শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে মিশরের ইতিহাসে মামলুকদের অবদানের বিবরণ দাও
শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে মিশরের ইতিহাসে মামলুকদের অবদানের বিবরণ দাও |
শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে মিশরের ইতিহাসে মামলুকদের অবদানের বিবরণ দাও
উত্তর : ভূমিকা : ইসলামের ইতিহাসের পঠন-পাঠনে যে সকল শাসক বংশের ইতিহাস খুবই গুরুত্বসহ আলোচনা করা হয় তার মধ্যে মিশরে মামলুক বংশ অন্যতম।
মুসলিম জাহানের এক ভয়াবহ দুর্দিনে মামলুকরা মিশরের শাসন ক্ষমতা দৃঢ়হস্তে ধারণ করে ইসলামকে আসন্ন ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেন। তাদের দীর্ঘ আড়াইশ বছরের শাসনকালে মিশরের শিল্প-সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের যথেষ্ট উন্নতি সাধিত হয়।
শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে মিশরের ইতিহাসে মামলুকদের অবদান : নিয়ে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে মিশরের ইতিহাসে মামলুকদের অবদান আলোচনা করা হলো :
(ক) শিল্পচর্চায় মামলুকদের অবদান : শিল্পচর্চা ও তার বিকাশে মামলুকদের অবদান অনস্বীকার্য। এক্ষেত্রে তাদের অবদানগুলোর উপর আলোকপাত করা হলো :
১. স্থাপত্যশিল্পে অবদান : মামলুক শাসনকাল যুদ্ধ-বিগ্রহে পরিপূর্ণ হলেও স্থাপত্যশিল্প ও চারুকলার উন্মেষ ঘটেছিল মামলুক যুগেই। মিসরের ইতিহাসে টলেমি এবং ফেরাউন যুগের পরে এত উঁচুদরের শিল্প সৃষ্টি হয়নি।
কালাউন, আল নাসির এবং আল হাসানের তৈরি মসজিদ, বিদ্যালয় ও সমাধিস্থলগুলোতে মুসলিম স্থাপত্য শিল্পে প্রাণময় হয়ে উঠেছিল।
২. কারুশিল্পে অবদান : মামলুক আমলে ফলিত শিল্পের প্রায় সব শাখাই নির্মাণের সাথে যুক্ত। বিশেষ করে ধর্মসংক্রান্ত স্থাপত্যশিল্পে এসব নিদর্শন আজও বিদ্যমান।
যেমন- ব্রোঞ্জের অসাধারণ নকশা করা মসজিদ দুয়ার, সুন্দর আরবীয় নকশা করা ব্রোঞ্জের ঝাড়বাতি, কুরআন রাখার জন্য সোনার উপর রত্নখচিত বাক্স ইত্যাদি ।
৩. অলংকরণ শিল্প : মামলুক শিল্পের এক সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল পাণ্ডুলিপির অলংকরণ। তবে এ অলংকরণ প্রায় সবক্ষেত্রেই কুরআনের পাতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
সঠিক রং ও তুলির টানে এক একটি পৃষ্ঠা রাঙিয়ে তোলা এতটাই সময় ও শ্রমসাধ্য ছিল যে একদিনে কুরআনের দুটি বা তিনটির বেশি পৃষ্ঠা সম্পূর্ণ অলংকরণ করা সম্ভব হতো না। মামলুক সুলতানদের নিকট কুরআনের অলংকৃত সংস্করণের পাণ্ডুলিপি সংগ্রহে ছিল।
(খ) সাহিত্যচর্চায় মামলুকদের অবদান : সাহিত্যচর্চায় মামলুকদের অবদান ছিল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সাহিত্য চর্চার মামলুকদের অবদান তুলে ধরা হলো :
১. গল্পকথন : মামলুকরা জনপ্রিয় আরব গল্পগাথা সাহিত্যের সূচনা করেছিল। আন্তারা এবং বাইবার্সের যে দুটি প্রেমকাহিনী আজও মুসলিম প্রাচ্যের জনগণের মনে গাঁথা রয়েছে, তা পরিমার্জিত হয়েছিল মামলুক যুগেই।
মামলুক যুগেই 'আলিফ লায়লা' জনপ্রিতার শীর্ষে উঠেছিল।২. ছায়ানাট্য। মামলুকদের মাধ্যমে তেরো শতকের শেষভাগে আরবি সাহিত্যে ছায়ানাট্যের আবির্ভাব ঘটে। সুলতান বাইবার্সের শাসনামলে মুহম্মদ ইবনে দানিয়াল আল খুজাই আল-মাওসিলি একজন ছায়ানাট্যের কবি ছিলেন।
(গ) আন-বিজ্ঞানে মামলুকদের অবদান : নিয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানে মামলুকদের অবদান আলোচনা করা হলো :
১. সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অবদান : সমাজবিজ্ঞানে মামলুক যুগের প্রধান অবদান ছিল জীবনীগ্রন্থ। এ যুগে সমাজবিজ্ঞানের প্রবক্তা ইবনে খালদুন এবং বিশিষ্ট জীবনীকার ইবনে শারিকানের উত্থান হয়।
এ দুজনের মধ্যে একক প্রতিভায় বিশ্ববিখ্যাত ছিলেন ইবনে খালদুন। অধ্যাপক টয়েনবি ইবনে খালদুনের 'মুকাদ্দিমা' সর্বযুগের মনুষ্য কর্তৃক রচিত সবচেয়ে বৃহত্তম গ্রন্থ বলে বর্ণনা করেছেন।
পক্ষান্তরে ইবনে খাক্সিকানের গ্রন্থের নাম 'ওয়াফায়াত আল-আয়আন ওয়া আনবা আনা আল-ঘামান'। যার অর্থ সম্প্রতি বিশিষ্ট মৃত ব্যক্তিদের জীবনী এবং সমকালীন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের ইতিহাস। গ্রন্থটিতে মুসলিম ইতিহাসের ৮৬৫ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির জীবনগাঁথা রয়েছে।
