ঈদুল ফিতরের দিনের সুন্নত সমুহ | eid ul fitr er sunnah

পবিত্র শাওয়াল মাসের প্রথম তারিখ হচ্ছে "ঈদুল ফিতর।" যা আরেকটি মহা পবিত্র ও ইবাদত বন্দেগির মাস "রমাদানের" পরের মাসেই আসে। পবিত্র রমাদানের দীর্ঘ এক মাসে সিয়াম সাধনার ফল হচ্ছে ঈদুল ফিতরের খুশি। তাই ইসলামে ঈদুল ফিতরের গুরুত্ব অত্যাধিক। 

প্রতিটি মুসলমানের জন্য ঈদুল ফিতর দিনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই গুরুত্বের কারণ হচ্ছে এই দিনের ইবাদত। যা আমাদের উপমহাদেশের অসংখ্য মুসলমান জানে না।

ঈদুল ফিতরের দিনের সুন্নত সমুহ
ঈদুল ফিতরের দিনের সুন্নত সমুহ

তাই আজ আমরা জানার চেষ্টা করব ঈদুল ফিতরের গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ গুলো কী কী। এই দিনে আমাদের রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কী কী করেছেন এবং তাঁর উম্মতদের কী কী করার জন্য আদেশ নিষেধ দিয়েছেন তা খুবই সংক্ষিপ্তভাবে জানার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। 

ঈদুল ফিতরের দিনের সুন্নত সমুহ | eid ul fitr er sunnah

বন্ধুরা ঈদুল ফিতরের দিনের সুন্নত সমুহ আমরা পয়েন্ট আকারে বিস্তারিত জেনে নিবো। সেজন্য আপনাদের প্রতিটি পয়েন্ট খুব ভালো ভাবে পড়তে হবে। চলুন জেনে নেওয়া যাক ঈদুল ফিতরের দিনের সুন্নত সমুহ | eid ul fitr er sunnah।

তাকবীর পাঠ

প্রতিটি ঈদের রাতে মুসলমানদের দায়িত্ব হচ্ছে তাকবীর পাঠ করা। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ। এই তাকবীর আমরা মসজিদে, বাড়িতে কিংবা রাস্তা পথে সফরে যেকোনো অবস্থাতেই পাঠ করতে পারি। 

এই বিষয়ে আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা বলেন, "এবং (আল্লাহ) তোমাদেরকে যে সুপথ দেখিয়েছেন, তজ্জন্য তোমরা আল্লাহর মহত্ত্ব বর্ণনা কর।" (সূরা বাকারা ১৮৫)

কখন তাকবীর পড়তে হয় 

পবিত্র শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখার সাথে সাথে কিংবা রমাদানের ত্রিশ রোজা শেষ হলেই ঐদিনের সন্ধ্যার পরেই তাকবীর উচ্চারণ শুরু হয়ে যাবে। এই মতামতটি হলো 

শাফেঈ ও হাম্বলী মাযহাবের। এই মতটিকে মেনে নিয়েছেন ইমাম বাগভী, ইবনে তাইমিয়া, ইবনে বায ও ইবনে উসাইমিন। মোটকথা অধিকাংশ আলেম উলামাদের মতে তাকবীর শুরু করা নিয়ে কোনো মতবিরোধ নেই।

তবে ঈদুল ফিতরের তাকবীর কখন শেষ হবে, এটা নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। একটা মত হচ্ছে, ইমাম সাহেব ঈদের নামায আদায়ের জন্য উপস্থিত হলেই তাকবীর উচ্চারণ বন্ধ করতে হবে। 

এই মতটিকে সমর্থন করেছেন মালেকী, হাম্বলী ও শাফেঈ। একইভাবে  ইমাম বাগভী ও ইবনে উসাইমিনও এ মতকে সঠিক মনে করেছেন।

আরেকটি মত হলো, ঈদুল ফিতরের খুৎবা শেষ হওয়ার সাথে সাথে তাকবীর উচ্চারণ বন্ধ হবে। এটা হাম্বলী মাযহাবের মতামত। কিছু কিছু শাফেঈ, তথা ইবনে তাইমিয়া ও ইবনে বাযেরও এই অভিমত।

গোসল এবং সাজ-সজ্জা করা

ঈদের দিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ হলো, গোসল করে পাক পবিত্র হওয়া এবং সাধ্যমত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন কাপড় পড়ে সুন্দর সাজসজ্জা করা। পবিত্র বুখারি শরিফে একটি হাদিস থেকে প্রমাণিত যে, ঈদের দিনে রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম পরিস্কার পরিচ্ছন্ন এবং সুন্দর পোশাকের সাজসজ্জা করতেন। 

