বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বৃহৎ শক্তিবর্গের ভূমিকা মূল্যায়ন কর

 আসসালামু আলাইকুম প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা আজকে বিষয় হলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বৃহৎ শক্তিবর্গের ভূমিকা মূল্যায়ন কর জেনে নিবো। তোমরা যদি পড়াটি ভালো ভাবে নিজের মনের মধ্যে গুছিয়ে নিতে চাও তাহলে অবশ্যই তোমাকে মনযোগ সহকারে পড়তে হবে। চলো শিক্ষার্থী বন্ধুরা আমরা জেনে নেই আজকের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বৃহৎ শক্তিবর্গের ভূমিকা মূল্যায়ন করো ।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বৃহৎ শক্তিবর্গের ভূমিকা মূল্যায়ন কর
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বৃহৎ শক্তিবর্গের ভূমিকা মূল্যায়ন কর

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বৃহৎ শক্তিবর্গের ভূমিকা মূল্যায়ন কর

উত্তর : ভূমিকা : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নারকীয় তাণ্ডব বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছিল। 

বিভিন্ন দেশ বা সংস্থা এর নিন্দা এবং প্রতিবাদ জানায় এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে বিশেষ করে ২৫ মার্চের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পর বিশ্ব জনমত সোচ্চার হয়ে উঠে

→ মুক্তিযুদ্ধে বৃহৎশক্তির ভূমিকা : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করেছিল । 

কোনো কোনো রাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করেছিল এবং কোনো কোনো রাষ্ট্র বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান করছিল। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন ও ভারত বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেয় এবং মুসলিম রাষ্ট্রগুলো পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল । 

জাতিসংঘ কোনো সাহায্য করতে পারেনি কারণ শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান নিয়েছিল তবে জাতিসংঘের UNHCR উদ্বাস্তু ও শরণার্থীদের সহায়তা করেছিল।

(ক) মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা : নিম্নে মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা আলোচনা করা হলো-

১. মৌন ভূমিকা গ্রহণ : ২৫ মার্চ ১৯৭১ রাত থেকে শুরু করে ১০ জুলাই ১৯৭১ সময়কালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্ত ানের যুদ্ধে না জড়িয়ে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে। 

১০ জুলাই থেকে শুরু করে সেপ্টেম্বরের শেষ দিক পর্যন্ত সময়কালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার গোপনে পাকিস্তানের সহায়তায় চীন সফর করেন। 

ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মৈত্রী চুক্তির প্রতিপক্ষ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার সম্পর্কের উন্নয়ন হয়। 

এসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ সমস্যার কূটনৈতিক সমাধানের উপর গুরুত্বারোপ করে এবং ভারতকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ না গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানায় ।

২. নিরপেক্ষতার নীতি গ্রহণ : প্রথম পর্যায়ে মার্কিন নীতির প্রকৃতি ছিল কৌশলগত নিরপেক্ষতা। এ সময় মার্কিন সরকার | বাংলাদেশ সমস্যাকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হিসেবে অভিহিত করে। 

কিন্তু গোপনে পাকিস্তানের জন্য সমরাস্ত্র সরবরাহ ও আর্থিক সাহায্য প্রদানের প্রস্তুতি নিতে থাকে। তবে জনতার চাপে এ উদ্যোগ বাতিল হয়। 

কিন্তু অস্ত্র সাহায্য বন্ধ থাকলেও গোপনে প্রচুর মার্কিন অস্ত্র পাকিস্তানে আসে। জুনের শেষ নাগাদ মার্কিন সরকারের সঙ্গে পাকিস্তানের যে ৪.৩ মিলিয়ন ডলারের দুটি অর্থ চুক্তি হয়েছিল তা বাঙালি হত্যাযজ্ঞে ব্যবহৃত হয়। 

তবে এসময় মার্কিন সরকার ভারতের শরণার্থীদের জন্য ভারতকে ৩০ লক্ষ মার্কিন ডলার সাহায্য দেয়। এ যেন 'চোরকে চুরি করতে বলা আর বাড়ির মালিককে সাবধানে থাকার' মতোই প্রহসনমূলক ভূমিকা গ্রহণ করার সামিল।

৩. কূটনৈতিক তৎপরতা : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন নীতির দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় জুলাই মাসে। এ পর্যায়ে মার্কিন নীতির দুটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়, 

(১) রাশিয়াকে প্রতিরোধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনকে স্বীকৃতি এবং জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের প্রতিশ্রুতি দেয় এবং এ উদ্দেশ্যে হেনরি কিসিঞ্জার বেইজিং সফর করে।

