বাংলার ইতিহাসে পালবংশের গুরুত্বপূর্ণ অবদানসমূহ পর্যালোচনা কর

বাংলার ইতিহাসে পালবংশের গুরুত্বপূর্ণ অবদানসমূহ পর্যালোচনা কর
বাংলার ইতিহাসে পালবংশের গুরুত্বপূর্ণ অবদানসমূহ পর্যালোচনা কর

বাংলার ইতিহাসে পালবংশের গুরুত্বপূর্ণ অবদানসমূহ পর্যালোচনা কর

উত্তর : ভূমিকা : পালবংশ আট শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে প্রায় চারশত বছর বাংলা ও বিহারে শাসনকারী রাজবংশ । গোপাল প্রতিষ্ঠিত এ বংশের শাসন চলে নানা ধরনের উত্থানপতনের মধ্য দিয়ে প্রায় আঠারো পুরুষ ধরে। 

ধর্মপাল ও দেবপালের শাসনামল ছিল পালবংশের প্রতিপত্তির যুগ। ও সময়ই বাংলা ও বিহারে এ বংশের শাসন দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। 

এভাবে এ যুগের পাল রাজারা নিজেদেরকে উত্তর ভারতীয় রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার মতো যথেষ্ঠ শক্তিশালী হিসেবে গণ্য করেন। 

পালবংশ পর্যায়ক্রমে উত্তর ভারতীয় রাজনীতিতে একটি পরাক্রান্ত শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। পাল শাসনামলে বাংলার রাজনীতি ও অর্থনীতে নব জোয়ারের সৃষ্টি হয়েছিল। 

নিম্নে প্রশ্নালোকে বাংলায় পালবংশের অবদান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা তুলে ধরা হলো :

→ বাংলায় পালবংশের অবদান : পালবংশ ছিল তৎকালীন সময়ে অন্যতম প্রভাবশালী রাজবংশ। প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে পালবংশের অবদান নিম্নরূপ :

১. সার্বভৌম রাজবংশ প্রতিষ্ঠা : ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে পালবংশই সর্বপ্রথম স্বাধীন সার্বভৌম রাজবংশ প্রতিষ্ঠার নজিনা স্থাপন করে। 

রাজা শশাঙ্কের মৃত্যুর পর প্রায় ১০০ বছর বাংলার ইতিহাসে মাৎসন্যায় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। সমাে অত্যাচার-জুলুম মহামারি আকার ধারণ করেছিল। 

সমাজে ন্যায়বিচারের কোনো বালাই ছিল না। গোপালের নেতৃত্বে স্বাধীন সার্বভৌম পালবংশের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলার সমাজে বিদ্যমান যাবতীয় অরাজকতা দূরীভূত হয়।

২. প্রজাবৎসল শাসননীতি : বাংলায় পাল শাসনামলের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল দিক হলো তাদের প্রজাবৎসল শাসননীতি। পাল রাজাগণ বৌদ্ধ হলেও রাজ্যের অধিকাংশ প্রজা ছিল হিন্দু। পাল রাজা ধর্মপাল ধর্মীয় সম্প্রীতিকে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। 

যার ফলশ্রুতিতে বৌদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও রাজকীয় উচ্চ পদসমূহে ব্রাহ্মণদের স্থান দিয়েছিলেন। তৎকালীন বাংলায় হিন্দু ও বৌদ্ধ প্রজাদের মাঝে ভেদাভেদ ছিল না; বরং সকলে মিলেমিশে বসবাস করতো।

৩. সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা : পালদের তাম্রশাসনসমূহে সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। গ্রাম পর্যায় থেকে কেন্দ্রীয় সরকার পর্যন্ত স্তরীভুক্ত সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল পাল সমাজে।

প্রশাসনব্যবস্থা ছিল সর্বব্যাপী, খেয়াঘাটের ব্যবস্থা থেকে শুরু করে নদীপথ, স্থলপথ, ব্যবসা- বাণিজ্য, নগর- বন্দর, আইন-শৃঙ্খলা কোনো ক্ষেত্রই প্রশাসন যন্ত্রের আওতার বাইরে ছিল না। পালদের চারশত বছরের শাসনামলের মূল ভিত্তি ছিল সুষ্ঠু সুবিন্যস্ত শাসনব্যবস্থা।