হাদিস হচ্ছে, যা ইবনু উমার (রা.) থেকে বর্ণনা করা হয়েছে, তিনি বলেন, উমার (রা.) একটি কারুকার্যখচিত রেশমী জুব্বা নেন। যা বাজারে বিক্রি হচ্ছিল, তারপর সেটা নিয়ে রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)  এর কাছে উপস্থিত হন। তারপর তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)  আপনি এটি কিনে নিন এর দ্বারা আপনি ঈদের ও প্রতিনিধি দল গুলোর জন্য (যারা দেখা করতে আসে তাদের জন্য)  সাজবেন। 

এই হাদিসের ব্যাখ্যায় ইবনু কুদামা বলেন, এটা প্রমাণ করে যে, তৎকালীন সময়ে তাদের  নিকট এই সব ক্ষেত্রে (ঈদের দিন)  সজ্জিত হওয়ার বিষয়টি সাধারণ ছিল। আর ইবনু উমার (রা.) ঈদে তার সর্বাধিক সুন্দর কাপড়টি পড়তেন। ইমাম মালেক রহ. বলেছেন, আমি আলেম উলামাদের থেকে শুনেছি, তারা প্রত্যেক ঈদে সুগন্ধি এবং সাজগোজ করা পছন্দ করতেন। 

একইসাথে গোসলের সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, ইবনু উমার (রা.) প্রত্যেক ঈদুল ফিতরের দিন ঈদগাহে যাওয়ার আগে গোসল করতেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নাম্বার-১৩১৫) (সহীহ বুখারী শরীফ হাদীস নাম্বার-৯৪৮)

সুগন্ধি ব্যবহার করা

ঈদের দিন সুগন্ধি ব্যবহার করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নাহ। রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সুগন্ধি দেওয়া পছন্দ করতেন। এই বিষয়ে হানাফী, মালেকী, শাফেয়ী ও হাম্বলী প্রতিটি  মাযহাবের ঐকমত্যে রয়েছে। (আদ্দুররুল মুখতার-২/১৬৮)

ঈদের দিনে খাবার খাওয়া 

ঈদের দিন সালাতে যাওয়ার আগে কিছু খাবার গ্রহণ করা রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সুন্নাহ। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত,  তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঈদুল ফিতরের দিন কয়েকটি খেজুর না খেয়ে বের হতেন না। 

আর খেজুরও খেতেন তিনি বিজোড়। (সহীহ : বুখারী ৯৫৩, ইবনু খুযায়মাহ্ ১৪২৯, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৬১৫২, শারহুস্ সুন্নাহ্ ১১০৫, মুসনাদে বাযযার ৭৪৫৭। মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস নং ১৪৩৩)

সকাল সকাল ঈদগাহে গমন করা

প্রতিটি মুসলানের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ হলো, ফজরের নামাজের পরপরই (দেরী না করে) ঈদগাহের উদ্দেশ্যে বের হওয়া যাওয়া। (সুনানে আবু দাউদ হাদীস নাম্বার-১১৫৭)

সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা 

ঈদের দিনে খুবই জরুরী সুন্নাহ হলো, সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা। সাদাকাতুল ফিতর হলো, রোজার ভুল ত্রুটির কাফফারা দেওয়া। এই সাদাকাতুল আমাদের উপমহাদেশে টাকা দিয়ে আদায় করে। যদিও রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম )ের সাঃ এর সুন্নাহ হলো এক সা পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য জন প্রতি হিসাব করে দিয়ে দেওয়া। এই সাদাকাতুল ঈদুল ফিতরে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে আদায় করা। (আদ্দুররুল মুখতার-২/১৬৮)

ওয়াক্ত না হওয়া পর্যন্ত ইমামের বিলম্ব করা

ইমাম সাহেবের জন্য উত্তম হলো, ঈদের নামাযের ওয়াক্ত হওয়া পর্যন্ত দেরি করে ঈদগাহে যাওয়া। যাতে করে তিনি যাওয়ার সাথে সাথেই মুসল্লিদের নিয়ে ঈদের সালাত আদায় করতে পারেন। 

ঈদগাহে মহিলা যাওয়া

তৎকালীন সময়ে নিয়মিত সালাতের পাশাপাশি প্রতিটি ঈদগাহেও মহিলারা গমন করত। এটা খুবই জরুরী একটি সুন্নাহ ছিলো। যা আমাদের উপমহাদেশে নেই। অথচ পবিত্র হাদিসে মহিলাদের ঈদগাহে যাওয়ার  জন্য উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। 

