যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুর পদক্ষেপ

 আসসালামু আলাইকুম প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা আজকে বিষয় হলো যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুর পদক্ষেপ জেনে নিবো। তোমরা যদি পড়াটি ভালো ভাবে নিজের মনের মধ্যে গুছিয়ে নিতে চাও তাহলে অবশ্যই তোমাকে মনযোগ সহকারে পড়তে হবে। চলো শিক্ষার্থী বন্ধুরা আমরা জেনে নেই আজকের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু সরকারের পদক্ষেপ সমূহ আলোচনা করো ।

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুর পদক্ষেপ
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুর পদক্ষেপ

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুর পদক্ষেপ

  • যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে শেখ মুজিবুর রহমানের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ আলোচনা কর। 
  • অথবা, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুর সরকারের চ্যালেঞ্জসমূহ আলোচনা কর ।
  • অথবা, দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু সরকারের (১৯৭২-১৯৭৫) পদক্ষেপসমূহ আলোচনা কর ৷ 
  • অথবা, স্বাধীনতা যুদ্ধোত্তর কালে দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ বর্ণনা কর । 

উত্তর : ভূমিকা : ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করলেও বঙ্গবন্ধু তখনো পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন। 

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং ১৯৭১ সালে ১৭ এপ্রিল মুজিব নগরে ঘোষিত স্বাধীনতার সনদ অনুযায়ী প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। 

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বঙ্গবন্ধু সর্বপ্রথম যে কাজটি করেন তা হলো ১১.০১.৭২ তারিখে ‘অস্থায়ী সংবিধান আদেশ' জারির মাধ্যমে দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন।

এভাবে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের শাসনামলে বা বঙ্গবন্ধুর শাসনামল শুরু হয়। 

আইন- শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর শক্তি ছিল নামে মাত্র। সারা দেশে ডাক বিভাগ ছিল বন্ধ। তার বিভাগ হয়ে পড়েছিল অচল, অসংখ্য কালভার্ট, ব্রীজ, সেতু ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল বিধ্বস্ত। 

এরূপ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করে দেশে শান্তি- শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছিল ।

→ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে শেখ মুজিবের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ : নয় মাস যুদ্ধের ভয়াবহতায় দেশে যখন অচলাবস্থা বিরাজমান। 

দেশের আইন, অর্থনীতি, সামাজিক, রাজনৈতিক ব্যবস্থা যখন হুমকির সম্মুখীন সেই অবস্থায় শেখ মুজিব ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং দেশ পুনর্গঠনে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। নিম্নে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে শেষ মুজিবের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ আলোচনা করা হলো 

১. পুনর্বাসন পদক্ষেপ : পুনর্বাসনের বিশাল দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে বঙ্গবন্ধু শাসনকার্য শুরু করেছিলেন। ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে পুনর্বাসন করা, দেশের অভ্যন্তরে প্রায় ৪৩ লাখ যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাসগৃহ পুনর্নির্মাণ করা এবং এদেরকে খাদ্যসহ অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করা ছিল সরকারের বিরাট দায়িত্ব। 

সে সময় প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙ্গে পড়েছিল। স্থানীয় পরিষদগুলো ছিল পাকিস্তান পন্থিদের দখলে। নতুন সরকার প্রচুর পরিমাণ আন্তর্জাতিক ত্রাণসামগ্রী লাভ করলেও সেগুলোর সুষ্ঠু বিতরণ করা বিদ্যমান প্রশাসনিক কাঠামো দিয়ে অসম্ভব ছিল। 

এমনি পরিস্থিতিতে সরকার রেডক্রস সোসাইটিকে জাতীয় পর্যায় থেকে নিম্নতর স্তর পর্যন্ত পুনর্গঠিত করেন। পাশাপাশি গ্রাম থেকে শুরু করে জেলা পর্যায় পর্যন্ত ত্রাণ কমিটি গঠনের রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়। 