৪. প্রাদেশিক শাসন : প্রাচীন বাংলায় পাল শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রাক্কালে সেখানে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল না। 

পরবর্তীতে উত্তর ভারতে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা চালু করার জন্য রাষ্ট্রকূট রাজাগণ জোর দাবি তোলেন। পরবর্তীতে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও প্রাদেশিক শাসন জারির ব্যাপারে জোর দাবি উঠতে থাকে।

প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে পাল রাজাগণ কোনো কোনো অঞ্চলে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা জারি করেছিলেন।

৫. সামাজিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা : পাল রাজবংশ বাংলায় যে অবদান রেখেছিল তার মাঝে অন্যতম হলো সামাজিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা। 

দীর্ঘ শাসনামলে এই সামাজিক সম্প্রীতি পাল যুগকে অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি সাধনে সহায়তা করেছিল। পাল রাজা ধর্মপাল বহু সহস্র রৌপ্য মুদ্রা খরচ করে জনস্বার্থে কয়েকটি দিঘি খনন করেছিলেন। 

তাছাড়া পাল রাজাগণ কর্তৃক জনস্বার্থে নির্মিত বহু নিদর্শনের ধ্বংসাবশেষ তাদেরক কল্যাণমুখী শাসনের পরিচয় বহন করে।

৬. চিত্রকলায় অবদান : চিত্রকলায় পাল রাজাদের অবদান ছিল অত্যধিক। পালযুগের পূর্বে কোনো চিত্রকলার নিদর্শন বাংলায় খুঁজে পাওয়া যায়নি। মন্দির ও ধর্মীয় স্থাপত্যের অলংকরণে দেয়ালচিত্রেরও কোনো নিদর্শন আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। 

১৬০৮ সালে রচিত লামা তারানাথের গ্রন্থে পাল রাজা ধর্মপাল ও দেব পালের রাজত্বকালের দুই বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ধীমান ও তার ছেলে বাঁটপালের কথা উল্লেখ রয়েছে। একাধারে প্রস্তর ও ধাতু নির্মিত ভাস্কর্য এবং চিত্রশিল্পে তারা ছিলেন পারদর্শী।

৭. দর্শন শাস্ত্রের বিকাশ : বাংলার ইতিহাসে পাল রাজবংশ যে অবদান রেখেছিল তার মাঝে অন্যতম ছিল দর্শন শাস্ত্রের বিকাশ। তৎকালীন সময়ে বিভিন্ন দর্শন শাস্ত্র লেখনীর প্রমাণ পাওয়া যায়। 

যেমন- দর্শন শাস্ত্রের মূল্যবান গ্রন্থ "আগমশাস্ত্র"। পাদকারিকা বর্ধমানের ভুরিশ্রেষ্ঠী গ্রামের শ্রীধর ভট্ট, ন্যায় কন্দলানী বিশেষভাবে উল্লেখ্য। বর্তমান বাংলার সমাজে ও তৎকালীন পাল আমলে রচিত দর্শন শাস্ত্রের প্রভাব লক্ষ করা যায়।

৮. বাংলার গৌরব ও মর্যাদা বৃদ্ধি : বাংলায় স্বাধীন পালবংশ প্রতিষ্ঠা করেন গোপাল। তথাপি বাংলার পাল শাসনামলের স্বর্ণযুগ হিসেবে বিবেচনা করা হয় মূলত ধর্মপাল ও দেবপালের শাসনামলকে। 

তাদের শাসনামলে বাংলার রাজ্য সম্প্রসারণ ও সুশাসন নীতি বিদ্যমান ছিল, যা বাংলার গৌরব ও মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছিল বলে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন।

৯. চিকিৎসা শাস্ত্রে অবদান : পাল শাসনামলে চিকিৎসাশাস্ত্রেও উন্নতি সাধিত হয়েছিল। পাল রাজা নয়াপালের কর্মচারী নারায়ণ পন্ডের পুত্র চক্রপানি দত্ত চিকিৎসা শাস্ত্রের বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। 

চিকিৎসা সংগ্রহ, আয়ুর্বেদদীপিকা, ভানুমতি, শব্দ চণ্ডিকা যার মাঝে অন্যতম। চিকিৎসা শাস্ত্রের উপর রচিত অন্যতম গ্রন্থ শব্দ প্রদীপ এর গ্রন্থাকার সুরেশ্বর ছিলেন পাল রাজপরিবারের অন্যতম চিকিৎসক। যা তৎকালীন পাল আমলে চিকিৎসা শাস্ত্রের বিকাশের স্বর্ণালি ইতিহাস তুলে ধরে। পাল শাসনামলে

