দ্বৈত শাসনের কারণ আলোচনা কর
দ্বৈত শাসনের কারণ আলোচনা কর |
দ্বৈত শাসনের কারণ আলোচনা কর
- অথবা, দ্বৈত শাসনের কারণ লিখ ।
উত্তর : ভূমিকা : বক্সারের যুদ্ধের পর একদিকে কোম্পানির প্রশাসনে শৃঙ্খলা আনয়ন, অপরদিকে বাংলা ও অযোধ্যার নবাব এবং মুঘল সম্রাটের সাথে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত স্থাপনের জন্য কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে রবার্ট ক্লাইভকে লর্ড উপাধি প্রদান করে ভারতে প্রেরণ করে।
অতঃপর ক্লাইভ সম্রাট শাহ আলমের সাথে সাক্ষাৎ করে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি প্রদানের প্রস্তাব করেন। সম্রাট শাহ আলম প্রস্তাবে রাজী হলে ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে এলাহাবাদ চুক্তির মাধ্যমে কোম্পানি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি সনদ লাভ করে।
দেওয়ানি লাভের পর কী করে কম খরচে প্রতি বছর রাজস্ব আদায় করা যায় তার জন্য কোম্পানি দ্বৈত শাসনের কৌশল উদ্ভাবন করে। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলার নবাবের হাতে নিজামত শাসন ক্ষমতা আর কোম্পানির হাতে রাজস্ব শাসন ক্ষমতা ন্যস্ত হয়।
→ দ্বৈত শাসনের কারণ : ১৭৬৫ সালে কোম্পানি দেওয়ানি লাভ করলেও সরাসরি শাসনক্ষমতা তারা নিজ হাতে নিতে চায়নি। এজন্য দ্বৈত শাসনব্যবস্থা কায়েম করে। নিম্নে দ্বৈত শাসনের কারণ আলোচনা করা হলো-
১. রাজনৈতিক কারণ : দেওয়ানি লাভের পর ক্লাইভ ইচ্ছা করলেই নবাবকে সরিয়ে সরাসরি ইংরেজ রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে শাসন ক্ষেত্রে দ্বৈত শাসন প্রবর্তন করে।
কেননা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, এরূপ করলে অল্প সংখ্যক ইংরেজ বণিকের আধিপত্যে দেশের জনগণ অসন্তুষ্ট হয়ে নানাপ্রকার বিরোধ ও গোলযোগের সৃষ্টি করবে এবং অন্যান্য ইউরোপীয় বণিক সম্প্রদায়ের মনে ঈর্ষার উদ্রেক করবে যা হয়তো ইংরেজদের স্বার্থকে বিপন্ন করতে পারে।
তাছাড়া সেসময় শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করলে কোম্পানিকে মারাঠা, শিখ, আফগান প্রভৃতি ভারতীয় শক্তির সঙ্গে যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে হতো।
এজন্য ক্লাইভ ইংরেজ প্রভুত্বের উপর একটি আবরণ রেখে দেন, যাতে প্রকৃত রাষ্ট্র বিপ্লবের চিত্রটি জনগণের নিকট স্পষ্টরূপে প্রতিভাত না হয়ে ক্রমশ ধীরে ধীরে প্রকট হয়।
২. প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাব : শাসনক্ষমতা নিজ হাতে গ্রহণ করার জন্য কোম্পানির যে পরিমাণ লোকবল প্রয়োজন তা কোম্পানির পক্ষে যোগান দেওয়া সম্ভবপর ছিল না।
ক্লাইভ ইচ্ছে করলেই অযোধ্যা ও দিল্লি অনায়াসে দখল করা সম্ভব হলেও এসব জায়গায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা সহজে সম্ভব নয়।
কারণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য যে লোকশক্তির প্রয়োজন তা কোম্পানির ছিল না। এজন্য ক্লাইভ শাসনক্ষমতা সরাসরি গ্রহণ না করে দ্বৈত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেন।
৩. ভাষা সম্পর্কে অজ্ঞতা : শাসনক্ষমতা সরাসরি গ্রহণ করার জন্য কোম্পানির প্রয়োজন ছিল এদেশীয় ভাষা, সংস্কৃতি, আইন- কানুন প্রভৃতি সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান লাভ।
সুচতুর ক্লাইভ উপলব্ধি করেছেন, এদেশের একেক অঞ্চলের ভাষা একেক রকম, আবার একেক অঞ্চলের আইন-কানুন, সংস্কৃতি প্রভৃতি ভিন্ন।
তাই এসব বিষয়ে বিশদ জ্ঞান ছাড়া সরাসরি শাসনভার গ্রহণ করলে প্রতি পদে পদে দেশীয় জনগণের গোলযোগ ও সমস্যা দেখা দিবে।
৪. নির্ভরশীলতার নীতি : বক্সারের যুদ্ধের পর বাংলায় কোম্পানির কর্মচারীদের মধ্যে দুর্নীতি ও অব্যবস্থা চরম আকার ধারণ করে। কোম্পানির প্রশাসনে শৃঙ্খলা আনয়ন এবং বাংলা ও অযোধ্যার নবাবষয় আর মুঘল সম্রাটের সঙ্গে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত স্থাপনের জন্য কোম্পানি কর্তৃপক্ষ রবার্ট ক্লাইভকে লর্ড উপাধি দিয়ে ভারতে প্রেরণ করে।