গ্রামের আয়তন ও লোকসংখ্যার ভিত্তিতে ৫ থেকে ১০ সদস্যের 'ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটি গঠন করা হয়। আওয়ামী লীগ পন্থি স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা হয়। 

এভাবে ইউনিয়ন, থানা ও জেলা ত্রাণ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিগুলোর মাধ্যমে সারাদেশে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়। 

১৯৭৩ সালের ৪ মার্চ সংবাদপত্রসমূহে প্রকাশিত আওয়ামী লীগের ক্রোড়পত্রে দাবি করা হয় যে ঐ সময় পর্যন্ত সরকার ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রায় ৯ লাখ ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণ করেছে। একই সময় সামগ্রিক পুনর্বাসন কর্মকাণ্ডে মোট ব্যয় ৭২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ।

২. জাতীয়করণ কর্মসূচি : বঙ্গবন্ধু সরকার স্বাধীনতার প্রথম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে পাট, বস্ত্র, চিনিকল, ব্যাংক ও বিমা প্রতিষ্ঠানসমূহ জাতীয়করণের আইন পাস করে। 

বাংলাদেশ ব্যাংক জাতীয়করণ আদেশের আওতায় সমস্ত শাসনসহ ১২টি ব্যাংকের দখলিস্বত্ব সরকার গ্রহণ করে এবং সেগুলো সমন্বয় করে ৬টি নতুন ব্যাংকে রূপান্তর করে। 

১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির ১নং আদেশ এবং ১৬নং আদেশ-এর আওতায় অবাঙালি তথা পাকিস্তানি মালিকানার প্রায় ৮৫% শিল্প কলকারখানা ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয় এবং রাষ্ট্র সেগুলোর মালিকানা এবং দখল গ্রহণ করে। 

এ পরিত্যক্ত সম্পত্তিগুলো জাতীয়করণ আইনের মাধ্যমে ‘রাষ্ট্রায়ত্ত খাত' হিসেবে অভিহিত হয়। পরিত্যক্ত সম্পত্তি আদেশের আওতায় সম্পত্তির মালিকানা ফিরে পাওয়ার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করার সুযোগ ছিল। 

কিন্তু জাতীয়করণকৃত সম্পত্তি ফিরে পাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না, কাউকে সম্পত্তি ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারেও সরকারের কোনো ক্ষমতা ছিল না। জাতীয়করণ আইনের আওতায় ৬৭টি পাটকল, ৬৪টি বস্ত্রকল এবং ১৫টি চিনিকল জাতীয়করণ করা হয়। 

জাতীয় বিমান ও জাতীয় শিপিং সংস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের অধীনে আনা হয়। এভাবে ১৫ কোটি টাকা মূল্যের স্থায়ী সম্পদ বিশিষ্ট পরিত্যক্ত ও অনুপস্থিত মালিকদের শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও বৈদেশিক বাণিজ্য জাতীয়করণ করা হয় ।

৩. কৃষি সংস্কার : বঙ্গবন্ধু কর্তৃক শাসনভার গ্রহণের সময় শতকরা ৮৫ ভাগ লোক কৃষির উপর নির্ভরশীল ছিল। জাতীয় আয়ের অর্ধেকেরও বেশি ছিল কৃষিখাত নির্ভর। 

বঙ্গবন্ধু জানতেন যে কৃষিপণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে না পারলে দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। এজন্য তিনি সবুজ বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। 

‘কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে'-এ স্লোগানকে শুধু স্লোগান হিসেবেই ব্যবহার করেনি বঙ্গবন্ধু নেতৃত্বাধীন সরকার। মুক্তিযুদ্ধের পর ২২ লাখের বেশি কৃষক পরিবারকে পুনর্বাসন করার দায়িত্ব বর্তেছিল। কৃষিক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর সংস্কার নিম্নরূপ :

(ক) জমির সমস্ত বকেয়া খাজনা মওকুফসহ ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করেন।