উম্মু আতিয়্যাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, (ঈদের দিন) আমাদেরকে বের হবার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। তাই আমরা ঋতুবতী, যুবতী এবং তাঁবুতে অবস্থানকারিণী নারীদেরকে নিয়ে বের হতাম। 

ইব্‌নু ‘আওন (রহ.)-এর এক বর্ণনায় রয়েছে, অথবা তাঁবুতে অবস্থানকারিণী যুবতী নারীদেরকে নিয়ে বের হতাম। 

অতঃপর ঋতুবতী মহিলাগণ মুসলমানদের জামা‘আত এবং তাদের দু‘আয় অংশগ্রহণ করতেন। তবে ‘ঈদমাঠে পৃথকভাবে অবস্থান করতেন। (সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৯৮১) 

অর্থাৎ রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর জীবদ্দশায় মহিলারা নিয়মিত  সালাত আদায়ের পাশাপাশি ঈদগাহেও যেতো। 

হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া

ঈদগাহে হেটে যাওয়া হচ্ছে রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সুন্নাহ। শুধু তাইনয় হাদিসে এসেছে, ঈদগাহে এক পথে যাওয়া উচিত এবং অন্যপথে আসা উচিত। কেননা রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এমন করে ঈদগাহে যেতেন।

ঈদুল ফিতরের দিনের সুন্নত সমুহ  eid ul fitr er sunnah
ঈদুল ফিতরের দিনের সুন্নত সমুহ  eid ul fitr er sunnah

ঈদের মোবারক বাদ দেওয়া 

ঈদের দিনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ হলো একে অপরের সাথে মোসাফা করে দোয়া করা। ঈদের দিনে পরস্পরে সাক্ষাৎকালে সাহাবীগণ একে অপরের জন্য এই বলে দোয়া করতেন, "তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা।" অর্থাৎ "আল্লাহ আমাদের এবং আপনার সৎ আমল গুলো ক্ববুল করুন।" রেফারেন্স: হাসান (ইবনে হাজার আল আসকালানী)। ফাতহুল বারীঃ ২/৫১৭

ঈদের দিনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে সকলের জেনে রাখা উচিত যে, ঈদের দিনে মুসাফা করা সুন্নাহ হলেও ঈদের সালাত শেষে মুআনাকা অর্থাৎ কোলাকুলি করা বিদআত। কারণ, এই কাজ আমরা সৃষ্টি করেছি। এই কাজ রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এবং তার সাহাবীদের থেকে প্রমাণিত নয়।

এছাড়াও আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ যা আমাদের জেনে রাখা উচিত। যা পালন করতে পারলে অবশ্যই আমরা সওয়াবের ভাগিদার হবো।

ঈদের দিন অন্য দিনের তুলনায় তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠা। (তাহতাবী আলা মারাকিল ফালাহ-২৮৫৯, বাইহাকী হাদিস: ৬১২৬)

সুন্দর করে মিসওয়াক করা। (তাহতাবী আলা মারাকিল ফালাহ-২৮৯)

এছাড়াও ঈদের সালাত ঈদগাহে আদায় করা সুন্নাত। বিনা কারণেএই জামাত মসজিদে আদায় করা উচিত নয়। (সহীহ বুখারী হাদীস নাম্বার-৯৫৬)

একইভাবে  যে রাস্তা দিয়ে ঈদগাহে যাবে সম্ভব হলে ফেরার সময় অন্য রাস্তা দিয়ে ঘরে ফেরা। (সহীহ বুখারী হাদীস নাম্বার-৯৮৬)

আর্টিকেলের শেষকথাঃ ঈদুল ফিতরের দিনের সুন্নত সমুহ | eid ul fitr er sunnah

উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) এর শিক্ষা অনুযায়ী জানতে পারলাম ঈদুল ফিতরের সুন্নাত আমল গুলো। 

আমাদের প্রতিটি মুসলমানের উচিত রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সুন্নাহর অনুসরণ করা। রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সুন্নাহ ব্যতীত কোনো আমলই ইসলামে গৃহীত হয় না। 

আমাদের উপমহাদেশে আজ ইসলামের দুই ঈদ ছাড়াও, আরো অন্যান্য ঈদেরও প্রচলন হয়েছে। আল্লাহ আমাদের এইসব বিদআত থেকে রক্ষা বেঁচে থাকার তৌফিক দান করুন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