ক্লাইভ ভারতে আসে শাসনক্ষমতা সরাসরি নিজ হাতে গ্রহণ না করে নির্ভরশীলতার নীতি গ্রহণ করেন। সেজন্য বিচক্ষণ ক্লাইভ বাস্তব বুদ্ধির আলোকে রাজ্য জয়ের নীতি গ্রহণ না করে দেশীয় রাজাদের কোম্পানির উপর নির্ভরশীল করে ধীরে ধীরে কোম্পানির বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যকে রাষ্ট্রীয় সাম্রাজ্যে পরিণত করার নীতি গ্রহণ করেন। এ উদ্দেশ্যে ক্লাইভ শাসনব্যবস্থায় দ্বৈততা আনয়ন করেন।
৫. ব্যয় হ্রাস : দেওয়ানি লাভের পর কম খরচে প্রতি বছর যাতে রাজস্ব আদায় করা যায় তার জন্য কোম্পানি শাসনব্যবস্থা দুই ভাগে বিভক্ত করে দ্বৈত শাসন কায়েম করে।
কেননা বক্সারের যুদ্ধে কোম্পানির প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়েছিল। এ অবস্থায় কোম্পানির নতুন করে শাসনভার গ্রহণ করার ব্যয়ভার মেটানো সম্ভবপর ছিল না।
কারণ ইংল্যান্ড থেকে লোকবল নিয়ে আসতে গেলে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হতো। তাছাড়া তারা ছিল এদেশ সম্পর্কে অজ্ঞ।
তাছাড়া শাসনক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্যও প্রচুর সম্পদ ব্যয় করতে হতো যেটা কোম্পানির জন্য সুখকর ছিল না। তাই ধুরন্ধর ক্লাইভ শাসনব্যবস্থায় দ্বৈততার সৃষ্টি করে ব্যয় সংকোচন করেন।
৬. দায়িত্বহীন ক্ষমতা লাভ : দ্বৈত শাসনের মূল কথা ছিল দায়িত্বহীন ক্ষমতা, আর ক্ষমতাহীন দায়িত্ব। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে কোম্পানি লাভ করেছিল দায়িত্বহীন ক্ষমতা আর নবাব লাভ করেছিল ক্ষমতাহীন দায়িত্ব।
এ ব্যবস্থায় নবাব ছিলেন কোম্পানির ভাতাভোগী ক্রীড়নক। সমস্ত ক্ষমতার মালিক ও উৎস ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। নবাবের নামের অন্তরালে কোম্পানিই সকল ক্ষমতার অধিকারী হয়।
আবার কোম্পানি দেওয়ানি গ্রহণ করলেও ক্লাইভ এর সর্বাঙ্গীন দায়িত্ব আমলাতন্ত্রের হাতে ছেড়ে দেন, যদিও সর্বসময় ক্ষমতা কোম্পানির নিজের হাতে থাকে। বাংলার জন্য রেজাখান এবং বিহারে সিতাব রায়কে দেওয়ান নিযুক্ত করা হয়।
কোম্পানির সাথে এদের চুক্তি মোতাবেক কোম্পানি রাজস্ব শাসন ব্যাপারে প্রচলিত প্রথা বহাল রাখবে আর তারা সংগৃহীত রাজস্ব থেকে সমস্ত প্রশাসনিক ব্যয় মেটানোর পর উদ্বৃত্ত রাজস্ব কোম্পানিকে প্রদান করবে। ফলে কোম্পানি কোন প্রকার ঝামেলা বা দায়িত্ব ছাড়াই সম্পদের অধিকারী হবে।
৭. নবাবের ক্ষমতাহীনতা : দ্বৈত শাসন প্রবর্তনের আরেকটি কারণ ছিল নবাবকে ক্ষমতাহীন ও নির্ভরশীল করে তোলা। কেননা এ ব্যবস্থায় নবাবের দায়িত্ব ছিল, কিন্তু কোন ক্ষমতা ছি না।
অর্থের জন্য তাঁকে কোম্পানির দয়ার উপর নির্ভর করতে হতো। যার ফলে প্রয়োজনীয় সময় ক্ষমতা ও অর্থের অভাবে নবাব কোন ব্যবস্থা নিতে পারতেন না।
তিনি ছিলেন এই পরিস্থিতির একজন নীরব দর্শক মাত্র। অপরপক্ষে কোম্পানির ক্ষমতা ও অর্থের কোন অভাব ছিল না। কিন্তু কোম্পানির স্বার্থপর ও দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারীগণ প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে কোনরূপ দায়িত্বই পালন করত না।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, দেওয়ানি লাভের পর ব্যয় কমানো, রাজনৈতিক গোলযোগ পরিহার, দায়িত্বহীন ক্ষমতা লাভ, নবাবকে ক্ষমতাহীন করে রাখা প্রভৃতি বাস্তব কারণকে সামনে রেখে রবার্ট ক্লাইভ দ্বৈত শাসন প্রবর্তন করেন।
কেননা শাসন ক্ষমতা সরাসরি গ্রহণ করার মতো ক্ষমতা কোম্পানির থাকলেও পারিপার্শ্বিক অবস্থা, এদেশীয় আইন-কানুন, সংস্কৃতি, অর্থ ও লোকবল সংকট প্রভৃতি কোম্পানির অনুকূলে না থাকায় কোম্পানি সরাসরি শাসনক্ষমতা নিজ হাতে গ্রহণ না করে এক অভিনব কৌশল উদ্ভাবন করে দায়িত্বশীল ক্ষমতা লাভ করে। এজন্যই ক্লাইভ দ্বৈত শাসন প্রবর্তন করেন। দ্বৈত শাসনের ফলাফল ছিল অত্যন্ত সূদুরপ্রসারী।