(খ) পরিবার পিছু সর্বাধিক ১০০ বিঘা পর্যন্ত জমির মালিকানা সিলিং নির্ধারণ করেন।

(গ) ১৯৭২ সালের শেষ নাগাদ সারাদেশে হ্রাসকৃত মূল্যে ৪৮ হাজার শক্তিচালিত লোলিকট পাম্প, ২৯০০ গভীর নলকূপ ও ৩০০০ অগভীর নলকূপের ব্যবস্থা করা হয়। সেচ সুবিধা বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষকদের মধ্যে ১৯৭২ সালেই কেবল মাত্র অধিক | ফলনশীল ১৬,১২৫ টন ধান বীজ, ৪৫৪ টন পাট বীজ এবং ১,০৩৭ টন গম বীজ বিতরণ করা হয়। পাশাপাশি সারের দাম বিশ্ববাজারের চেয়ে হ্রাসকৃত মূল্যে সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয় ।

(ঘ) ধান, পাট, তামাক ও আখসহ গুরুত্বপূর্ণ কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির লক্ষ্যে এসব পণ্যের ন্যূনতম ন্যায্য বিক্রয়মূল্য ধার্য করে দেয়া হয়।

(ঙ) কৃষি গবেষণাকেও বঙ্গবন্ধু গুরুত্ব দেন। কৃষি বিষয়ক উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠনের জন্য বিশেষ উদ্যোগ গৃহীত হয়।

(চ) বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের ৮ মাসের মধ্যে গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প পুর্নোদ্যমে চালুর ব্যবস্থা করেন ।

(ছ) সরকারিভাবে খাদ্য মজুদ গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের মধ্যেই ১০০টি খাদ্য গুদাম নির্মাণ করা হয়।

(জ) কৃষকদের মধ্যে ১ লাখ বলদ ও ৫০ হাজার গাভী এবং ৩০ কোটি টাকার কৃষি ঋণ বিতরণ করা হয়।

এভাবে কৃষক দরদি নীতি গ্রহণের ফলে কৃষিক্ষেত্রে অগ্রগতির যে ধারা সূচিত হয় তারই ফলশ্রুতিতে আজ কৃষি ক্ষেত্রে শক্তিশালী ধারা সৃষ্টি হয়েছে।

৪. শিক্ষা সংস্কার : দেশের মানব সম্পদ উন্নয়নের উপর জাতীয় অগ্রগতি নির্ভরশীল। বঙ্গবন্ধু সেই যুদ্ধবিধ্বস্ত পরিবেশেও মানব সম্পদের উন্নতির লক্ষ্যে শিক্ষার বিকাশের উপর জোর দেন। 

শাসনভার গ্রহণের মাত্র ৬ মাসের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই বিজ্ঞানী ড. কুদরত-ই-খুদার নেতৃত্বে বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন নিয়োগ করেন। 

কুদরত-ই-খুদা কশিমন দেড় বছর কঠোর পরিশ্রম করে ১৯৭৪ সালের ৩০ মে একটি রিপোর্ট সরকারের নিকট দাখিল করেন। বঙ্গবন্ধু কমিশনের রিপোর্টের অপেক্ষা না করে কতিপয় জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। যেমন-

(ক) মার্চ '৭১ থেকে ডিসেম্বর '৭১ পর্যন্ত সময়কালের ছাত্রদের সকল বকেয়া টিউশন ফি মওকুফ করেন।

(খ) শিক্ষকদের নয় মাসের বকেয়া বেতন পরিশোধ করেন।

(গ) আর্থিক সংকট থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে পুস্তক বিতরণ করেন এবং অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক ঘোষণা করেন।

(ঘ) তিনি দেশের সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারিকরণ করেন । এর ফলে ১ লাখ ৬৫ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকদের চাকরি সরকারি হয়।