২. ইতিহাসশাস্ত্রে অবদান : মামলুক যুগে ইতিহাস গ্রন্থ রচনায় আবুল ফিদা, সুতি, ইবনে খালদুন এবং আল-মাকরিজি ছিলেন প্রথম শ্রেণির ঐতিহাসিক।
আবুল ফিদার 'তারিখ আল- বাসার' এবং 'আল-জাহিরা' ইতিহাসবিষয়ক অমূল্য সম্পদ। জালালউদ্দিন সুয়ূতি ছিলেন পনের শতকের সবচেয়ে বিখ্যাত পণ্ডিত।
তিনি ৫৬০টি গ্রন্থ রচনা করেন। মামলুক ঐতিহাসিকদের মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হলেন মাকরিজি। তার খ্যাতির প্রধান উৎস 'আল-মাওয়াইজ আল-ইতবার কি যিকর আল-থিতাত ওয়া আল-আসার গ্রন্থ।'
৩. ভূগোলশাস্ত্রে অবদান : ভূগোলশাস্ত্রে মামলুক যুগ বেশ সমৃদ্ধ। আব্দুল ফিনা ছিলেন এ সময়কার খ্যাতনামা ভূগোলশাস্ত্র বিশারদ। তার 'দেশসমূহের নির্ঘণ্ট' আল-ইদ্রিসির গ্রন্থের পরই আরবি সাহিত্যের সর্বোত্তম গ্রন্থ।
কাজতিনী ছিলেন ভৌগোলিক অভিধানপ্রণেতা। ক্রোমোসের মতে, তাকে আরবি সাহিত্যের 'প্রিনি' বলা হয়ে থাকে। কাজভিনীর পর্যায়ে আর একজন ভৌগোলিক ছিলেন নিমাসকী।
তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক নৌবিদ্যা বিশারদ ছিলেন আহম্মদ ইবনে মজিদ । ১৪৯৮ সালে তিনি পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো দ্যা গামাকে আফ্রিকা হতে ভারতে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
৪. গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের অবদান : আব্বাসীয় ও ফাতেমীয় যুগে আন-বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে মুসলমানগণ যে প্রাধান্য বিস্তার করে, তের শতকে তা স্তিমিত হলেও মামলুক রাজত্বে বিজ্ঞানের দুটি শাখায় তাদের আধিপত্য বজায় রাখেন।
এ দুটি শাখা ছিল গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান। অবশ্য গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে সবচেয়ে বড় অবদান রাখেন পারস্যের পণ্ডিতেরা।
মামলুক সুলতানদের অর্থানুকূল্যপুষ্ট, আরবি ভাষায় দক্ষ এসব বৈজ্ঞানিকগণের প্রধান কর্মক্ষেত্র ছিল ইলখানিদ মানমন্দির এবং বিশিষ্ট পণ্ডিত নাসির আদ-দ্বীন আত-তুসির প্রতিষ্ঠিত মারাগার গ্রন্থাগার।
সিরিয়ার জ্যাকোবাইট ক্যাথোলিক বারহেব্রিয়াস ঐ ঐতিহাসিক মারাগা গ্রন্থাগারে ইউক্লিডের ত্রিকোণমিতি এবং টলেমির জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর গবেষণালব্ধ ভাষণ, অভিসন্দর্ভ উপস্থাপন করেন।
৫. চিকিৎসা বিজ্ঞানের অবদান : মামলুক সুলতানগণ চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিস্তারে যথেষ্ট সাহায্য-সহযোগিতা দান করেন। সুলতান কালাউন নির্মিত আল মারিস্তান আল মনসুরী' ছিল তৎকালীন যুগ শ্রেষ্ঠ হাসপাতাল।
এই হাসপাতালের অধ্যক্ষ ছিলেন আবুল হাসান আলী ইবনে উল নাফিস। তিনি ফুসফুসের রক্ত সঞ্চালন ক্রিয়ার উপর ‘সারহ তাশরীহ আল কানুন নামক একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ রচনা করেন।
এছাড়া মামলুক সুলতানগণ প্রাচীন রোগ নির্ণয় ও চক্ষু চিকিৎসার জন্যও অবদান রাখে। বিখ্যাত চক্ষু চিকিৎসক আবু আল কাযাইল মোজাররাবাত নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এটি ছিল চক্ষু চিকিৎসার উপর সেই যুগের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ।
৬. উদ্ভিদ ও আলোকবিজ্ঞানে অবদান : মামলুক যুগে আলোকবিজ্ঞানে পারসিক কামালউদ্দিন যথেষ্ট পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। ইবনে আবি উসাবিয়াহ ছিলেন এ আমলের সর্বশ্রেষ্ঠ উদ্ভিদবিদ্যা বিশারদ ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মামলুকগণ আড়াইশ বছরের অধিক সময় যাবৎ শিল্প-সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশে অতুলনীয় অবদান রাখেন।
এ যুগে চিকিৎসাবিজ্ঞান, ইতিহাসবিদ্যা, জীবনচরিত, সাহিত্য, ধর্মশাস্ত্র প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিশেষ অগ্রগতি সাধিত হয়।
এ সময়ের মনীষীদের নাম শুধুমাত্র মিসরের মামলুক ইতিহাসেই নয়, বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসে উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায় চিরভাস্বর হয়ে আছে। ,
মামলুক সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় এ সময় শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে মিশর উন্নতির চরম শিখরে প্রবেশ করে।