যবহার করা যায়। বারমাসিতে তিনি ব্রজবুলি ব্যবহার করেছেন।

দৌলত কাজীর চেয়ে আলাওল শ্রেষ্ঠ কবি হলেও আলাওল অসমাপ্ত কাব্য সমাপ্ত করতে গিয়ে বলেছেন- তান সম আমার না হয় পদ গাথা। মূলত রচনার লালিত্যে, ভাষার মাধুর্যে এবং উপমার ব্যঞ্জনায় দৌলত কাজীই শ্রেষ্ঠ ।

কাঞ্চন কমল মুখ পূর্ণ শশী নিন্দে। অপমানে জলেতে প্রবেশে অরবিন্দে। চঞ্চল যুগল আঁখি নীলোৎপল গঞ্জে। মৃগাঞ্জন শরে মৃগ পলায় নিকুঞ্জে।

কবি এ কাব্য রচনার মাধ্যমে রূপকথাকে পরিণত মনের পাঠ-উপযোগী রোমান্টিক কাহিনীতে পরিণত করেছিলেন। মধ্যযুগের এ কাব্যটিকে একখানি মূল্যবান মর্ত্যজীবনের অসাম্প্রদায়িক কাব্য বলা যায়। তাঁর এ কাব্যে শিল্পীত প্রবাদ কাব্যকে সমৃদ্ধ করেছে। 

মূলত নিষ্ঠুর কাল বঙ্গীয় কাব্য নিকুঞ্জের এই অর্ধস্ফুট গোলাপ কলিকাটিকে অকালে ঝরে পড়তে বাধ্য না করলে, কালে তাঁর সৌন্দর্যচ্ছটায় দিমণ্ডল আলোকিত ও মনোরম সুরভিতে চতুর্দিক আমোদিত করে তুলত, তাতে সন্দেহ নেই।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