(২) যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা হয়েছিল যে পাকিস্ত ানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে জুলাই মাসে রুশ-ভারত পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হবে। তাই এ পরিকল্পনা মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র তৎপর হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে পাকিস্তানের মূল লক্ষ্য ছিল অখণ্ড পাকিস্তানের অধীনে একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করা এবং যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়া।

৪. পাকিস্তান ঘেষা নীতি গ্রহণ : মার্কিন নীতির তৃতীয় পর্যায় নিক্সন প্রশাসন আরও বেশি পাকিস্তানপন্থি নীতি অবলম্বন করে। 

কলকাতায় অবস্থানকারী বাঙালি নেতৃবৃন্দের একাংশের সঙ্গে শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করে। 

এছাড়াও পাকিস্তান সরকারকে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের জন্য চাপ দেয়। যদিও মুজিবনগর ও ভারত উভয় সরকার মার্কিন এ উদ্যোগের প্রত্যাখ্যান করে। 

এমনকি ৫-৮ নভেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ওয়াশিংটন সফরকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পাকিস্তানপন্থি নীতি থেকে সরিয়ে আনতে ব্যর্থ হন। ফলে একটি যুদ্ধ যে অনিবার্য তা পরিষ্কার হয়ে যায়।

৫. পাকিস্তানকে নৈতিক ও কূটনৈতিক সহায়তা প্রদান : মার্কিন নীতির চতুর্থ পর্যায়ে ৩ ডিসেম্বর পাক-ভারত যুদ্ধ শুরুর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র প্রচণ্ড ভারত বিরোধী ও পাকিস্তান ঘেঁষা নীতি অনুসরণ করতে থাকে। 

পাকিস্তানকে যাবতীয় নৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থনদানের জন্য প্রেসিডেন্ট নিক্সন হেনরি কিসিঞ্জারকে নির্দেশ দেন। নিক্সনের এ নীতিকে 'Tilt Polices' নামে অভিহিত করা হয়েছে। 

৬ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র ভারতের জন্য ৮৬.৬ মিলিয়ন ডলার আর্থিক সাহায্য সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করে। এর মাধ্যমে স্বাধীনতা বিরোধী মানসিকতা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একই সাথে পাকিস্তান সমর্থন প্রত্যক্ষ রূপ ধারণ করে।

(খ) মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাজ্যের ভূমিকা : ১৯৭১ এর যুদ্ধে যুক্তরাজ্য অনেকটা মৌন তথা নিরপেক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করে এবং নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে নীতি নির্ধারণ করে। নিম্নে মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাজ্যের ভূমিকা তুলে ধরা হলো-

১. কমন্সসভার ভূমিকা : যুক্তরাজ্যের কমন্সসভায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্ক হয়। যুক্তরাজ্যের আইন প্রণেতাগণ বাংলাদেশে পাকিস্তানি নির্যাতন সম্পর্কে যেমন নিশ্চুপ থাকতে পারেননি তেমনি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে তারা সতর্ক ছিলেন। 

২৯ মার্চ ব্রিটিশ পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ বিষয়ক সচিব স্যার ডগলাস হিউম কমন্সসভায় এক বিবৃতি প্রদান করেন। এতে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে অভিহিত করেন। 

কিন্তু তার বিবৃতির প্রেক্ষিতে অন্যান্য এমপি যেসকল প্রশ্ন উত্থাপন ও মন্ত ব্য পেশ করেন তাতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি সরাসরি আলোচনায় এসে যায়। 

জনস্টোন এমপি পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সরাসরি প্রশ্ন করেন যে, তার সরকার পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যা বন্ধ করার জন্য এবং শেখ মুজিব ও তার অনুসারীদের নির্যাতন না করার জন্য পাকিস্তান সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করবে কিনা এবং পূর্ব বাংলাবাসীদের নিজস্ব ভবিষ্যৎ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রয়োজনে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে যা কিছু করা সম্ভব তা তারা করবে কিনা? 

