গঙ্গা নদীর পরিচয় দাও । গঙ্গা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর
গঙ্গা নদীর পরিচয় দাও । গঙ্গা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর |
গঙ্গা নদীর পরিচয় দাও । গঙ্গা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর
উত্তর : ভূমিকা : গঙ্গা নদী বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে প্রবাহিত একটি আন্তর্জাতিক নদী। এটি ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জাতীয় নদীও বটে।
এটি পৃথিবীর একমাত্র নদী যার মধ্যে জৈব বর্জ্য পদার্থকে ভেঙে নিজেকে শুদ্ধ রাখার ক্ষমতা রয়েছে। বিজ্ঞানীদের মতে, এটি একপ্রকার অণুজীবের জন্য হয় যা একমাত্র গঙ্গাতেই পাওয়া যায়।
গঙ্গা হিন্দুধর্মাবল্লীদের কাছে পবিত্র নদী। তারা এই নদীকে দেবীজ্ঞানে পূজা করেন। গঙ্গার ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে।
ইতিহাসের একাধিক রাজধানীর কেন্দ্রস্থল ছিল এই নদীর তীরে। সুতরাং রাজনৈতিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক সকল ক্ষেত্রেই গঙ্গা আলোচ্য বিষয়।
১. গঙ্গার পরিচয় : গঙ্গা নদী ভারত ও বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী। এটি পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা নদী প্রণালিসমূহের অন্যতম। এ নদীর দৈর্ঘ্য ২,৫২৫ কি.মি. (১৫৬৯ মাইল) গঙ্গার উৎসস্থল পশ্চিম হিমালয়ে ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যে।
দক্ষিণ ও পূর্বে গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গঙ্গা বঙ্গোপসাগরে মিশে গেছে। জল প্রবাহের ক্ষমতা অনুযায়ী গঙ্গা বিশ্বের প্রথম ২০টি নদীর একটি।
গাঙ্গেয় অববাহিকার জনসংখ্যা ৪০ কোটি এবং জনঘনত্ব ১০০০ জন/বর্গমাইল (৩৯০ কি.মি.) । এটি বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল নদী অববাহিকা।
২. গঙ্গানদীর প্রবাহ পথ : মূল গঙ্গা নদীর উৎসস্থল ভাগীরথী ও অলকানন্দা নদীর সঙ্গমস্থল। হিন্দু সংস্কৃতিতে ভাগীরথীকেই গঙ্গার মূল প্রবাহ বলে মনে করা হয়।
যদিও অলকানন্দা নদীটি দীর্ঘতর। গঙ্গার জলের উৎস অনেকগুলো ছোট নদীর মধ্যে দুটি দীর্ঘতম ধারা। এ দুটি হলো অলকানন্দা, ধৌলিগঙ্গা, নন্দাকিনী, পিণ্ডার, মন্দাকিনী ও ভাগীরথী।
হৃষিকেশের কাছে গঙ্গা হিমালয় ত্যাগ করে হরিদ্বারে গাঙ্গেয় সমভূমিতে পড়েছে। এরপর কনৌজ, ফারুকাবাদ ও কানপুর শহরের ধার দিয়ে একটি অর্ধবৃত্তাকার পথে ৮০০ কি.মি. পার করেছে, এলাহাবাদের ত্রিবেনী সঙ্গমে যমুনা নদী গঙ্গায় মিশেছে।
এলাহাবাদ থেকে পশ্চিমবঙ্গের মালদহ পর্যন্ত গঙ্গা বারানসি, পাটনা, গাজীপুর, ভাগলপুর, মির্জাপুর, বালিয়া, বক্সার, সৈয়দপুর ও চুনার শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
পাকুরের কাছে গঙ্গার ঘর্ষণক্ষয় শুরু হয়েছে এরপর গঙ্গার প্রথম শাখানদী ভাগীরথী হুগলির জন্ম, বাংলাদেশের সীমান্ত পেরোনোর কিছু আগে হুগলি নদীতে গড়ে তোলা হয়েছে ফারাক্কা বাঁধ
৩. গঙ্গার জলবিদ্যা : গঙ্গা নদীর জলবিদ্যা বিশেষত গাঙ্গের বদ্বীপ অঞ্চলে বেশ জটিল। তাই নদীর দৈর্ঘ্য, জলধারণ ক্ষমতা ও অববাহিকার আকার ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে পরিমাপ করা হয়ে থাকে। গঙ্গার জল ধারণ ক্ষমতা সম্পর্কে বিভিন্ন মত প্রচলিত
রয়েছে, সাধারণত মেঘনার মোহনার কাছে গঙ্গার জল ধারণ ক্ষমতা মাপা হয়। এই পরিমাপের ফলে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার মিলিত জলের পরিমাণ ৩৮,০০০ মি.।