(ঙ) বঙ্গবন্ধু সরকার ৯০০ কলেজ ভবন ও ৪০০ হাই স্কুল পুনর্নির্মাণ করেন।

(চ) তিনি জাতীয় সংসদে ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস করার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের স্বায়ত্তশাসন প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু অফিস-আদালতে বাংলা প্রচলনের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। 

সেনাবাহিনীসহ সকল অফিসে বাংলা চালু করা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলা একাডেমিতে সাঁটলিপি, মুদ্রাক্ষর ও নথি লেখার প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা হয় ।

ইতোমধ্যে কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হয় কিন্তু দুর্ভাগ্য রিপোর্ট বাস্তবায়নের পূর্বেই বঙ্গবন্ধু নিহত হন।

৫. অর্থনৈতিক সংস্কার : বঙ্গবন্ধু সরকার শাসনভার গ্রহণের পরপরই নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। 

তিনি শিল্পপ্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়াত্ত করেন ও কৃষির উন্নতি বিধান করেন। দীর্ঘমেয়াদি ও উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্দেশ্যে সরকার ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে একটি পরিকল্পনা কমিশন গঠন করেন। 

১৯৭৩ সালের ১ জুলাই থেকে প্রথম পাঁচশালা পরিকল্পনা কার্যকর হয়। প্রথম পাঁচশালা পরিকল্পনায় যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের বিষয়টি গুরুত্ব লাভ করেছিল। এর দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য ছিল বৈষম্যহীন সমৃদ্ধ এক বাংলাদেশ গড়ে তোলা। 

তবে বঙ্গবন্ধু প্রথম পাঁচশালা বন্দোবস্ত বাস্তবায়ন করতে পারেননি। যাহোক, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু নিম্নরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন।

(ক) প্রথম পাঁচশালা পরিকল্পনা বিদেশি সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা ৬২% থেকে ১৯৭৭-৭৮ এর মধ্যে ২৭%-এ কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেন।

(খ) তিনি ৪টি করপোরেশন গঠন করেন। যেমন— 

(i) বাংলাদেশ জুট করপোরেশন।

(ii) বাংলাদেশ সুগার করপোরেশন। 

(iii) বাংলাদেশ টেক্সটাইল করপোরেশন ।

(iv) বাংলাদেশ গ্যাস আন্ত অয়েল করপোরেশন।

(গ) বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন এবং বিভিন্ন ব্যাংকের ১০৫০টি নতুন শাখা স্থাপন করেন।

(ঘ) বাংলাদেশ কৃষিব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে এর ৩৩৫টি শাখা স্থাপন করেন ।

(ঙ) স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য নতুন মুদ্রা চালু করেন ।

(চ) গ্রাম বাংলার উন্নয়নের জন্য বঙ্গবন্ধু সমন্বিত পল্লি উন্নয়ন কর্মসূচি এর উপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং বগুড়ায় পল্লি উন্নয়ন একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন।

(ছ) বঙ্গবন্ধু ঘোড়াসাল সার কারখানা, আশুগঞ্জ কমপ্লেক্সের প্রাথমিক কাজ ও অন্যান্য নতুন শিল্প স্থাপন, বন্ধ শিল্পকলকারখানা চালুকরণসহ অন্যান্য সমস্যা মোকাবিলা করে একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক অবকাঠামো তৈরি করে দেশকে ধীরে ধীরে একটি সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্রে পরিণত করার জোর প্রয়াস গ্রহণ করেন।

৬. সরকারি কর্মচারী ও শ্রমিক কল্যাণ ব্যবস্থা : বঙ্গবন্ধু শাসনভার গ্রহণের সময় রাষ্ট্রীয় কোষাগারে যে অর্থ ছিল তা দিয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন দেয়া সম্ভব ছিল না। 

কিন্তু তবুও সদ্য স্বাধীন দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিপূরক হিসেবে বঙ্গবন্ধু সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য নতুন বেতন কমিশন গঠন করে ১০ স্তর বিশিষ্ট নতুন বেতন স্কেল বাস্তবায়ন করেন। 