তিনি বাংলাদেশে নির্যাতন বন্ধের জন্য বৃটিশ সরকারকে ইয়াহিয়া খানের উপর চাপ সৃষ্টির জন্য অনুরোধ করেন। এভাবে নয় মাস ধরে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বারবার বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আলোচনা হয়।

২. লর্ডসভার ভূমিকা : কমন্সসভার পাশাপাশি যুক্তরাজ্যের লর্ডসভাও মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা পালন করে। লর্ডসভাও বাংলাদেশে নির্যাতন বন্ধের দাবি উত্থাপন করে। 

পার্লামেন্টের বাইরেও কোনো কোনা এমপি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিবৃতি প্রদান করেন। ৩১ মার্চ মি. রাসেল জনস্টোন এমপি এক বিবৃতিতে মন্তব্য করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সেদেশের স্বাধীনতা চায়। 

সে সময় লেবার পার্টির অনেক এমপি পাকিস্তানের উপর যুক্তরাজ্যের অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের দাবি জানান। পাকিস্তানকে সব ধরনের ব্রিটিশ সাহায্য প্রদান বন্ধের দাবি জানান এসব এমপি। 

১৭ জুন লর্ড সভার ১২০ জন এমপি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের দাবি জানান। মূলত লর্ডসভায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল আলোচনা হয় এবং সরকারি ভূমিকা এসব আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে নিবদ্ধ থাকে।

৩. বিবিসির ভূমিকা : বিবিসি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ২৬ মার্চ বিবিসির নিয়মিত সংবাদে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার তথ্য প্রকাশ করা হয়। 

২৬ মার্চ থেকেই বিবিসি মুক্তিকামী প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে জায়গা করে নেয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ন্যায় বিবিসির বাংলা অনুষ্ঠানও জনপ্রিয়তা অর্জন করে। 

শুধুমাত্র সংবাদ প্রচার করে বিবিসি তার দায়িত্ব শেষ করেনি বিবিসিতে মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষাৎকার বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ রিপোর্ট, বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মন্তব্য ও বিবৃতি, বিশ্ব পত্র-পত্রিকায় প্রচারিত সংবাদ ও ফিচার ইত্যাদি প্রচারিত হয়। 

অর্থাৎ বিশ্ব জনমত গঠন, মুক্তিযুদ্ধের প্রচার প্রচারণা ইত্যাদিতে বিবিসি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে ।

(গ) মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের নীতি সবসময়.. একই গতিতে প্রবাহিত হয়নি। 

সময় ও বাস্তবতার সাথে সাথে বিভিন্ন সময়ে সোভিয়েত নীতিতে নানা পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত নীতির ৩টি পর্যায়। নিম্নে মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ভূমিকা দেয়া হলো :

১. বাংলাদেশকে নৈতিক সমর্থন দান : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত নীতির প্রথম পর্যায়ে সতর্কতা লক্ষ করা যায়। 

১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ কমিউনিস্ট পার্টির ২৪তম কংগ্রেসে ব্রেজনে এক ভাষণে, পূর্ব বাংলার ‘জনগণের ন্যায়সঙ্গত অধিকারের ভিত্তিতে রাজনৈতিক সমাধানে পৌছার কথা উল্লেখ করেন। 

এছাড়া ২৫ মার্চের গণহত্যার তীব্র নিন্দা জানায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। প্রেসিডেন্ট পদগর্নি ২ এপ্রিল ইয়াহিয়াকে পাঠানো একটি পত্রে জরুরি ভিত্তিতে রক্তপাত ও নির্যাতন বন্ধ করে শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করার জন্য পাকিস্তানকে আহ্বান জানায়। 

৬-১০ জুন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরন সিং রাশিয়া সফর করে রাশিয়াকে বাংলাদেশ ইস্যুতে আরও সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানান। যদিও এ পর্যায়ে রুশ নীতি শান্তিপূর্ণ উপায়ে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের পক্ষে অবর্তিত হয়।

২. কূটনৈতিক তৎপরতা : জুলাই মাসের ৯-১০ তারিখে হেনরি কিসিঞ্জারের পাকিস্তান হয়ে চীন সফর করার পরই উপমহাদেশের কূটনৈতিক বিপ্লব ঘটে। 

এর ফলে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পারস্পরিক নিরাপত্তার অভাববোধ থেকে ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট স্বাক্ষরিত হয় রুশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি। “এ চুক্তি পাকিস্তানকে নৈতিকভাবে দুর্বল করে দেয়। 

এতে করে রাশিয়া পূর্ব অবস্থান থেকে সরে এসে ভারতের পক্ষে সক্রিয় নীতির দিকে অগ্রসর হয়। ২৭-২৯ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী মস্কো সফরের পর রুশ নীতির এ অবস্থান আরও সুদৃঢ় হয়। 

এসময় বাঙালি বিরোধী যেকোনো আন্তর্জাতিক সমাধানের বিরুদ্ধে ভারতের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নও তৎপর হয়ে ওঠে।

৩. নৌবহর প্রেরণ : জাতিসংঘের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহার করা যাচ্ছে না দেখে যুক্তরাষ্ট্র নৌকূটনীতির আশ্রয় নেয়। 

