১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত গণহত্যার বিবরণ দাও
আসসালামু আলাইকুম প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা আজকে বিষয় হলো পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার বিবরণ দাও জেনে নিবো। তোমরা যদি পড়াটি ভালো ভাবে নিজের মনের মধ্যে গুছিয়ে নিতে চাও তাহলে অবশ্যই তোমাকে মনযোগ সহকারে পড়তে হবে। চলো শিক্ষার্থী বন্ধুরা আমরা জেনে নেই আজকের ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত গণহত্যার বিবরণ দাও ।
পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার বিবরণ দাও
- অথবা, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত গণহত্যার বিবরণ দাও ।
- অথবা, মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত গণহত্যার চিত্র তুলে ধর ।
- অথবা, স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকবাহিনীর গণহত্যার নৃশংসতার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও।
উত্তর ভূমিকা : ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মাস থেকে শুরু হওয়া মুক্তিযুদ্ধ নয়মাস দীর্ঘ ত্যাগ তিতিক্ষা, হত্যা, বঞ্চনা, লাঞ্ছনা, নির্যাতন, গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ প্রভৃতি ন্যাক্কারজনক কর্মকাণ্ডের মধ্যদিয়ে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের বিজয়ের মাধ্যমে শেষ হয়।
আর মুক্তিযুদ্ধের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল গণহত্যা, সভ্যতার বিপরীতে যার অবস্থান। গণহত্যাকে ইংরেজিতে বলে জেনোসাইড। গ্রিক 'জেনোস এবং লাতিন' সাইড' শব্দ দুটি মিলে জেনোসাইড শব্দের সৃষ্টি । জেনোস অর্থ বুঝায় জাতি।
বর্তমান আইন অনুযায়ী গণহত্যার অর্থ কোনো সরকার কর্তৃক ইচ্ছাকৃতভাবে জাতিগত, ধর্মীয় বা গোত্রীয় জনগণকে বিনাশ করা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সরকার বাঙালিদের উপর যে ন্যক্কারজনক হত্যাকাণ্ড ঘটায় তা ইতিহাসে গণহত্যা হিসেবে বিবেচিত।
গণহত্যায় ত্রিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়। এত কম সময়ে এত বেশি মানুষ হত্যার নজীর ইতিহাসে বিরল, যা সম্ভব হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত গণহত্যা : ১৯৭১ সালে শুরু হওয়া মুক্তিযুদ্ধের সূচনাতেই পাকিস্তানি বাহিনী নিরীহ সাধারণ মানুষের উপর হামলা চালিয়ে গণহত্যা সংঘটিত করে। নিম্নে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত গণহত্যার বিবরণ তুলে ধরা হলো :
১. ২৫ মার্চের গণহত্যা : ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত সাড়ে এগারোটায় ঢাকায় গণহত্যা শুরু হয়। যে রাত ছিল বাঙালিদের জন্য একটি ভয়ঙ্কর ভীতিপ্রদ রাত।
রাতের অন্ধকারে বর্বর পাকহানাদার বাহিনী নিরীহ ও নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর ট্যাংক, মেশিনগান, মর্টার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাকহানাদার বাহিনীর প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিল জহুরুল হক হল, জগন্নাথ হল, পিলখানাস্থ তৎকালীন ই.পি.আর. ব্যারাক, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, প্রভৃতি · স্থান।
২৫ মার্চ একইভাবে গণহত্যা চলেছিল পুরনো ঢাকায়, কচুক্ষেত, তেজগাঁও, ইন্দিরা রোড, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ঢাকা বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে, রায়ের রাজার, গণকটুলী, ধানমন্ডি, কলাবাগান, প্রভৃতি স্থানে। এছাড়াও দোকানপাট, ঘরবাড়ি, পত্রিকা অফিস, পেট্রোল পাম্প এবং অসংখ্য বস্তিতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়।
ভীত সন্ত্রস্ত জনগণ আর্তনাদ শুরু করলে বুলেটের আঘাতে তাদেরকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়া হয়। ২৫ মার্চের মধ্যরাত্রি থেকে ২৭ মার্চ পর্যন্ত শহরে নির্বিচারে গণহত্যা ও অগ্নি সংযোগ চলে।
১৮ মার্চ ঢাকা সেনানিবাসে তৈরি হয় ‘অপারেশন সার্চলাইট' নীলনকশা অনুযায়ী আরম্ভ হয় এ সামরিক অভিযান। একমাত্র ২৫ মার্চ রাতে হত্যা করা হয় প্রায় লক্ষাধিক বাঙালিকে।