তিনি শ্রমিকদের জন্যও নতুন বেতন কাঠামো ঘোষণা করেছিলেন। শ্রমিকদের অবস্থার উন্নয়নের জন্য বঙ্গবন্ধু আন্তরিক ছিলেন। ১৯৭২ সালের ১ মে তিনি মে দিবসে শ্রমিকদের মজুরির হার বৃদ্ধির ঘোষণা দেন ।

৭. যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন : মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল বঙ্গবন্ধু যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের দিকেও গুরুত্ব দেন। 

তিনি ১৯৭৪ সালের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সময় ধ্বংসপ্রাপ্ত সকল ব্রিজ-সেতু পুননির্মাণ করেন এবং অতিরিক্ত ৯৭টি নতুন সড়ক সেতু নির্মাণ করেন। 

ঢাকা-আরিচা রুটের বড় বড় সড়ক সেতুগুলো বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে নির্মিত হয়। বঙ্গবন্ধুর সময় ১৯৭২ সালের ৭ মার্চের মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-যশোর ও ঢাকা-কুমিল্লা রুটে বিমান চালুর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। 

১৯৭৩ সালের ১৮ জুন ঢাকা-লন্ডন রুটে বিমানের প্রথম ফ্লাইট চালু হয়। কুর্মিটোলার আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর নির্মাণের কাজ শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর "শাসনামলে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন গঠিত হয়। 

এই শিপিং করপোরেশন ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই কোষ্টারসহ ১৪টি সমুদ্রগামী জাহাজ সংগ্রহ করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছিল। 

সরকার ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই ৫৫,০০০ টেলিফোন চালুর ব্যবস্থা করে। বহির্বিশ্বের সাথে টেলিযোগাযোগ স্থাপনের জন্য বঙ্গবন্ধুর পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র স্থাপনের কাজ সমাপ্ত করেন। এভাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনর্নির্মাণ করা হয় ।

৮. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে গৃহীত পদক্ষেপ : সরকার গঠনের তিনদিনের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু এক সরকারি আদেশের মাধ্যমে দেশে মদ, জুয়া, হাউজি ও ঘোড়া দৌড় নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। 

তিনি একই সাথে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করেন। ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বঙ্গবন্ধু ৯টি বন্ধু রাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক চুক্তি সম্পাদন করেন। 

তিনি ঢাকায়- শিশুকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু রামপুরায় বাংলাদেশ টেলিভিশনের স্থায়ী নতুন ভবন উদ্বোধন করেন। ক্রীড়াবিদদের কল্যাণার্থে বঙ্গবন্ধু ক্রীড়াসেবী কল্যাণ ফাউন্ডেশন গঠিত হয় । তিনি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড পুনর্গঠন করেন । কাকরাইল মসজিদ সম্প্রসারণের ব্যবস্থা করেন।

৯. নারীদের কল্যাণ গৃহীত ব্যবস্থা : বঙ্গবন্ধু দুস্থ মহিলাদের কল্যাণের জন্য ১৯৭২ সালে নারী পুনর্বাসন বোর্ড প্রতিষ্ঠা করেন। 

১৯৭৪ সালে এ বোর্ডের কার্যক্রমকে সম্প্রসারিত করে ‘নারী পুনর্বাসন ও কল্যাণ ফাউন্ডেশন' সৃষ্টি করেন। চাকরির ক্ষেত্রে নারীর জন্য তিনি ১০ ভাগ কোটা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। 

নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে তিনি ড. নীলিমা ইব্রাহিমকে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেন এবং মিসেস বদরুনেসা আহমেদ ও বেগম নূরজাহান মুরশিদকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করেন।

১০. প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ়করণ গৃহীত পদক্ষেপ : সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার দিকেও বঙ্গবন্ধুর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল। 

তিনি বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে আধুনিক ও শক্তিশালী করার চেষ্টা করেন। তিনি বিডিআর গঠনের আদেশ জারি করেন। 