৯ ডিসেম্বর নিক্সন টাস্কফোর্স - ৭৪ কে বঙ্গোপসাগরে পাঠানোর নির্দেশ প্রদান করেন এবং ১৬ ডিসেম্বর এটি গন্তব্যে এসে পৌছায়। 

যুক্তরাষ্ট্রের এ হুমকির জবাবে সোভিয়েত নৌবাহিনী ৬ ও ১৩ ডিসেম্বর পারমাণবিক মিসাইলবাহী দুটি ডুবোজাহাজ ভ্লাদিভস্ট থেকে বঙ্গেপসাগরে প্রেরণ করে। যারা ট্রাস্কফোর্স ৭৪ কে বঙ্গোপসাগরে তাড়া করে বেড়ায়। 

সেদিন যদি সোভিয়েত ইউনিয়ন নৌবহর প্রেরণ করে আমেরিকাকে সপ্তম নৌবহর প্রত্যাহারে বাধ্য না করতো, তাহলে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের জয়লাভ অনিশ্চিত হয়ে পড়ত।

(ঘ) মুক্তিযুদ্ধে চীনের ভূমিকা : মুক্তিযুদ্ধে চীন দুটি নীতি অবলম্বন করে। প্রথমত, চীন মুক্তিযুদ্ধের প্রতি কোন সহানুভূতি দেখানো থেকে বিরত থাকে। 

দ্বিতীয়, চীন সরকার দ্ব্যর্থহীনভাবে পাকিস্তানকে সমর্থন জানায়। নিম্নে মুক্তিযুদ্ধে চীনের বৈরী ভূমিকা আলোচনা করা হলো :

১. পাকিস্তান ঘেঁষা নীতি গ্রহণ : চীন গোড়া থেকেই রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ভিত্তিতে বাংলাদেশ বিষয়ে তার নীতি নির্ধারণ করে। 

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান হানাদার বাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যার সূচনা করার প্রায় ১৫ দিন মৌন থাকলেও ১১ এপ্রিল প্রথম সরকারি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। 

ঐ দিন জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে দেয়া এক পত্রে চৈনিক প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে এবং পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব, জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষায় চীন সরকার ও জনগণের সকল সময় সমর্থনের আশ্বাস দেন। 

পাকিস্তানে সংঘটিত ঘটনাকে তাদের ‘অভ্যন্তরীণ সমস্যা' বলে চীন সরকার চিহ্নিত করে, পাকিস্তানের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির একমাত্র শর্ত হিসেবে পাকিস্তানের দু অংশের ঐক্য সূদৃঢ় করার উপর জোর দেয়।

২. কূটনৈতিক তৎপরতা : যদিও চীন মুক্তিযুদ্ধে আগাগোড়া অত্যন্ত কৌশলী ভূমিকা নেয়। তবে অক্টোবর মাস পর্যন্ত প্রকাশ্যে পাকিস্তান সমস্যা সম্পর্কে মন্তব্য করেনি। 

এসময় পাকিস্তানকে গোপনে সামরিক ও নৈতিক সমর্থন অব্যাহত রেখেছে। আগস্ট মাসে রুশ-ভারত মৈত্রী চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে চীন শঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং সেপ্টেম্বরে চীন পাকিস্তানকে নতুন করে আশ্বস্ত করে জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষার ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামে পাকিস্তানকে সমর্থন করবে। 

যদিও বারবার পাকিস্তানের অনুরোধ সত্ত্বেও চীন পাকিস্ত ানের সাথে কোন প্রকার সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়নি।

৩. জাতিসংঘে বাংলাদেশ বিরোধিতা : ৩ ডিসেম্বর চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হলে চীন অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে। চীন জাতিসংঘে সরাসরি রাশিয়া ও ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশ বিরোধী অবস্থান নেয়। 

এ যুদ্ধের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নকে দায়ী করে একে প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়। এর ফলে বাংলাদেশ ইস্যু নয় রুশ-চীন দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে উঠতে থাকে। 

৫ ও ৭ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন দুটি প্রস্তাব উত্থাপন করে। প্রস্তাবগুলোর লক্ষ্য ছিল যুদ্ধ বিরতির মাধ্যমে ‘পূর্ব পাকিস্তানের' জন্য একটি রাজনৈতিক সমাধানের ব্যবস্থা করা। 

এ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে চীন প্রথম ভেটো দেয়। ৫ ডিসেম্বর চীন এক প্রস্তাবে ভারতকে আক্রমণকারী হিসেবে তীব্র ভাষায় সমালোচনা করে ।