২. গণহত্যার বিস্তার : ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী যে গণহত্যা শুরু করে তা চলে স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত ।
রাজাকার, শান্তিবাহিনী সংগঠিত হওয়ার পর গণহত্যার কার্যক্রম আরও পরিকল্পিতভাবে চলতে থাকে। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলেই গণহত্যা চালানো হয়েছিল।
অনেক জায়গায় একসঙ্গে মৃতদেহ গর্ত করে পুঁতে রাখা হয়েছে যেগুলিকে আমরা গণকবর বলি। এছাড়া নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় নিয়েও মানুষ হত্যা করে ফেলে রাখা হতো, এগুলি পরিচিত বধ্যভূমি হিসেবে।
যেমন ঢাকার রায়েরবাজার বা শিয়ালবাড়ী বধ্যভূমি। এরূপ বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলেই গণহত্যার নিদর্শন স্বরূপ গণকবর ও বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া যাবে। জরিপে ১০০০ এর বেশি গণকবর ও বধ্যভূমির নাম পাওয়া গেছে ।
৩. গণহত্যার লক্ষ্যবস্তু : পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত গণহত্যা নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুকে কেন্দ্র করে এগিয়ে চলেছিল। গণহত্যার লক্ষ্যবস্তু ছিল নিম্নরূপ:
(ক) ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিক পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল বাহিনীর লোক, পুলিশ এবং আধা সামরিক আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীর লোক ।
(খ) হিন্দু সম্প্রদায় ।
(গ) আওয়ামী লীগের লোক-নিম্নতম পদ থেকে নেতৃস্থানীয় পদ পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের লোক, বিশেষ করে এই দলের কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য ও স্বেচ্ছাসেবকগণ ।
(ঘ) ছাত্র- কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত তরুণের দল ও কিছু সংখ্যক ছাত্রী। যারা ছিলেন অধিকতর সংগ্রামী মনোভাবাপন্ন ।
(ঙ) অধ্যাপক ও শিক্ষকদের মত বাঙালি বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় যারা 'সংগ্রামী' বলে সেনাবাহিনী কর্তৃক সবসময় নিন্দিত হতেন।
৪. চুক নগর গণহত্যা : চুক নগর গণহত্যা ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গণহত্যা যেখানে একদিনে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। এই গণহত্যা চুক নগর গণহত্যা হিসেবে পরিচিত। চুক নগর খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানার অন্তর্গত ।
এখানে অধিকাংশ জমি ছিল নিচু, বিল, ডোবায় ভর্তি। তবে চুক নগর থেকে সাতক্ষীরা সড়ক ধরে পশ্চিমবঙ্গে যাওয়ার এক পথ আছে। ১৯৭১ সালে এ পথ ধরেই মানুষ বাংলাদেশ ত্যাগ করে ভারতে যেতে চেয়েছিল।
ডুমুরিয়া থানার আটলিয়া ইউনিয়নের চুক নগর বাজারটি তখনও ছিল বেশ পরিচিত। তিন দিক থেকে নদী ঘেরা চুক নগর বাজার। খুলনা শহর থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার পশ্চিমের ভদ্রা নদীর তীরে অবস্থিত।
খুলনা, সাতক্ষীরা ও যশোর জেলার সঙ্গে নদী ও সড়ক পথে তুলনামূলক ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য চুক নগর ব্যবসা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠে। যুদ্ধের সময় খুলনার বিভিন্ন থানায় হানাদারদের সহযোগীরা সাধারণ মানুষ জনের উপর অত্যাচার শুরু করে। বিশেষ করে হিন্দুদের উপর।
ফলে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকে ভিটেমাটি ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে যাওযার সিদ্ধান্ত নেন । তখন যাবার পথটি ছিল বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে চুক নগর আসা।
১৮/১৯ মে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষজন রওয়ানা হয় এবং ২০ তারিখে চুকনরগর এলাকায় লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। ২০ মে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সবাই যাত্রার আয়োজন করেছিল। কিন্তু সকাল ১০টার দিকে হানাদার বাহিনী এ অঞ্চলে এসে পৌঁছায় এবং ট্রাক থেকে নেমেই গুলি করা শুরু করে। চুক নগর পরিণত হয় এক মৃত নগরীতে।