গঙ্গার জলচত দক্ষিণ-পূর্ব মৌসুমি বায়ু ঘটিত বর্ষাকালের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। পাশাপাশি গঙ্গার নিজস্ব জলপ্রবাহও ঋতুনির্ভর।
৪. গঙ্গার ঐতিহাসিক স্বীকৃতি : সিন্ধু সভ্যতার অন্তিম হরপ্পা পর্যায়ে (১৯০০-১৩০০) খ্রিষ্টপূর্ব হরপ্পাবাসীরা সিন্ধু উপত্যকা ছেড়ে পূর্ব দিকে বসতি স্থাপন করতে করতে পঙ্গ-যমুনা পর্যন্ত চলে আসে।
যদিও কেউ গঙ্গা পার হয়ে পূর্বতীরে বসতি স্থাপন করেনি, আদি বৈদিক যুগ বা ঋগ্বেদের যুগে গঙ্গা নয়, সিন্ধু ও সরস্বতী নদীই ছিল পবিত্র নদী।
কিন্তু পরবর্তী তিন বেদে গঙ্গার উপরে অধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। প্রথম যে ইউরোপীয় পর্যটকের রচনায় গঙ্গার উল্লেখ পাওয়া যা, তিনি মেগাস্থিনিস (৩৫০-২৯০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) তার দেখা ইন্ডিকা বইটিতে একাধিকবার গঙ্গার উল্লেখ পাওয়া যায়।
৫. গঙ্গায় বাঁধ নির্মাণ : ভারত সরকার ১৯৫১ সালে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের কথা ঘোষণা করলে ভারত ও (পূর্ব পাকিস্তান) বর্তমানে বাংলাদেশের মধ্যে গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়ে বিবাদ শুরু হয়।
এই বাঁধ নির্মাণের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল পঙ্গা থেকে ৪০,০০০ ঘটফুট জল ভাগীরথী হুগলি নদীর পথে ঘুরিয়ে দেয়া কলকাতা বন্দরে নাব্যতা রক্ষার জন্য।
সর্বশেষ ১৯৯৬ সালে ৩০ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি সাক্ষরিত হয়। যে চুক্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষা হয়নি, বরং ক্ষতিই হয়েছে।
৬. গঙ্গার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব : পঙ্গা নদী উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত গঙ্গা নদীটিই হিন্দুদের কাছে পবিত্র। সব জায়গাতেই গঙ্গায়ান হিন্দুদের কাছে একটি পুণ্যকর্ম বলে বিবেচিত হয়।
গঙ্গার জলে হিন্দুরা পূর্বপুরুষদের তর্পণ করে। হিন্দু পুরাণের সব জায়গায় গঙ্গাজলকে পবিত্র বলা হয়েছে এবং অনেক জায়গায় স্থানীয় নদীগুলোকে "গহাতুল্য” মনে করা হয়।
হিন্দুদের প্রতিটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পঙ্গাকে আবাহন করা হয়। মনে করা হয়, সকল পবিত্র জলেই গঙ্গা অধিষ্ঠিত।
প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণপক্ষের দশমী তিথিটি হিন্দুরা গদাবতরণ বা গঙ্গার মর্ত্যে অবতরণের স্মরণে বিশেষভাবে উদযাপন করে।
এ দিনটিকে 'দাহরা' বলে। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, এই দিন গঙ্গাস্নান করলে দশবিক বা দশ জন্মের পাপ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, গঙ্গা নদী বাংলাদেশ ও ভারতের ইতিহাস, ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। এ নদীকে কেন্দ্র করে এদুটি অঞ্চলের রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সম্পর্ক জড়িত।
এ নদীকে কেন্দ্র করে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা নানা ধর্মীয় কার্যালী পালন করে থাকে। এটি ভারতে গঙ্গা নদী হিসেবে পরিচিত হলেও বালাদেশে এটি পদ্মা নদী নামকরণ করা হয়েছে।
এ নদী বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ককে বাধাগ্রস্থ করছে এবং ভারত তার স্বার্থের জন্য এ নদীর সদ্ব্যবহার করতে সর্বদা আগ্রহী।