৪. পাকিস্তানকে অস্ত্র সহায়তা প্রদান : চীন মুক্তিযুদ্ধের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানপন্থি নীতি গ্রহণ করে। নৈতিক সমর্থন ছাড়াও গোপনে প্রচুর অস্ত্র পাকিস্তানকে সরবরাহ করে। 

পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণের পর যে সকল অস্ত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতায় ব্যবহৃত হয় এর ৬০% চৈনিক এবং ৪০% মার্কিন ছাপযুক্ত। এর থেকে নিপীড়িত জনগণের বন্ধু হিসেবে দাবিদার চীনের হীন ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

(ঙ) মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা : মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই ভারতের সক্রিয় ভূমিকা দেখা গেলেও তা প্রথম দিকে ততোটা সক্রিয় ছিল না। মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় নীতির এটি পর্যায় ছিল। নিম্নে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা তুলে ধরা হলো :

১. জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সমর্থন দান : ভারতের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দান বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্নরকম ছিল। 

প্রথম পর্যায়ে অর্থাৎ মার্চ মাসের শেষ থেকে এপ্রিল মাসের শেষ দিক পর্যন্ত সময়কালে ভারত বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামরিক ব্যক্তিকে আশ্রয়দানের সুযোগ দেয়। 

কলকাতায় একটি প্রবাসী সরকার গঠনের ব্যবস্থা করে। এছাড়া পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার জন্য স্বল্প পরিমাণে সামরিক সহায়তা দিতে থাকে এবং মুক্তিযুদ্ধের অনুকূলে আন্তর্জাতিক সমর্থন পাওয়ার জন্য ভারত কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখে। এভাবে ভারত বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে।

২. জনসমর্থন ও সহযোগিতা প্রদান : ভারতের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল, সংগঠন, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী এবং জনগণ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অকুণ্ঠ সহানুভূতি প্রকাশ করে। 

সরকারি দল কংগ্রেস ছাড়াও কমিউনিস্ট পার্টি, সোশ্যালিস্ট পার্টি, জনসংঘ মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন জানায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সংগঠন ও শরণার্থীদের আশ্রয়, খাদ্য দিয়ে, সহায়তা করে সর্বস্তরের ভারতীয় জনগণ ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। 

বুদ্ধিজীবীরা ‘শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী সমিতি' গঠন করে অর্থ সংগ্রহ ছাড়াও জনমত সৃষ্টিতে অবদান রাখেন। 

পণ্ডিত রবিশঙ্কর জনসমর্থন ও অর্থ আদায়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের জনগণ। ‘বাংলাদেশ সেবা সংঘ’ স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম সহায়ক সমিতি নামে বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় ।

৩. মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং প্রদান : এপ্রিলের শেষ নাগাদ বাঙালি যুবকদের সশস্ত্র ট্রেনিং দেয়া শুরু হয় ভারতের মাটিতে। এছাড়া ভারত এসময় হালকা অস্ত্রও দেয়। 

RAW এর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে গঠিত হয় ‘মুজিব বাহিনী'। জুনে এদের ট্রেনিং শুরু হয় এবং নভেম্বর পর্যন্ত চলে। 

এছাড়া অসংখ্য বেসামরিক লোককে ভারত সরকার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। যারা প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং বাংলাদেশের বিজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।

৪. স্বাধীনতার স্বীকৃতি প্রদান : ভারতই প্রথম দেশ যারা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। 

ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বজনমত আরও দৃঢ় হয়। ভারতকে অনুসরণ করে ৭ ডিসেম্বর ভুটান বাংলাদেশ স্বীকৃতি প্রদান করে। 

এভাবে ভারতের পদাঙ্ক অনুসরণ করে একে একে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। যার ফলে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা অগ্রগণ্য।

উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পর বলা যায় যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বৃহৎশক্তির ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। 

প্রতিটি দেশ তাদের আদর্শিক এবং রাষ্ট্রীয় স্বার্থের জন্য কেউ বা বাংলাদেশের স্বপক্ষে ছিল কেউ বা বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল ।

আর্টিকেলের শেষকথাঃ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বৃহৎ শক্তিবর্গের ভূমিকা আলোচনা কর

আমরা এতক্ষন জেনে নিলাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বৃহৎ শক্তিবর্গের ভূমিকা pdf । যদি তোমাদের আজকের এই পড়াটিটি ভালো লাগে তাহলে ফেসবুক বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করে দিতে পারো। আর এই রকম নিত্য নতুন পোস্ট পেতে আমাদের আরকে রায়হান ওয়েবসাইটের সাথে থাকো।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