মুহূর্তে সবাই লাশ হয়ে যায়। ভদ্রা নদীর পানিতে বয় রক্তের বহর। হত্যাকাণ্ডের পর স্থানীয় লোকজন লাশ পরিষ্কারের কাজে নেমে পড়ে। অধিকাংশ লাশই ভদ্রা নদীতে ফেলে দেয়া হয় ।
৫. বুদ্ধিজীবী গণহত্যা : ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে আরও একটি ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হয়। ১৪ ডিসেম্বর রাতে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করে রায়ের বাজারে হত্যা করা হয়।
পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এদেশের মেধা সম্পদ বিনষ্ট করার নিমিত্তে শিক্ষক, সাংবাদিক, ডাক্তার, প্রকৌশলী নাগরিক সমাজের সদস্যবৃন্দ প্রভৃতি বুদ্ধিজীবীদের গোপনে নামের তালিকা তৈরি করে এবং ১৪ ডিসেম্বর রাতে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে নির্বিচারে হত্যা করে ।
এদিন হাজার হাজার বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের রায়ের বাজারে নিয়ে যেয়ে গণহত্যা চালানো হয় এবং উক্ত অঞ্চলকে বদ্ধভূমিতে পরিণত করা হয়।
স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে স্বাধীনতার পর রায়ের বাজারে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ স্থাপিত হয়েছে। এটি ছিল বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে গণহত্যার সবচেয়ে ন্যক্কারজনক দৃষ্টান্ত ।
৬. পরিসংখ্যানের আলোয় গণহত্যা : ১৯৭১ সালে চলমান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ লোক নিহত হয় । যা পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক গণহত্যার দ্বারা সম্ভব হয়েছিল।
দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত এই গণহত্যায় হাজার হাজার নারী, পুরুষ, শিশু, শিক্ষক, ছাত্র, হিন্দু সম্প্রদায়, ডাক্তার, বুদ্ধিজীবী, লেখক প্রমুখ ব্যক্তিগণকে হত্যা করা হয়। যা সংখ্যার হিসেবে অগণিত। নিম্নে অঞ্চলভেদে গণহত্যায় নিহতদের সংখ্যা উল্লেখ করা হলো-
(১) দিনাজপুর - ৭৫ হাজার; (২) চাঁদপুর - ১০ হাজার; (৩) বরিশাল ২৫ হাজার; (৪) ঝালকাঠি - ১০ হাজার; (৫) ৬০ হাজার; (৬) আখাউড়া ২০ হাজার; (৭) ঠাকুরগাঁও - ৩০ হাজার; (৮) চট্টগ্রাম - ১ লাখ । (৯) কুষ্টিয়া ৪০ হাজার; (১০) নওগাঁ - ২০ হাজার; (১১) কুমিল্লা হাজার; (১২) নড়াইল - ১০ হাজার; (১৩) বগুড়া - ২৫ হাজার; (১৪) জামালপুর - ১০ হাজার; (১৫) হাবিগঞ্জ - ৩০ হাজার;
এভাবে গণহত্যার মাধ্যমে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করেছিল পাকহানাদার বাহিনী ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, ইচ্ছাকৃতভাবে নির্বিচারে মানুষ হত্যাই গণহত্যা নামে পরিচিত। পাকহানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে যে গণহত্যা শুরু করেছিল তার শেষ হয়েছিল ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার মধ্য দিয়ে।
পাকহানাদার বাহিনী সারাদেশে নির্বিচারে নারী, পুরুষ, শিশুকে হত্যা করে প্রায় ৩০ লক্ষ লোককে নিহত করেছিল। আর এ গণহত্যার নিদর্শন এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে বাংলার মানুষ।
গণহত্যার নিদর্শন হিসেবে এখনো বাংলাদেশে অসংখ্য গণকবর ও বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া যায়। ভবিষ্যতে হয়তো আরও পাওয়া যাবে। তাই ৭১ এর যুদ্ধের অন্যতম নেতিবাচক দিক পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যা ।
আর্টিকেলের শেষকথাঃ মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত গণহত্যার চিত্র তুলে ধর
আমরা এতক্ষন জেনে নিলাম স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকবাহিনীর গণহত্যার নৃশংসতার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও । যদি তোমাদের আজকের এই পড়াটিটি ভালো লাগে তাহলে ফেসবুক বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করে দিতে পারো। আর এই রকম নিত্য নতুন পোস্ট পেতে আমাদের আরকে রায়হান ওয়েবসাইটের সাথে থাকো।