১৯৭২ সালে তিনি পদাতিক, নৌ ও বিমান বাহিনী গঠনের লক্ষ্যে একটি অধ্যাদেশ জারি করেন। সেনাবাহিনীর জন্য পোশাক ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য বঙ্গবন্ধু সরকার ভারতের কাছ থেকে ৩০ কোটি টাকা অনুদান লাভ করেন। 

বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের স্বার্থে বঙ্গবন্ধু প্যারামিলিশিয়া বাহিনী হিসেবে জাতীয় রক্ষী বাহিনী গঠন করেন। রক্ষী বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল সেনাবাহিনীর ৬ ভাগের ১ ভাগ। মুক্তিযোদ্ধাদের ফেরত দেয়া অস্ত্রে তাদের সজ্জিত করা হয়েছিল।

১২. মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণ গৃহীত ব্যবস্থা : বঙ্গবন্ধু প্রতিটি শহিদ পরিবারকে আর্থিক অনুদান প্রদানের ব্যবস্থা করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তিনি গঠন করেন মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট । 

১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় বিশেষ খেতাব প্রদানর তালিকা সরকারি গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। 

মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখার জন্য মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল আতাউল গণি ওসমানীকে জেনারেল ও কর্ণেল আব্দুর রবকে মেজর জেনারেল পদে ভূষিত করেন। 

বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা সংগ্রামের শহিদদের স্মরণে সাভার ও মেহেরপুরে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন করেন।

১৩. অবকাঠামোগত উন্নয়ন : যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সরকারি বেসরকারি প্রায় সকল অবকাঠামো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ক্ষমতা গ্রহণের পর সরকারি অফিস আদালত পুনর্নির্মাণ করেন। 

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল প্রভৃতির সংস্কার সাধন ও নতুন নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সারাদেশে বিদ্যুৎ সাব স্টেশনগুলো ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছিল। 

তিনি ৫০০০ বিদ্যুৎ পোল আমদানি করেন এবং ১৯৭২ সালের মধ্যে ১৫০০ কি.মি. বিদ্যুৎ লাইন স্থাপন করেন এবং উৎপাদন ২০০ মেগওয়াট থেকে ৫০০ মেগাওয়াটে উন্নীত করেন। এছাড়া দেশের অন্যান্য অবকাঠামো সংস্কার ও পুনর্নির্মাণের ব্যবস্থা করেন।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের স্থপতি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে কেবল একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রই উপহার দেননি। 

তিনি মাত্র ৩ বছর সময়কালের মধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত পোড়ামাটির এক সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের শত সমস্যা জয় করে তাকে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করান। 

তিনি প্রশাসনিক ব্যবস্থা পুনর্গঠন করেন, দেশকে স্বাভাবিক করেন। এক কোটি শরণার্থীকে পুনর্বাসন করেন। যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ শিক্ষা, নারী কল্যাণ, কৃষির উন্নতি, অর্থনৈতিক সংস্কার প্রভৃতির মাধ্যমে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠিত করেন এবং বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে একটি মর্যাদাসম্পন্ন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। 

কেননা যুদ্ধ উত্তর সময়ে বাংলাদেশের প্রতিটি ব্যবস্থাই ভেঙ্গে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সেই ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের জন্য বিভিন্নরকম পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠিত করে স্বগৌরবে বলীয়ান করেন। তাই বঙ্গবন্ধু কর্তৃক গৃহীত নীতি ও পদক্ষেপ সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য ।

আর্টিকেলের শেষকথাঃ যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুর গৃহীত পদক্ষেপ

আমরা এতক্ষন জেনে নিলাম যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ । যদি তোমাদের আজকের এই পড়াটিটি ভালো লাগে তাহলে ফেসবুক বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করে দিতে পারো। আর এই রকম নিত্য নতুন পোস্ট পেতে আমাদের আরকে রায়হান ওয়েবসাইটের সাথে থাকো।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