১০. ভাস্কর্য শিল্পে অবদান : শিল্পকলাসমূহের মাঝে ভাস্কর্য শিল্পের প্রকৃত উন্নতি সাধিত হয়েছিল। গুপ্ত ভাস্কর্যের ধারাবাহিকতায় বাংলার পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলার ভাস্কর্য শিল্প এ যুগে এক নতুন রূপ পরিগ্রহ করে। 

যাকে পাল স্কুল অব কালচারাল আর্ট হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। বাংলার ভাস্কর্য শিল্প স্থান করে নিয়েছিল সর্বভারতীয় শিল্পকলার আসরে। পাল শাসনামলে স্থাপত্যকীর্তির অন্যতম নির্মাণ সোমপুর মহাবিহার।

১১. ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতি : প্রাচীনত বাংলায় পালবংশের শাসকদের অন্যতম অবদান হলো ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতি সাধন। পাল শাসনামলের পূর্বে তথা অষ্টাদশ শতাব্দীতে মানুষ মাগধি ভাষায় কথা বলত। 

অতঃপর পালনের শাসনামলে বাংলা ভাষা বিকাশ লাভ করে। এ সময় বাংলা ও সংস্কৃত ভাষা বহু সাহিত্য রচিত হয়েছিল। সন্ধ্যাকর নন্দী কর্তৃক রচিত 'রামচরিতম' কাব্য সর্বভারতীয় সংস্কৃত সাহিত্যের মাঝে স্থান করে নিয়েছে।

১২. বৌদ্ধধর্মের প্রসার : পাল শাসনামলে পালবংশের রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধধর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। এমনকি তিব্বত লাভা, সুমাত্রা, মালয়েশিয়াতেও এ ধর্ম ছড়িয়ে পড়েছিল। 

বাংলার বৌদ্ধ বিহারগুলো থেকে বহু পণ্ডিত ঐসব দেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। যা বহির্বিশ্ব বাংলার গুরুত্ব বাড়িয়ে নিয়েছিল।

১৩, স্বতন্ত্র রাষ্ট্রীয় চেতনার বিকাশ : রাজার শশাঙ্কের তিরাধানের পর বাংলায় শাসনব্যবস্থায় ধ্বস নেমেছিল। পরবর্তীতে পাল রাজবংশ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর পাল রাজাগণ বাংলায় স্বতন্ত্র রাষ্ট্রীয় চেতনার বিকাশ সাধনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ঐতিহাসিকগণ পাল রাজাদেরকেই রাষ্ট্রীয় চেতনা বিকাশের মূল কারিগর বলে মনে করেন।

১৪. শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশ : পাল রাজাগণ শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশেও ব্যাপক অবদান রেখেছিলেন। পাল রাজগণ নিজেরাও ছিলেন শিক্ষানুরাগী ও সংস্কৃতিমনা। নালন্দা, সোমপুর, বিক্রমশীলা মহাবিহারগুলো ছিল সে সময়ের অন্যতম শিক্ষাকেন্দ্র। 

এসব শিক্ষাকেন্দ্র থেকে তৎকালীন সময়ে বহু বৌদ্ধ পণ্ডিত ধর্ম প্রচারের জন্য এশিয়ার দেশগুলোতে সফর করে ভূয়সী | প্রশংসা কুঁড়িয়েছিলেন।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, পালবংশ প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে গৌরবময় অধ্যায় রচনা করেছে। পালবংশ চারশত বছর বাংলা শাসন করে। 

একই রাজবংশের এতো দীর্ঘকালের শাসন ইতিহাসে বিরল। এই দীর্ঘ সময়ের শাসন বাংলা কৃতিত্ব অবশ্যই পাল যুগের গৌরব। 

বিস্তৃত সম্রাজ্য, সাম্রাজ্যে সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা, প্রজাবৎসল শাসন নীতি, বিভিন্ন শিল্পকলার ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উৎকর্ষ সাধন এবং সাহিত্য চর্চা এসবই পালবংশের অনন্য কৃতিত্ব। সর্বোপরি তৎকালীন বাংলার ইতিহাসে পালবংশের অবদান অনস্বীকার্য। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